রামপাল বিদ্যুৎ নিয়ে এখনো উত্তেজনা থামেনি। আন্দোলন হবে জোরদার এমন দাবি করছেন প্রচলিত কিছু জ্ঞানী মানুষ। তাদের নিজেদের ভাষায় তারা ‘চরম’ দেশ প্রেমিক। তাদের সাথে দেশের আমজনতা মিলে সুন্দরবন রক্ষায় আন্দোলন করবেন। ওদিকে সরকার নিজ সিদ্ধান্তে অটল। বলছে রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য কোন ক্ষতি হবে না।
তাবৎ উন্নয়নেই, যা আমাদের আরাম আয়েশ দেয়, তাতেই ক্ষতি আছে। তবে ক্ষতির মাত্রাটা কত সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের জীবন সহজ বা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিতে কিছু ক্ষতি মেনে নিতেই হয়। আমরা যে মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার, টেলিভিশন ব্যবহার করি; এসি, ফ্রিজসহ গৃহে ব্যবহৃত তাবৎ বৈদ্যুতিক বা ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য; কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে ব্যবহৃত সার, কীটনাশক; শিল্পে ব্যবহৃত যাবতীয় কেমিক্যাল পণ্য; এমন কী আছে যাতে মানুষ, পরিবেশের ক্ষতি নেই! তাই কোন উন্নয়নে ক্ষতির মাত্রা কত সেটা সবার কাছে বিবেচ্য বিষয়। কারণ উন্নয়ন অপরিত্যাজ্য, আমরা কেউ উন্নয়নের বাইরে থাকতে পারব না।
যা হোক, সরকার কীসের ভিত্তিতে এই দাবি করে আর আন্দোলনকারীরা কীভাবে তা খণ্ডন করবেন তা খুব বড় প্রশ্ন। এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেক পানি গড়িয়েছে। তাই আসুন একটু ভিন্ন চোখে দেখে নিই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থা।
রাতারাতি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় জ্বালানী নিরাপত্তা বিধান যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য জরুরী। সবচেয়ে কম খরচে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। তাই উন্নত দেশগুলোতেও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ১ নং পছন্দ। একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্পে কী কী ধরণে বিদেশি এক্সপার্ট কাজ করেন তার একটা তালিকা তৈরি করেছি। একই ধরণের প্রকল্পের ডকুমেন্ট দেখে। বিদেশি এক্সপার্টগণ শুধু বাংলাদেশের মত একটা দেশে না পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একই ধরণের কাজ করেন। এটা তাদের পেশা। বাংলাদেশে তাদের কাজ প্রশ্নবিদ্ধ হলে পরে অন্য দেশে তাদের কাজ পেতে খুব অসুবিধা হবে বা পাবে না। তাই তারা নিজেদের স্বার্থেই যথাসম্ভব ভাল কাজের চেষ্টা করেছেন। উনারা এমনই করে থাকেন।
যে সব ফার্ম কাজ পান তাদের রামপালের মতো একই ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়নে বিস্তর অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। তারা কাজ পাবার জন্য যে প্রস্তাব পেশ করেন সেটা মূল্যায়ন করলেই বোঝা যায় তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি কতখানি পূর্ণ না খালি। সেই সাথে একই ধরনের কাজের বাস্তব ১০ থেকে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা যদি না থাকে তাদেরকে এক্সপার্ট হিসেবে সিলেক্ট তো দূরের কথা এমন প্রকল্পে তাদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয় না। কারণ অভিজ্ঞরা ভুল কম করেন, এমন প্রকল্প প্রণয়নে, সেটাই ধারণা করা হয়।
এবার দেখে নিই সরকারের প্রকল্পে কী কী ধরণের এক্সপার্ট কত দিক, কত বিষয়ের কথা বিবেচনা করে প্রকল্প প্রণয়ন করে থাকেন। বিদেশি এক্সপার্টদের সাথে কাজ করার জন্য এর বাইরেও থাকে প্রায় সমান সংখ্যক লোকাল এক্সপার্ট প্রতিটি বিদেশি এক্সপার্টদের কাউন্টারপার্ট হিসেবে ৩ থেকে ৫ বছর ধরে, নিরলসভাবে। বিদেশি এক্সপার্টদের একটা চিত্র এমন হয়:
১। প্রজেক্ট ম্যানেজার (পাওয়ার প্ল্যান্ট)
২। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (পাওয়ার প্ল্যান্ট)
৩। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (স্টীম জেনারেটর)
৪। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (কোল হ্যাণ্ডেলিং এন্ড অ্যাশ হ্যাণ্ডেলিং সিস্টেম)
৫। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (কোল আনলোডিং)
