রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে মিডিয়াতে চলছে তুলকালাম কাণ্ড। চলছে তুমুল কলম যুদ্ধ, পক্ষে বিপক্ষে। কখনো যুক্তি আর প্রমাণ দিয়ে, কখনোবা আবেগ দিয়ে নানা কথা বলা হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায়।
সরকার, সরকারী বা বিরোধী রাজনীতিবিদ, পরিবেশবাদী, সবাই সুন্দরবন রক্ষা চান, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশের উন্নয়নের জন্য, শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য, অন্যান্য কাজের জন্যও জ্বালানী ঘাটতি মেটানো জরুরি। আধুনিক জীবনের প্রতি পদে পদেই লাগে বিদ্যুতের মতো জ্বালানী। শুধু সুখের জন্য না, জীবন বাঁচাতে বা সাজাতেও এটার দরকার। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে আমাদের কতটুকু লাভ আর সুন্দরবনের কতটুকু ক্ষতি হবে তার হিসাব নিকাশ চলছে চুলচেরা।
J. Environ. Res. Develop. Journal of Envionmental Research and Development Vol. 7 No. 1A, July-September 2012 এর বরাত দিয়ে অ্যামেরিকা থেকে আমাদের বন্ধু মুরাদ নেওয়াজ জানিয়েছেন যে, সুন্দরবন Mangrove টাইপের বনাঞ্চল তাই এর কার্বন শোষণ ক্ষমতা অনেক বেশি। উপরের রেফারেন্সের মাধ্যমে তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, সুন্দরবনের কার্বন শোষণ ক্ষমতা প্রতিদিন ৪.২ মিলিয়ন কেজি। নোনা পানিতেও যে কার্বন শোষণ হয় সেটা বাদেই এই হিসাব। তিনি হিসাব কষে দেখিয়েছেন যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণ হতে পারে ৩.১৬ মিলিয়ন কেজি। এতে যা বুঝা যায় রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না।
শুধুমাত্র তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন যে কার্বন নিঃস্বরিত হবে তাতেই সুন্দরবনকে দুর্বল করে আগামী পঞ্চাশ বছরে নষ্ট করে ফেলবে। আসলে বিজ্ঞান কিন্তু উল্টো কথা বলে। প্রাণিবিজ্ঞানে Adaptation (অভিযোজন) বলে একটা কথা আছে। প্রকৃতি নিজেও প্রতিনিয়ত অভিযোজন করে চলেছে। যেমন আমরা দেখি বরফের উপর দিয়ে পেঙ্গুইন হেলে দুলে হেঁটে বেড়ায়। ঐ তাপমাত্রায় পেঙ্গুইনের রক্ত জমাট বেঁধে মারা যাবার কথা। কিন্তু মরে না। কেন? কারণ ঐ পরিবেশে পেঙ্গুইন অভ্যস্ত হতে পেরেছে। পেঙ্গুইনের চামড়ার নিচে খুব পুরু চর্বির স্তর থাকে যা ভেদ করে ঠাণ্ডা তাদের রক্তনালী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না বলে তারা মরে না। এমন অনেক পশু পাখি আছে যাদের লোম তাদের রক্ষা করে ঠাণ্ডা থেকে। ঠাণ্ডা আবহাওয়ার দেশের অনেক পশু পাখি আমাদের দেশে এনে অনেকদিন ধরে রাখলে তারা এই পরিবেশের সাথেও খাপ খাইয়ে নেবে। বাজারে অনেক ধরনের মুরগী, সবজি, ধান, ইত্যাদি এভাবেই অভিযোজন করে আমাদের আবহাওয়ার বাঁচার উপযোগী করা হয়েছে। আবহাওয়ার ভিন্নতা থাকলেও রাজশাহীর মতো আম, লিচু কিন্তু এখন সাতক্ষীরাতেও হচ্ছে, এই দেশে কমলা লেবু হচ্ছে, ড্রাগন ফল হচ্ছে, হচ্ছে আর অনেক ফল, বিদেশী সবজি। স্বাদে বা আকারে একটু কমবেশি হতে পারে, হয়ও, কিন্তু এখানে চাষ করা যায়। তাহলে সহনশীল মাত্রার দূষণ নিয়ে সুন্দরবনের সন্দরীরা টিকবে না কেন? তাহলে কী বিজ্ঞান মিথ্যা?
