স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বড় সাফল্য। হাজার বছরের সংগ্রাম ও স্বপ্নের এই সফল বাস্তবায়ন হয় ১৯৭১ সালে। বাংলার এ স্বাধীনতার জন্য বাঙালিকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। সুপ্রাচীনকাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক অবস্থানজনিত কারণে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এখানকার জীবনযাত্রা সমতল এলাকার তুলনায় কঠিন ছিলো, বিধায় অতীতে খুব বেশি সংখ্যক লোকজন এই এলাকায় বাস করতে উৎসাহী হয়নি। বর্তমানে যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আছেন তারা ইদানীং নিজেদের আদিবাসী বলে দাবি করেন। আর দেশের কিছু মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীরা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন না করে, জেনে অথবা না জেনে বিভিন্ন সময়ে এই শব্দের প্রতিধ্বনি করে যাচ্ছে।
আদিবাসী হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার এ্যাবোরেজিনিয়াস, নেটিভ আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ান, ফ্রান্স ও স্পেনের বাসকু, দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা ও মায়া, জাপানের আইনু, আরব বেদুইন সম্প্রদায় ইত্যাদি যারা সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডে আদিকাল থেকে বসবাস করে আসছে।
কিন্তু বাংলাদেশের এক-দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় (১৩,২৯৫ বর্গ কি.মি. / ৫,১৩৩ বর্গমাইল) যে মাত্র এক শতাংশ জনসংখ্যা (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১৫,৯৮,২৯১ জন) বাস করছে তার ৪৭% বাঙালি, ২৬% চাকমা, ১২% মারমা এবং ১৫% অন্যান্য পাহাড়ী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যারা সিনলুন, চীন, আরাকান, ত্রিপুরা, বার্মা এবং অন্যান্য এলাকা থেকে আনুমানিক মাত্র তিনশ’ থেকে পাঁচশ’ বছর পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে আবাস স্থাপন করেছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় প্রথম আসে কুকীরা। পরবর্তীতে ত্রিপুরারা এবং ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে আসে আরাকানি গোত্রভুক্ত চাকমা ও মার্মা সম্প্রদায়। অথচ এদেশে বাঙালি বা তাদের পূর্বপুরুষরা বসবাস করতে শুরু করেছে প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে।
কাজেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী হবার দাবির প্রশ্নটি এখানে অবান্তর এবং আবাসপত্তনের সময় হিসেব করলে বাঙালিরাই বাংলাদেশের আদিবাসী। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অবাঙালিরা এদেশের সংবিধানের স্বীকৃতি অনুযায়ী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বঃ ৭১ এর মার্চ মাসে রাঙ্গামাটি জেলা সদরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজের তৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান এবং সুনীল কান্তি দে এর নেতৃত্বে। অনুরূপভাবে ১৬ মার্চ রামগড় মহকুমার কাজী রুহুল আমিনকে আহ্বায়ক এবং সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরাকে যুগ্ম সম্পাদক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
খাগড়াছড়িতে দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সংগে যোগাযোগ রেখে দেশের চলমান রাজনৈতিক ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন, রাজপথে মিছিল- শ্লোগান, আন্দোলন, প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াই এসব সংগ্রাম পরিষদের উদ্দেশ্য ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে জেলা প্রশাসক ছিলেন এইচ টি ইমাম। পাকবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে শহীদ হন মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, রামগড় ও খাগড়াছড়ি এসব এলাকায় প্রতিরোধ যুদ্ধ হতে শুরুর দিকে সক্রিয়ভাবে প্রাণপণ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল অনেকে। ২৭ মার্চ বর্তমান রাঙামাটি স্টেশন ক্লাবের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়।
তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম) স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাতির মুক্তি আন্দোলনে শরীক হন। রাঙামাটিতে ওই ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপনে জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার বজলুর রহমান এবং মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী এবং রাঙামাটির অগণিত স্বাধীনতাপ্রেমি মানুষ এগিয়ে এলেন প্রাণঢালা অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে।
রাঙামাটি স্টেশন ক্লাবের মাঠে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম ২ এপ্রিল রাঙামাটি থেকে রামগড় মহকুমা সদরে আসেন। তিনি সঙ্গে প্রচুর অর্থ নিয়ে আসেন, ঐ অর্থ অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের হাতে তুলে দেন। রামগড় মহকুমাতে তিনি অস্থায়ী বাংলাদেশ-এর অধীনে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
পরবর্তীতে তিনি রামগড় সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমাতে চলে যান। সেখান থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় রাঙামাটিতে এসে পুলিশ, আনসার ও ই পি আর বাহিনীর সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা নেন। তার নির্দেশেই এডিসি সামাদ বরকল সীমান্ত পার হয়ে ভারতের দেমাগ্রিতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন।
তাদের অনুপস্থিতিতে মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী রাঙামাটিতে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী ভারতের উদ্দেশ্যে রাঙামাটি ত্যাগের সময় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তার নামানুসারে রাঙামাটির কায়েদে আজম মেমোরিয়াল একাডেমীর নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ আবদুল আলী একাডেমী’ নামকরণ করা হয়।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায় শহীদ আবদুল আলীর স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যোদ্ধাদের মাঝে মানকছড়ির রাজা মং রাজা মংপ্রু চেইন, উপেন্দ্র চাকমা, লংগদুর অনিল চাকমা ও রাঙামাটির জেলা প্রশাসক প্রথম দিকে বিভিন্ন অপারেশনে যোদ্ধাদের পাঠাতেন। যুদ্ধের নয় মাসঃ ২৯ মার্চ রাঙ্গামাটি হতে ছাত্র-যুবকের ৬০ জনের একটি দল ভারতে রওনা হয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য।
ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় কর্মরত ইপিআর এর বাঙালী অফিসার ও জোয়ানরা এলেন রাঙ্গামাটিতে। তারা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে। তাদের জন্য রসদ সরবরাহ, যানবাহনের ব্যবস্থাপনার জন্য রাঙ্গামাটি আলম ডকইয়ার্ডে গড়ে উঠল মুক্তি বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। এখানে স্থাপন করা হল ওয়ারলেস সেন্টার।
এখান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা এবং চট্টগ্রামে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হত ওয়ারলেসের মাধ্যমে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করা হতো এই ডকইয়ার্ডেই। রাঙ্গামাটির নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্র নেতারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে এলেন- শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কালুরঘাটে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ সরবরাহ করা হল রাঙ্গামাটি থেকে।
রাঙ্গামাটিবাসীরা উদার হস্তে এগিয়ে এলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে। কালুরঘাটে সম্মুখযুদ্ধঃ অতঃপর মুক্তিযোদ্ধারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০ এপ্রিল মেজর শওকত তার বাহিনী নিয়ে কালুরঘাটে অবস্থান করছিলেন। ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র-জনতা মিলিয়ে তার সৈন্যসংখ্যা ছিল ৪৫০ জন। দুটো হানাদার ব্রিগেড দ্বারা আক্রান্ত হন তারা।