৬। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (Balance of Plant including De-Sox, De-Nox and liquid fuel receiving System)
৭। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পাওয়ার প্ল্যান্ট এণ্ড ব্যালান্স অফ প্ল্যান্ট)
৮। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (সাব-স্টেশন অ্যান্ড সুইচ ইয়ার্ড)
৯। আই এন্ড সি ইঞ্জিনিয়ার
১০। আরকিটেকচারাল ইঞ্জিনিয়ার
১১। ইউ এস সি পাওয়ার প্ল্যান্ট অপারেশন এণ্ড মেইটেনেন্স এক্সপার্ট (১)
১২। ইউ এস সি পাওয়ার প্ল্যান্ট অপারেশন এণ্ড মেইটেনেন্স এক্সপার্ট (২)
১৩। ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার (সিভিল ইঞ্জিনিয়ার)
১৪। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (ল্যান্ড ডেভলপমেন্ট)
১৫। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (ড্রেজিং)
১৬। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (ল্যান্ড রিক্ল্যামেশন-১)
১৭। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (ল্যান্ড রিক্ল্যামেশন-২)
১৮। মেইন্টেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার (জেনারেটর মেইন্টেনেন্স ফ্যাসিলিটিজ)
১৯। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (হাইড্রোলিক-১)
২০। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (হাইড্রোলিক-২)
২১। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (হারবার মেইন্টেনেন্স ফ্যাসিলিটিজ)
২২। জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পোর্ট এন্ড ল্যাণ্ড)
২৩। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (সী ওয়াল)
২৪। ন্যাচারাল কন্ডিশন এক্সপার্ট
২৫। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (ডাইক)
২৬। হাইড্রোলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার
২৭। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (কন্সট্রাকশন প্ল্যান্ট)
২৮। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (কস্ট এস্টিমেট)
২৯। ডকুমেন্ট স্পেশালিস্ট
৩০। এনভারমেন্টাল এন্ড সোশ্যাল এক্সপার্ট
৩১। ইকোনোমিস্ট
৩২। কন্ট্রাক্ট এক্সপার্ট (FIDIC Yellow & Red-1)
৩৩। কন্ট্রাক্ট এক্সপার্ট (FIDIC Yellow & Red-2)
৩৪। HOV/AIDS এক্সপার্ট
উপরের তালিকার আলোকে বলা যায়, একা একা ঘরের মধ্যে বসে কেউ সবজান্তা হিসেবে কোন প্রকল্প তৈরি করেন না। প্রকল্প এলাকার মানুষ, পরিবেশ, অর্থনীতি সব কিছুই বিবেচনায় এনে প্রকল্প প্রণীত হয়, সরকারীভাবে। তাই সরকারের দাবিকে অগ্রাহ্য করতে হলে অধ্যাপক আনু মাহমুদ সাহেব আর তার সাথে থাকা তার সভাপতিকে কত বছর কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের একেক জনকেই কয়েক ধরণের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী নিতে হবে, কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে হবে। অথবা তাদের টিমে এমন অভিজ্ঞ এক্সপার্ট সমাবেশ করতে হবে, যারা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার রসে জারিত। তা না হলে সরকার তাদের কথা পাগলের প্রলাপ মনে করতেই পারে। উভয়ের লক্ষ্য দেশের কল্যাণ। সরকার দেশের কল্যাণ করতে জনগনের দিয়ে ম্যাণ্ডেটেড। তাকে কনভিন্স করতে ভ্যালিড পয়েন্ট দিতে হবে, দিলে সব সরকারই নেবে, নেয়। যাই হোক ‘আমি সব জানি’ বললে এই যুগে আর কেউ নেবে না।
রাতারাতি বিদ্যুৎ তৈরি করা যায় না। বিদ্যুৎ তৈরি করার প্ল্যান্ট করতে অনেক সময় লাগে। দেশের বর্তমান অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কয়লা বিদ্যুতের কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। কয়েক বছরেই আমাদের দেশের গ্যাসের রিজার্ভ শেষ হয়ে যাবে। তখন কয়লা, এলএনজি, জল বিদ্যুৎ, উইন্ড মিল, তেল, ইত্যাদির কাঁচামাল বাইরে থেকে কিনে বিদ্যুৎ তৈরি করতে হবে। তাই কয়লাসহ নানা ধরণের বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় দক্ষতা অর্জন করাও আমাদের একটা কাজ। বিদ্যুৎ না থাকলে তখন কী করবো আমরা! সব শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেব? মানে শৈল্পিক, ছন্দময় আন্দোলনের অন্যতম নেতা আনু মাহমুদ সাহেবদের জন্য কী হারিকেন মিছিলের জন্য পরিবেশ তৈরী করবে সরকার!