কিছু পরিবেশবাদী আংশিক সত্য প্রকাশ করে বলেছেন ভারত রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের মোট বিনিয়োগের ১৫% টাকা দিয়ে ৫০% অংশীদার হচ্ছে। আসলে প্রকল্পের ১০০% মূলধনের ১৫% দেবে বাংলাদেশী আর ১৫% দেবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। বাকী ৭০% দেবে ব্যাংক। বাৎসরিক ২% সুদে এই ব্যাংক ঋণ শোধ করবে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মানে বাংলাদেশী আর ভারতীয় প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ঋণ শোধ করবে। কারণ দুই কোম্পানিই আধাআধি মালিক। উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে যে লাভ হবে তা দুই কোম্পানিই সমান হারে ভাগ পাবে।
এবার আসি জমি প্রসঙ্গে। নতুন প্রযুক্তির একজন বিশেষজ্ঞের মাসিক ভাতা বা বেতন কত তা যারা জানেন না তারা অনুমান করতে পারবেন না। সেই গল্পের মতো হয়তো ভাববেন ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজে লোহা লেগেছে কম করে হলেও ১ মণ, আর নগদ টাকা ১০০ তো হবেই’। রামপালে জমির যে দাম তাতে বিদেশী বিশেষজ্ঞ আর নতুন প্রযুক্তির মূল্য হিসেবে ধরলে আমাদের লস নেই, বরং লাভে আছি। নতুন প্রযুক্তির মূল্য সবসময় বেশি হয়। যেহেতু এই পদ্ধতিতে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশ দূষণ খুব কম হবে তাই এর মূল্যও বেশি। আমাদের দেশে যখন মোবাইল ফোন এলো তখন সিটিসেলের (সাবেক হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড) প্রতি কলের আউটগোয়িং ছিল ১২ টাকা আর ইনকামিং ছিল ১০ টাকা প্রতি মিনিট। প্রতিটি মটরোলা আল্ট্রা স্লিক সেটের দাম ছিল ১,২৫,০০০ টাকা। কিন্তু কল রেট আর সেটের দাম এখন কত? হিসাব করে দেখেন।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত ‘ঢাকার স্কুলশিশুদের মধ্যে বায়ুদূষণের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণায় এ ভয়াবহ তথ্য ঘোষণা করা হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীর তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণীর ১৮০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৪২ দিন গবেষণা করে ১২০ জনকেই অ্যাজমায় আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঢাকার আশে পাশে ২৫০০ ইটভাটা চালু রয়েছে। যার প্রায় সবগুলোতেই কয়লা দিয়ে ইট পড়ানো হয়। জার্মান বেতার ডয়েচ ভ্যালীর খবরে বলা হছে যে, প্রায়ই ঢাকা শহরের উপরে ভেসে বেড়ায় কুয়াশা ও ধোঁয়ার মিশ্রণ বা স্মগ। আর শুধু বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর মারা যায় শহরটির (ঢাকা) ১৫ হাজার মানুষ। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন মারা যায় ৪১ জন। এর কারণগুলোর মধ্যে আছে অনেক কিছু। ইটভাটার কালো ধোয়া, শিল্পের বর্জ্য, শব্দ দূষণ ইত্যাদি। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের শীর্ষে রয়েছে ভারতের মুম্বাই। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিশরের রাজধানী কায়রো। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। তাই আসুন সবার আগে ঢাকাকে, বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাই, নিজেরা ছেলে মেয়ে নিয়ে সুস্থ জীবন নিয়ে বাঁচি। মিথ্যাচার বা আংশিক সত্য প্রকাশ করে বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করি।
পুরাতন একটা গল্প মনে পড়ে গেল। এক বড়লোক শিক্ষিত বাবুর খুব শখ হলো ঘোড়ার মাংস খাবার। কিন্তু ধর্ম মতে নিষেধ আছে ওটা খাবার। কী করা যায় ভেবে ভেবে ঐ জ্ঞানী দুষ্টু লোকটি হারাম হালাল নিয়ে ধর্মে কী বলা আছে তা জানতে ধর্মগ্রন্থ পড়তে শুরু করলেন। ঐ গ্রামের প্রায় সবাই অল্প শিক্ষিত বা যারা শিক্ষিত তারা ঐ জ্ঞানী দুষ্টু লোকটিকে খুবই বিশ্বাস করেন। জ্ঞানী দুষ্টু লোকটি দেখল ধর্মগ্রন্থে এক জায়গায় লেখা আছে ‘ঘোড়ার মাংস হালাল; যদি সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বাঁচাতে খাওয়া লাগে’। ব্যস আর যায় কোথায়। জ্ঞানী দুষ্টু লোকটি গ্রামের লোকদের দেকে বললেন আজ ঘোড়ার মাংস দিয়ে গণভোজ হবে।
গ্রামের লোক বললেন, এটাতো ধর্মে হারাম! জ্ঞানী দুষ্টু লোকটি ধর্মগ্রন্থ বের করে ‘ঘোড়ার মাংস হালাল’ এইটুকু পড়ে বাকিটা আর পড়লেন না। সবাই যেহেতু জ্ঞানী দুষ্টু লোকটিকে বিশ্বাস করেন, তাই তার কথা মেনে নিয়ে ভোজ সেরে নিলেন। রাতে ঐ গ্রামের এক শিক্ষিত যুবক বাড়ি ফিরলেন। তাকে রাতে ঘোড়ার মাংস খেতে দেওয়া হলো। যুবক বললো, এটা তো হারাম, কেন খাবো!
গ্রামের অনেকেই বললেন না, ধর্ম গ্রন্থে আছে ‘ঘোড়ার মাংস হালাল’। ধর্মগ্রন্থ আনা হলো, জ্ঞানী দুষ্টু লোকটির তখন হলো বিশেষ ধরণের পেট ব্যথা। যুবক ধর্মগ্রন্থ থেকে পড়ে শুনালেন, ‘ঘোড়ার মাংস হালাল; যদি সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বাঁচাতে খাওয়া লাগে’। কিন্তু এখন তো আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে নেই তাই এটা হালাল হয় কী করে? তখন বেশিরভাগ মানুষ ঐ জ্ঞানী দুষ্টু লোকটিকে ছি ছি করতে লাগলো। কিন্তু ঘোড়ার মাংস খেয়ে ফেলা কেউ কেউ বলতে শুরু করলেন, ‘হালাল’ শব্দটা ধর্ম গ্রন্থে আছে কি নেই সেটাই বড় কথা। ‘হালাল’ শব্দটা ধর্ম গ্রন্থে আছে, ওতেই চলবে। আসলে নিজের ঠকে যাওয়াকে এভাবেই অসহায় মানুষ জাস্টিফাই করেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)