পাকিস্তানিরা কর্ণফুলীতে অবস্থানরত তাদের নৌ-জাহাজকে শঙ্খ নদী দিয়ে কালুরঘাটের কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং মুক্তিবাহিনীর ওপর নেভাল গানের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। গোলাবর্ষণ চলে ব্রিগেড আর্টিলারি থেকেও। এসময় খবর এলো পটিয়ার কালারপুলের দিক থেকেও পাকবাহিনী এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
মেজর শওকত কিছু সৈন্য দিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জমানকে পাঠালেন কালারপুলের দিকে। ১১ এপ্রিল শওকত তার বাহিনীসহ অগ্রসর হলেন কালারপুলের পরিস্থিতি জানতে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ক্যাপ্টেন অলি মারফত খবর এলো প্রায় ৭-৮শ সৈন্য কালুরঘাট আক্রমণ করেছে।
শত্রুদের কিছু সৈন্য মহিলা সেজে (বোরকা পরে) এবং কিছু সিভিল পোশাকে জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ব্রিজের দিকে। সেখানে তখন ছিলেন ক্যাপ্টেন হারুন, লে. শমসের মবিন, লে. মাহফুজসহ কিছু অফিসার। তারা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেন নি ব্যাপারটা। কিন্তু শত্রু যখন ‘জয়বাংলা’ বলতে বলতে ব্রিজের ওপর উঠে এলো তারা বুঝলেন এরা হানাদার। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
শত্রুর গুলিতে ক্যাপ্টেন হারুন ও লে. শমসের মবিন আহত হলেন। হানাদারদের আরেকটি দল কাপ্তাই রোডে লে. মাহফুজের উপর আক্রমণ শুরু করে। মেজর শওকত সকাল ৯টার দিকে কালুরঘাট ফিরে সকলকে রিট্রিটের নির্দেশ দিলেন। আর লে. মাহফুজকে নির্দেশ দিলেন মদুনাঘাট এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখতে, যতক্ষণ না কালুরঘাটে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী নিরাপদে পেছনে সরে আসতে পারে।
পরে তারা সবাই পটিয়ায় একত্রিত হলেন। সেখান থেকে মেজর শওকত প্রথমে বান্দরবান, সেখান থেকে কাপ্তাই হয়ে রাঙামাটি যান। এবং মহালছড়িতে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। ওদিকে লে. মাহফুজ শত্রুর উপর আঘাত হেনে চলেছিলেন। কিন্তু ব্যাপক আক্রমণের মুখে কিছুটা পিছু হটে পার্শ্ববর্তী নোয়াপাড়া ও পরে পলিটেকনিকে সার্থক প্রতিরক্ষা গড়ে সাহসের সাথে মোকাবেলা করেন হানাদারদের।
পরে মেজর শওকতের নির্দেশে প্রায় ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধার দলটি নিয়ে মহালছড়িস্থ হেডকোয়ার্টারে চলে আসেন। ওই দিনই ছুটিতে থাকা ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের মহালছড়িতে আসেন।মেজর শওকত তাঁর অফিসারদের নিয়ে একটা ব্যুহ তৈরি করলেন, যা নিম্নরূপ ;
১. ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জমানের নেতৃত্বে ১০০ সৈন্য রাঙামাটি বুড়িঘাটে।
২. ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের নেতৃত্বে ১০০ সৈন্য খাগড়াছড়িতে।
৩. লে. মাহফুজের নেতৃত্বে ১০০ সৈন্য রাঙামাটির বরকলে।
৪. সুবেদার মুত্তালিবের নেতৃত্বে ১০০ সৈন্য রাঙামাটির কুতুবছড়ি এলাকায়।
১৬ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের এই চারটি দল তাদের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নেয়। ১৫ এপ্রিল চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের আহবানে পাকবাহিনী রাঙামাটি পৌঁছে। পরদিন দুরন্ত সাহসী ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের তার বাহিনী নিয়ে খাগড়াছড়ি রেস্টহাউজে অবস্থানরত এক প্লাটুন বাহিনীকে আক্রমণ করেন।
এতে হানাদারদের কমান্ডিং অফিসার সহ ২০ জন পাকসেনা নিহত হয়। বাকিরা পালিয়ে যায়। কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আফতাব ফিরে আসেন হেডকোয়ার্টারে। প্রায় ২০ জন পাকসেনার একটি দল ১৭ এপ্রিল লঞ্চযোগে রেকি করতে বেরিয়েছিল। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জমান তার দল নিয়ে ওঁৎ পেতে ছিলেন। লঞ্চটি তাদের গুলির আওতায় আসামাত্র অ্যাম্বুশ করলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