যে পরিবেশ নিয়ে এতো এতো কথা হচ্ছে সেটার দিকে তাকালে আমরা কী দেখি? ঢাকা শহরের চারপাশের ইটভাটা আর শিল্পকারখানার বর্জ্য, ঢাকার শব্দও দূষণ, নগরীর বিভিন্ন ধরণের বর্জ্য আর কেমিক্যাল বর্জ্যে ঢাকা শহর ইতোমধ্যে পৃথিবীর অন্যতম দূষিত নগরীর খেতাব পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে জানা যায় যে, দূষণের কারণে প্রতিদিন গড়ে ৪১ জন মারা যান। যাদের অধিকাংশই গরীব শ্রেণির মানুষ। যারা পুষ্টিহীন গর্ভবতী মায়ের ঘরে জন্ম বা জন্মের পরে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। যার ফলে এসব মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে তুলনামূলকভাবে কম। তাই দূষণের কালো থাবায় তারা নিজেদের আর রক্ষা করতে পারে না। এটা নিয়ে আনু মাহমুদ সাহেবরা ততো বেশী সোচ্চার নন, যতোটা করছেন রামপাল বিদ্যুৎ নিয়ে।
এতো কাঠখড় পুড়িয়ে প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে এখন এমন কথা কেন? একই ধরণের বিদ্যুৎ প্রকল্প দেশে আরও অনেক জায়গায় হচ্ছে। সেগুলো নিয়ে হাল্কা বা মাঝারী শব্দও নেই কেন? কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ক্ষতি হলে সবখানেই হবে। এই দেশের সবখানেই মানুষ গিজ গিজ করছে। নাকি তারা গরীব বলে তাদের চেয়ে অন্য কিছু বড়! মানুষের চেয়েও কি দেশে আরও বড় কিছু আছে! সরকার এমন অনমনীয় কেন হচ্ছে! এই সরকার জনগণের দাবির মুখে নতুন এয়ারপোর্টের স্থান কি বদল করেনি? তাই যদি হবে তবে এখন কেন করছে না। কারণ কী!
রামপালের বিদ্যুতের দাম নিয়ে যে কথা বলা হয় তা কতটা ফাঁকিতে ভরা তা দেখুন নিচের তথ্যে-
এরা কারা তা খতিয়ে দেখতে হবে। এদের নেতাদের অধিকাংশই ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সরকার উৎখাতের জন্য ‘বন্দুকের নল’ দিয়ে চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন গুরুতর অপরাধে আটক হয়ে জেলে থাকার পর বঙ্গবন্ধু নিহত হলে জিয়া সরকারের দয়ায় জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবার সক্রিয় হয়েছে তাদের ভাষায় দেশ ও জনগনের কল্যাণের (!) রাজনীতিতে। সাথে নিয়েছেন কিছু বিভ্রান্ত ‘ভূপেন হাজারিকা’কে। একবার যে বহুগামী হয়, সে বার বার বহুগামী হবে সেটাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। দেশ ও জনগণের জানমাল হরণকারীরা ভালো মানুষের ভেক ধরে, ভালো হয়ে যায় খুব কম। তার বদলে কিছু ভালো মানুষকে তারা ‘ভূপেন হাজারিকা’ বানিয়ে ছাড়ে, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)