হাইকোর্টের নির্দেশে মোবাইল ফোনের রাত্রিকালীন ইন্টারনেট অফার বন্ধ করাই যথেষ্ট নয়, সঠিক ব্যবহার ও সামাজিক সচেতনতাই সমাধান বলে মনে করেন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা। মোবাইল ফোনের রাত্রিকালীন ইন্টারনেট অফার বন্ধ হলে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে বসে ইউরোপ আমেরিকায় কাজ করা ফ্রিল্যান্সাররা বিপদে পড়তে পারেন বলে আশংকা প্রকাশ করছেন তারা।
বিষয়টি নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) এর মহাসচিব টিআইএম নূরুল কবীর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘ইন্টারনেট হলো গ্লোবাল প্লাটফর্ম। ইন্টারনেটে দিন-রাত বলে কিছু নেই। বাংলাদেশে যখন রাত, অন্য জায়গায় তো দিন। সারাবিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখতে এবং আমাদের উন্নয়নের জন্য সবসময় ইন্টারনেট জরুরি। কার্যত ইউরোপ আমেরিকার সাথে যোগাযোগ রাখতে রাতে ইন্টারনেটের বিকল্প আর নেই।’
রাত্রিকালীন অফার বন্ধ কোনো সমাধান নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ রাতে ইন্টারনেট প্যাকেজের সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে কোনো সমাধান হয় না। আমাদের সামাজিক এবং নৈতিক জায়গায় সবল হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহারের জন্য সামাজিক আন্দোলন দরকার। মিডিয়া, অভিভাবক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারকেও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সদ্য সাবেক সভাপতি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার একে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘ব্লু হোয়েলের ভয়ে রাত্রিকালীন ইন্টারনেট অফার বন্ধ করে দেওয়া অনেকটা মাথা ব্যথায় মাথা কেটে ফেলার মতো। কারণ, যারা এসব অনুচিত খেলা-ধুলায় আসক্ত তারা বিশেষ অফার বন্ধ করে দিলেই ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দেবে না। বরং বেশি টাকা দিয়ে নেট কিনে এসব সাইটে ঘোরাফেরা করবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি বন্ধ নয়, বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। তারা বাচ্চাদের সময় দেবে। সুস্থ বিনোদনের নানা উপায় সামনে আনবে। নইলে বাচ্চারা খেলা বন্ধ করে নেশার দিকে ঝুঁকে পড়বে।’
প্রযুক্তি বন্ধ করলেই খেলা বন্ধ হবে এমন চিন্তাকে তিনি ভিত্তিহীন বলে জানান।
বিদেশের বিভিন্ন কাজ দেশে বসে কাজ করেন ফ্রিল্যান্সার মোঃ শরিফুল ইসলাম। তিনি তার ক্লায়েন্টদের দেশের সময় অনুসারে সেবা দিয়ে থাকেন। রাতের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যারা আউটসোর্সিং করে তাদের সবসময় ইউরোপ, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্লায়েন্টদের কাজ করতে হয়। এসব দেশে যখন দিন বাংলাদেশে তখন রাত। ফলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় রাতে। না হলে কাজ পাওয়া যায় না। ঢাকা শহরে যারা আউটসোর্সিং করে তারা ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করলেও জেলা শহরের ফ্রিল্যান্সাররা মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তারা মূলত দুইটা প্যাকেজ চালায়। একটা সারা দিনের জন্য। আরেকটা রাতের সাশ্রয়ী প্যাকেজ। রাতের অফার বন্ধ করে দিলে তারা বিপদে পড়বে।’
শিশু কিশোরদের ডার্কওয়েভের সন্ধান পাওয়া সম্ভব না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ২০০৯ সাল থেকে আউটসোর্সিং করি। আমি এখনো ডার্কওয়েভের সন্ধান পাইনি। তাহলে ক্লাস এইট-নাইনে পড়া বাচ্চারা কিভাবে ডার্কওয়েভে ঢুকে ব্লু হোয়েল খেলে?’ বাংলাদেশে যারা ডার্কওয়েভ কী এটা জানে তাদের এত সময় নেই গেম খেলার বলেও মনে করেন ফ্রিল্যান্সার মোঃ শরিফুল ইসলাম।
একেএম নুরুজ্জামান নামে আরেক ফ্রিল্যান্সার মনে করেন হাইকোর্ট কর্তৃক রাত্রিকালীন নেট প্যাকেজ বন্ধ করায় ফ্রিল্যান্সিংয়ে কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি জানান, যারা ফ্রিল্যান্সিং করেন তাদের দুরন্ত গতি সম্পন্ন ইন্টারনেট লাগে। ফলে তারা সবাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে ঢাকার বাইরে থেকে যারা কাজ করে, তাদের বিষয়ে কিছু জানেন না তিনি।
রাত্রিকালীন ইন্টারনেট অফার বন্ধের সিদ্ধান্তকে সমাজ ও শিশুদের জন্য ভালো সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিসেস সালমা আক্তার।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘রাতের বেলা অপ্রয়োজনীয় সাইটগুলোতেই বেশি ঢোকে আমাদের বাচ্চারা। এছাড়া সাশ্রয়ী বলে দীর্ঘরাত নেটে থাকার ফলে ক্লাসে অমনোযোগী ও পড়াশুনায় আগ্রহ হারাচ্ছে তারা। সামাজিক মাধ্যমগুলো বেশি আকৃষ্ট হবার ফলে প্রকৃত আত্মীয়দের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে।’
তবে শুধু ইন্টারনেট বন্ধই সমাধান নয় বলে মনে করেন তিনি। সামাজিক সচেতনতার বিকল্প কিছু নেই। শিশুদের বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রে সৃষ্টি, সমাজ পরিবারসহ সর্বক্ষেত্রে সচেতনতা জরুরি বলে জানান সালমা আক্তার।
আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া ব্লু হোয়েল গেমসহ এ জাতীয় সকল অনলাইন গেম বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী রোববার একটি রিট করেছিলেন। ওই রিট আবেদনে মোবাইল অপারেটরদের রাত্রিকালীন বিশেষ ইন্টারনেট অফার বন্ধেরও নির্দেশনা চাওয়া হলে হাইকোর্ট ৬ মাসের জন্য অফার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।