আক্রমণে লঞ্চটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং অধিকাংশ পাকসেনা নিহত হয়। পালাতে সক্ষম হয় কয়েকজন। এই সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আহত হয় দুজন। ১৮ এপ্রিল ৭১ দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিড বোট বোঝাই শত্রুসেনা চেঙ্গী নদী দিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর কয়েক সদস্য নির্দেশ ছাড়াই হঠাৎ গুলি ছুঁড়ে বসে।
পাকসেনারা সামান্য ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে যায়, তারপর ডিফেন্স নিয়ে ক্যাপ্টেন মাহফুজের বাহিনীর উপর আর্টিলারির আঘাত হানতে থাকে। শত্রুর প্রবল তোপের মুখে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ওই দিন বিকেল ৩টায় সুবেদার মুত্তালিব কুতুবছড়িতে শত্রুদের ৬টি সৈন্য ভর্তি ট্রাক অ্যাম্বুশ করেন।
এতে ৪০ জন পাকসেনা নিহত হয় ও তিনটি ট্রাক ধ্বংস হয়ে যায়। বুড়িঘাটে বাংলার প্রথম শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ আবদুর রউফ ১৯ এপ্রিল বুড়িঘাটে শত্রুবাহিনীর বড় একটি দল মর্টার সহযোগে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জমানের বাহিনীর উপর প্রবল আক্রমণ চালায়।
প্রচণ্ড তোপের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। এমনি সময় অষ্টম বেঙ্গলের বঙ্গশার্দুল ল্যান্সনায়েক মুন্সি আবদুর রউফ মেশিনগান হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, স্যার আমি কাভারিং ফায়ার দিচ্ছি। আপনি বাকিদের নিয়ে রিট্রিট করুন। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জমান তার বাহিনীর প্রায় ১০০ যোদ্ধা নিয়ে নিরাপদে পিছিয়ে যেতে সক্ষম হন।
কিন্তু ল্যান্সনায়েক আবদুর রউফ হটলেন না জায়গা থেকে। এক পর্যায়ে হানাদারদের মর্টারের আঘাতে শহীদ হন বাংলার প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ। সত্যি, এঁরাই বাংলা মায়ের বীর সন্তান, এঁদের রক্তেই মুক্ত এদেশ।
পার্বত্য জনপদে সম্মুখযুদ্ধঃ ২১ এপ্রিল ৭১ পাকবাহিনীর একটি কোম্পানি বন্দুকভাঙ্গা নামক স্থানে লে. মাহফুজের দলের উপর হামলা করে। সংঘর্ষে হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনীর কোন ক্ষতি হয়নি।
২৩ এপ্রিল হানাদারদের প্রায় ২০০ সৈন্য রাঙামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে খবর এল। মহালছড়ি তখন মেজর শওকতের ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার। তিনি কিছু সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন মাহফুজ ও ক্যাপ্টেন কাদেরকে এগিয়ে গিয়ে শত্রুদের প্রতিরোধ করার নির্দেশ দিলেন। ২৪ এপ্রিল কুতুবছড়িতে দুই দলে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে হানাদাররা বেশ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পালিয়ে যায়।
২৫ এপ্রিল খবর এল পাকবাহিনী চেঙ্গী নদী ও বানিয়ারচর বাজার হয়ে মহালছড়ি অভিমুখে এগিয়ে আসছে। ২৬ এপ্রিল মেজর শওকত অন্য অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। তিনি লে. মাহফুজকে তার বাহিনী নিয়ে কিছুটা পিছিয়ে রিজার্ভে থাকার নির্দেশ দিলেন। ক্যাপ্টেন জামান তার বাহিনী নিয়ে বানিয়ারচর বড় বাজার পাহাড়ের উপর ডিফেন্স নিলেন।
ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের গেলেন সড়কপথে হানাদারদের গতিরোধ করার জন্য। ২৭ এপ্রিল ভোর বেলা হাবিলদার তাহের, সিপাহী বারী ও কর্পোরাল করিম ১০ জন লোক নিয়ে গেলেন রেকি করতে। তারা ভুল করে মিজোদের এলাকায় ঢুকে পড়েন। প্রসঙ্গত মিজো উপজাতিরা পাকবাহিনীর সঙ্গে আগেই হাত মিলিয়েছিল। সৌভাগ্যবশত মিজোরা একটি হাতি মেরে খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল, তাই রেকি পেট্রোল পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
ওইদিন বেলা সাড়ে বারোটায় মিজোরা ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জমানের অবস্থানের উপর হামলা চালায়। তারা ছিল সংখ্যায় অনেক। এ সময় লে. মাহফুজ মাত্র ১০ জন সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন জামানের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। মাহফুজ ওখানে পৌঁছেই শত্রুদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন জামান গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় সঙ্গীদের নিয়ে পিছিয়ে আসেন অন্যপথে। আর মাহফুজের দলের সঙ্গে আধঘন্টা গুলি বিনিময়ে নিহত হয় ১৫০ জন মিজো। কিন্তু তাতেও পিছু হটল না তারা।
