চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রাস্তায় হিজড়া বিড়ম্বনা: সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর কী করছে?

সিএনজির দরজায় হঠাৎ ধাক্কা। চমকে তাকালাম। কয়েক জন লোক। দলে প্রায় চার-পাঁচজন। মুখে কড়া মেকআপ। এই দিনের আলোতেও। ‘আপু কিছু সাহায্য করো,’ বলার ভঙ্গি দেখেই বুঝে ফেললাম হিজড়ার কবলে পড়েছি। ঝামেলা এড়াতে ব্যাগ থেকে ২০ টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিলাম। এবার আরেকজন বলে উঠলেন, ‘ঈশ এত্তো বড়লোক। সিএনজিতে যাস। মাত্র ২০ ট্যাকা?‘ আমি মুখ টিপে হাসি। তাদের আচরণে শরীর কাঁপে। চারদিকে তাকাই। কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। ঝামেলা এড়াতে যে যার পথে ধাবমান!

‘আজ এটাই রাখ,’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন পাশ থেকে ভেঙচি কাটেন, ‘এ্যাই মিষ্টি আপু। তোর ছান গিলাসটা (সানগ্লাস) তো সুন্দর। ওটা দিয়ে যা।’ আমি আবার হাসি। ‘ওই সুন্দরী’ বলেই আরেকজন বিরক্তিকর শব্দ চয়নে (লেখার অযোগ্য) মেতে ওঠেন। এবার বিব্রত হওয়ার পালা। তারা আর কী বলতে পারে ভেবে অস্বস্তি বাড়তে থাকে। বাইরে তাকাই। কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। যে যার পথে ধাবমান!

‘সিগন্যালটা ছাড়তে এতো সময় লাগছে কেন। এরা দূর হয় না কেন?’ এসব ভাবতে ভাবতে আরেক জন দেখলাম সিএনজির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করছেন। আমি শিউরে উঠি। অনুভব করি প্রচণ্ড শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। শুনেছি ছিনতাইয়ের হরেক রকম পদ্ধতি হয়। মনে হতে লাগল, এবার আমিও সেই ‘হরেক রকমে’র শিকার। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম সিগন্যালটা যেন দ্রুত ছাড়ে। ঢাকার রাস্তা। সিগন্যাল কি সহজে ছাড়ে! কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মনে হয় আমার প্রার্থনা শুনলেন। হঠাৎ সিগন্যাল ছেড়ে দিল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

এটা আগারগাঁও সিগন্যাল এবং প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনের প্রতিদিনকার ঘটনা। পেশাগত কারণে আমার মিরপুরের বাসা থেকে তেজগাঁওয়ের অফিসে আসতে এই সিগন্যাল দুটো দিয়েই যাতায়াত। প্রতি সকালে রাস্তায় বের হই ওই ‘বিশেষ মানুষ’দের আতঙ্ক স্মরণ করে। এই পথ দিয়ে যারা চলাচল করেন, হলফ করে বলতে পারি সবাই তাদের আতঙ্কে থাকেন। এই আতঙ্কের নাম প্রকাশ্য চাঁদাবাজি। আমি জানি তারা অসহায়। আমি জানি এই সমাজ তাদের ঠিকভাবে গ্রহণ করে না। আমি এও জানি পরিবার থেকে তারা বিচ্ছিন্ন।

একজন মিডিয়াকর্মী হওয়ায় আমি এর বিপরীত দিকটাও জানি। জানি গতবছর সমাজসেবা অধিদপ্তর সাত হাজার ৬৫০ জন হিজড়ার পুনর্বাসনের জন্য কাজ শুরু করেছে। তাদের জরিপ মতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজার ৩১৯ জন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে হিজড়াদের শনাক্ত করে পুনর্বাসনের আওতায় আনা হচ্ছে। এরপর বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম হিজড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূল স্রোতে আনা হচ্ছে।

প্রশিক্ষণের পর তাদেরকে আর্থিক সহায়তা হিসেবে ১০ হাজার টাকা বা সেলাই মেশিনও দেয়া হচ্ছে। এত কিছুর পরও রাস্তায় তারা কেন এভাবে মানুষকে অপমান করছে, হয়রানি করছে? স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে। তাদের জরিপ অনুযায়ী ১০ হাজার ৩১৯ জন হিজড়ার মধ্যে রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা হিজড়ারা কি পড়ে না? তাহলে পুনর্বাসন কর্মসূচীতে তাদের অন্তর্ভুক্তি নেই কেন? যদি নাই থাকে তাহলে সে কাজটা কে করবে মাননীয় সমাজ কল্যাণমন্ত্রী?

আগারগাঁও কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় পুলিশের সামনেই চলছে হয়রানি। না দিলেই চলে অশ্লীল ভাষায় গালি। একদিন ব্যাগে ভাংতি টাকা ছিল না। বললাম ভাংতি নেই। শুরু হলো খিস্তি খেউর। উপায় না দেখে ১০০ টাকার নোট দিলাম। একজন সেটা নিয়ে দৌড়ে পালাল। আর চিৎকার করে বললেন, ‘ভাংটি দিমু না।’ ঠিক যেন ইচ্ছে-খুশির শহর! ‘সরকার তো তোমাদের ভাতা দেয়,’ বলতেই চিৎকার তাদের জবাব, ‘হ সরকারের সাথে আমরা হাঙ্গা (বিয়ে) বইছি!’ পাশের সিএনজি রিক্সা কিংবা গাড়ির যাত্রীদেরও দেখি একই অবস্থা। প্রতিবাদ করলেই অশ্লীল গালি।

আবার দেখলাম কেউ কেউ তাদের কর্মকাণ্ডে খুব মজা পাচ্ছেন। দাঁত কেলিয়ে হাসছেন। আরেকদিন খুব রাগ হলো। ‘আজ দিতে পারব না, অন্যদিকে যাও’ বলা মাত্র একজনের হুমকি, ‘না দিলে কিন্তু গায়ে ছেপ (থুতু) দিমু।’ একজন মিডিয়াকর্মী হয়েও রাস্তায় প্রতিদিন নীরবে হেনস্তার শিকার হচ্ছি। ভাবতেই কেমন যেন অসহায় লাগে। একদিন এক সহকর্মীকে বললাম, ‘ভাই একটা রিপোর্ট করেন। রাস্তায় হিজড়াদের হয়রানি খুব বেড়েছে।’ উনি হেসে বললেন, ‘আপা লাভ নাই। টিভিতে রিপোর্ট হওয়ার পর ক’দিন বন্ধ থাকবে। আবার পুলিশকে টাকা দিয়ে ওরা রাস্তায় নামবে!’

জীবনের তাগিদে ওই রাস্তায় আমার প্রতিদিন চলাচল করতেই হবে। আর প্রতিদিন পুলিশের সামনে চাঁদা দিতেই হবে। না দিলেই তো হেনস্তা। অন্য রাস্তা দিয়েও তো চলাচলের সুযোগ নেই। তাহলে উপায়? সিএনজি চলতে থাকে। আমি উপায় খুঁজতে থাকি। বাইরে তাকাই। শহরটা ব্যস্ত এমন নানা অসুবিধা নিয়ে। কারো দিকে কারো খেয়াল নেই। যে যার পথে ধাবমান।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)