এগিয়ে আসতে থাকল ঢেউয়ের মতো। তারা ঘিরে ফেলল ক্যাপ্টেন মাহফুজ ও তার বাহিনীকে। খবর পেয়ে উদ্ধারে এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ও ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জমান। নিরাপদে ফিরে আসে মুক্তিবাহিনী। ২৭ এপ্রিল দুপুর ৩টায় হানাদার বাহিনীর ১৩টি কোম্পানি সহযোগে প্রায় ১১০০ মিজো মহালছড়ি হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে।
পাকবাহিনীও ৬টি মর্টার সহযোগে আক্রমণ শুরু করে। মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জমান, ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ও ফারুককে এলাকা ভাগ করে দিয়ে নিজে হেডকোয়ার্টার রক্ষার দায়িত্ব নিলেন। ঐদিনই মহালছড়িতে মুখোমুখি হলো হানাদার পাকসেনাদের সাথে মুক্তিসেনারা। তিন ঘন্টা প্রচণ্ড যুদ্ধে পাকসেনারা পর্যুদস্তপ্রায়। ক্যাপ্টেন কাদের সাহসের সাথে তার বাহিনী নিয়ে এ্যাডভান্স করে পাকসেনাদের চারটি এলএমজির ফায়ারিং স্তব্ধ করে দেন।
হানাদারদের রেজিস্টেন্স ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। মহালছড়ির রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিজয় মুক্তিসেনাদের করায়ত্ত প্রায়। কিন্তু ভাগ্য সেদিন অনুকূলে ছিল না। ইতিমধ্যে চার ট্রাক পাকসেনা রিইনফোর্সমেন্ট হয়ে গেল। অপরদিকে পাক মদদপুষ্ট মিজোরা আক্রমণ করলো তাদের উপর। যুদ্ধের গতি গেল উল্টে। চারগুণেরও বেশি শক্তি নিয়ে পাকসেনারা যে প্রেসার সৃষ্টি করলো, তার মোকাবেলায় ফুলের পাঁপড়ির মতো ঝরে পড়তে লাগল তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা।
অভিজ্ঞ সমরনায়কের মতো ক্যাপ্টেন কাদের শত্রুর মুখে নিজেকে এনকাউন্টারে রেখে, তার ছোট কলামটাকে রিট্রিট করার ব্যবস্থা করে দেন। বাম হাতে গুলি লাগা সত্ত্বেও তিনি এক ইঞ্চিও পিছু হটেন নি, বাংকার ছাড়েন নি। হাতিয়ারের শেষ বুলেটটি পর্যন্ত স্থিরচিত্তে নিশ্চিত নিশানে, শত্রুবক্ষে নিক্ষেপ করেছেন। বুলেট ফুরিয়ে গেল এক সময়, তবুও তিনি ফুরান নি।
শেষ পর্যন্ত ছয়-সাতটা হ্যান্ডগ্রেনেড নিয়ে, বাংকার থেকে বেরিয়ে আসেন সেই বীর মুক্তিসেনানি। ওদের অবিরাম ফায়ারিং-এর মধ্যে উল্কার বেগে ছুটে যান সম্মুখপানে। সেই নিশ্চিত মৃত্যুর মুহূর্তে নির্ভুল গ্রেনেড ছুঁড়ে তিনি স্তব্ধ করে দেন চারটি শত্রুর বাংকার। ২৭ এপ্রিল মহালছড়ির পাক হানাদাররা পর্যন্ত বিমূঢ় হয়ে পড়ে বাঙালি তরুণের মৃত্যুপণ সম্মুখযাত্রার সেই দুঃসাহসিকতায়।
পঞ্চম গ্রেনেডের পিন দাঁত দিয়ে চিরে তাক করে ছুটে যান তিনি আরেকটি শত্রুর বাংকারের দিকে। ছুঁড়ে দেয়ার সুযোগের অপেক্ষা মাত্র, শত্রুর গুলি বিদীর্ণ করে যায় সেই মহান বীরের বুক। মহালছড়ির বুকে বুক রেখে, সেই জাতীয় বীর দেহের সমস্ত তপ্ত রক্ত নিঃশেষে ঢেলে দিয়ে যান জন্মভূমির মুক্তির জন্য। গুলি বৃষ্টির মধ্যেই শওকত, ফারুক ও সিপাহি ড্রাইভার আব্বাস ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের মৃতদেহ গাড়িতে করে রামগড় ফিরে এলেন।
মুক্তিবাহিনী সন্ধ্যা পর্যন্ত পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রেখে রাতের আঁধারে মহালছড়ি ত্যাগ করে। তারা ডিফেন্স নেয় খাগড়াছড়িতে। রামগড় পোস্ট অফিসে মেজর জিয়া ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুর ঘাটস্থ চট্টগ্রাম বেতারে ঘোষণা দিলেন। ৩০ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যখন পাকিস্তানি স্যাবর জেট আক্রমণ করে বাঙালি সৈন্য ও সম্পদ ধ্বংস করল তখন সেখান থেকে মেজর জিয়া জীপগাড়ি যোগে নাজিরহাট হয়ে সোজা রামগড়ে চলে গেলেন।
অথচ তখন কালুরঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে বাঙালি বাহিনীর একটা তুমুল যুদ্ধ অত্যাসন্ন। সেই আসন্ন ভয়াবহতম যুদ্ধকে এড়িয়ে মেজর জিয়া তার সতীর্থদেরকে পেছনে ফেলে এপ্রিলের শুরুতেই রামগড়ের মত নিরাপদ স্থানে আশ্রয়গ্রহণ করলেন। রামগড় পোস্ট অফিসের দ্বিতীয় তলা ছিল মেজর জিয়ার আবাসস্থল। এখানেই তিনি মূলদল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় এক মাস অবস্থানকালে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করার প্রচেষ্টা চালান।
কর্ণেল অলি আহমদ জীবনের শেষ নেই গ্রন্থে লিখেছেন তিনি ২ মে এখানে এসেই মেজর জিয়ার সাথে দেখা করেছিলেন। কিন্তু পাকবাহিনী রামগড়ের দিকে এগিয়ে আসার খবর পেয়ে অবশেষে ৪ মে মেজর জিয়া রামগড় ত্যাগ করে নিরাপদে ভারতে চলে যান। রামগড়ে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধ ও মেজর শওকত ২৮ এপ্রিল হানাদারদের একটি দল গুইমারা হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
মেজর শওকত গুইমারাতে তার বাহিনী নিয়ে ডিফেন্স নিলেন। তখন তার সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৪৫০ জন। শওকত মানিকছড়ির মং রাজা মংপ্রু সেইনের সাথে দেখা করলেন। রাজা মুক্তিবাহিনীদের সহযোগিতার অঙ্গীকার করলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ৯ মাস মং রাজার অনুসারী মগ উপজাতি সর্বতোভাবে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছে। রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য চাকমারা মুক্তিবাহিনীর বিপক্ষ নেয়। আর মিজোরাতো আগেই হানাদারদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।
২৯ এপ্রিল মেজর শওকত তার বাহিনী নিয়ে রামগড় পৌঁছেন রাত দুটোর দিকে। ৩০ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী রামগড় আসেন। তিনি মেজর শওকতকে আরো দুদিন রামগড় মুক্ত রাখার নির্দেশ দেন যাতে নিরীহ জনসাধারণসহ সবাই নিরাপদে ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য মেজর শওকত ৩০ এপ্রিল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জমান, সুবেদার মুত্তালিব, লে. মাহফুজ ও অলিকে হিয়াকুলে যোগদানের নির্দেশ দিলেন।
পাকবাহিনী রামগড় দখল করার জন্য ত্রিমুখি আক্রমণ পরিচালনা করে। তৎকালীন সময়ে করেরহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার সরাসরি পাকা রাস্তা বিদ্যমান ছিল। চট্টগ্রামের করেরহাট হয়ে রামগড় দখল করতে পাকবাহিনীর ৭ দিন সময় লেগে যায়। পাকবাহিনী এ সড়কে সাঁজোয়া বহর ও ট্যাংক ব্যবহার করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল বাধার সম্মুখিন হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধে এই সড়কের মাঝখানের সেতুটি উড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে পাকবাহিনী রামগড় পুলিশ স্টেশন, হাসপাতাল, রামগড় বাজার ও সীমান্ত এলাকার সব ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে রামগড় দখল করে নেয়। তারা রামগড় দখল করার পর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠে এবং রামগড় হতে ভারতের পথে চলাচলের সুবিধার্থে নির্মিত ব্রীজটি ভেঙে দেয়।
এই সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে হানাদারদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনীর একটি ব্রিগেড তিনদিক থেকে রামগড় আক্রমণ করে। মেজর শওকত কর্নেল ওসমানীর নির্দেশমতো দুইদিন রামগড় মুক্ত রেখেছিলেন। ২ মে রামগড় মুক্তিবাহিনীর হাতছাড়া হয়। ওইদিন সন্ধ্যা ৭টায় মেজর শওকত তার বাহিনী নিয়ে ভারতের সাবরুমে চলে যান।
পাকবাহিনী ২৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ি ও ৪ মে রামগড় মহকুমা সদর এলাকা ও পার্বত্য জেলা সদর রাঙামাটি দখল করার পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে ঘাঁটি স্থাপন করে। তারা বিভিন্ন এলাকায় শান্তি কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় রাজাকার বাহিনী ও হিলরাজ বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতাপ্রেমিদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে বর্বর অত্যাচার চালায় ও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়।
পাকবাহিনী রামগড়, গুইমারা, মানিকছড়িসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে পাহাড়ি রমণীদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে অমানুষিকভাবে ধর্ষণ করে এবং ক্যাম্পে উলঙ্গ অবস্থায় বন্দী করে রাখে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই রাঙামাটিতে পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন একদল মুক্তিযোদ্ধা। ২৯ মার্চ রাঙামাটির ৬০ জন ছাত্র-যুবকের একটি দল প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে রওয়ানা হয়।
ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় কর্মরত ইপিআর এবং বাঙালি অফিসার ও জোয়ানরা সমবেত হলেন রাঙামাটিতে। তারা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। তাদের জন্য রসদ সরবরাহ ও যানবাহনের ব্যবস্থাপনার জন্য রাঙামাটিতে গড়ে উঠল আলম ডকইয়ার্ডেই মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প।
এখান থেকে ওয়ারলেস যোগে বিভিন্নস্থানে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। উল্লেখ্য যে, ভারতে যাওয়া প্রথম মুক্তিযোদ্ধা দলটি মাত্র একসপ্তাহের ট্রেনিং শেষে ক্যাপ্টেন আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে ১০ এপ্রিল রামগড় সীমান্ত দিয়ে ফিরে আসে। সেখানে ৪ দিন অবস্থানের পর তারা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ১৫ এপ্রিল মহালছড়ি হয়ে রাঙামাটির দিকে এগিয়ে আসে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালালখ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার বিশ্বাসঘাতকতায় ঐ দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙামাটিস্থ জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসহ ধরে ফেলে।
এই দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাঙামাটির আবদুল শুক্কুর, এস এম কামাল, শফিকুর রহমান, ইফতেখার, ইলিয়াস, আবদুল বারী, মো. মামুন ও আবুল কালাম আজাদ। ধৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র আবুল কালাম আজাদ ও ফুড ইন্সপেক্টর আবদুল বারী ছাড়া অন্যদের পাকবাহিনী নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে মানিকছড়িতে নিয়ে হত্যা করে। কালাম নৌকা চালকের ভূমিকায় অভিনয় করে পাকসেনাদের ফাঁকি দিয়ে কোনমতে প্রাণে বেঁচে যান। মুক্তিবাহিনীর অপর দু’টি দলের মধ্যে একটি দল আলম ডকইয়ার্ডে উঠে। অপর দলটি পাকবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে রাঙামাটি হ্রদে অবস্থান গ্রহণ করে। পরে সেখান থেকে চলে যায় বাকছড়িতে। পরদিন তারা বাকছড়ির অবস্থান থেকে টহলরত পাকবাহিনীর উপর হামলা চালায়।
কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা ও তার গ্রুপ ১নং সেক্টরের আওতায় ৫ মে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের দল গঠন করা হয়। এই দল গঠনে নেতৃত্ব দেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। এটি পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা এই কোম্পানির কমান্ডার নিয়োজিত হন।
কোম্পানির অধীনে গ্রুপ নং ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪, এবং ৯৫ সংযুক্ত করা হয়। উক্ত গ্রুপগুলোর ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল ভারতের ‘অম্বিনগর’ এবং ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার ‘হরিণা’। ১নং সেক্টরের অধীনে হরিণা থেকে ৩০ কি.মি. দূরবর্তী সীমান্ত এলাকা ভারতের বৈষ্ণবপুরে সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়। সেখানে অবস্থানরত গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করেন।
এই গ্রুপটি পার্বত্য অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের সুবিধার্থে খাগড়াছড়ির নাকাপা, কুমারীপাড়া, পাগলাপাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যোগাছলা ও গাড়িটানা এলাকার গভীর অরণ্যে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প বা আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করত। এই সমস্ত গোপন গেরিলা ক্যাম্পে ঐ এলাকার হেডম্যান, কার্বারিসহ সকল স্তরের মানুষ খাদ্যশস্য সরবরাহ করত এবং পাকবাহিনীর গতিবিধি এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করত।
১৩ আগস্ট বৈষ্ণবপুর বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ রামগড়ে অবস্থানরত পাক ক্যাম্প আক্রমণ করে। এই অপারেশনে হেমদা গ্রুপও অংশগ্রহণ করে। সেপ্টেম্বরে মানিকছড়ি, অক্টোবরে যোগাছলাতে এ গ্রুপটি পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। নভেম্বরে মানিকছড়িতে পাকবাহিনীর একটি আক্রমণকে সফলতার সাথে মোকাবেলা করে। এছাড়া পার্বত্য এলাকা দিয়ে হাজার হাজার গেরিলার আশ্রয়স্থল ঠিক করতে, পথ দেখাতে, আশ্রয়স্থল পাহারা দিতে হেমদা গ্রুপ নিরলস কাজ করে।রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়িতে অবস্থিত ফারুয়া ও সুখছড়ির মোহনায় পাকবাহিনীর ছিল শক্ত ঘাঁটি।
সেখানে পাঞ্জাবি, রাজাকার, আলবদরসহ ২৫০ জন সৈন্য অবস্থান করত। তাদের ব্যবহারের জন্য ছিল কয়েকটি স্টিমার ও গানবোট। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পাইলট মান্নানসহ মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাহাড়ি এলাকায় পথ হারিয়ে রাতের অন্ধকারে পাকবাহিনীর ফারুয়া ক্যাম্পের অভ্যন্তরে এসে পড়ে। ঐ সময় কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধা পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নৃশংসভাবে শহীদ হন।
এই ঘাঁটিতে সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারাও এমনই একবার আক্রান্ত হয়েছিল। সুবেদার টি আলী এখানেই শহীদ হয়েছিলেন। এই যুদ্ধে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী ও চন্দনাইশের আবু ইসলাম আহত হন। পরবর্তীতে মিত্র-মুক্তিবাহিনী ফারুয়া ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে বিনা রক্তপাতে দখল করে নেয়। সেখানে অবস্থানরত রাজাকার, আলবদররা সাদা পতাকা উত্তোলন করে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পাকবাহিনীর বরকল ঘাঁটিঃ রাঙামাটি জেলার বরকলে পাকবাহিনীর সামরিক অবস্থানের উপর ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ২টি যুদ্ধবিমান বোমা বর্ষণ করে। সেখানে ৭৫০ জন পাকসেনার সুদৃঢ় অবস্থান ছিল। অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জৈলানন্দ সিং ও সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর নেতৃত্বে প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা বরকল অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে।
ঐ দিন ফারুয়ায় অবস্থানরত ছদ্মবেশী পাঞ্জাবিরা জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে টহলরত গানবোটযোগে ফারুয়া থেকে বরকলের দিকে এগোনোর সময় মুক্তিবাহিনীর মহিউদ্দিন গ্রুপের উপর আচমকা আক্রমণ করলে এখানে বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে পাঞ্জাবিরা পালিয়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ভোরবেলায় বরকলে পাকবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণ শুরু করে।
যৌথবাহিনীর রকেট লাঞ্চার ও এলএমজি থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে যেতে থাকে। সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত উভয় পক্ষের তুমুল যুদ্ধ হয়। এতে যৌথবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে। আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা রাঙামাটির উদ্দেশ্যে স্টিমারযোগে বরকল ত্যাগ করে। অন্যদিকে তাদের অনুসারী রাজাকার, আলবদর ও বেলুচ সৈন্যদের যুদ্ধরত অবস্থায় বরকলে রেখে যায়।
ফলে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। ঐ দিন সন্ধ্যার বেশ পূর্বে হানাদার বাহিনী সাদা পতাকা উত্তোলন করে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বরকলের পাকবাহিনীর ঘাঁটি এভাবে মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এই যুদ্ধে অনেক পাকবাহিনী গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। অপরদিকে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর অনেক সদস্যও শহীদ হন। এই ঘাঁটি দখলের পর মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল সুজন সিং ওভান বরকল পরিদর্শন করেন এবং রাঙামাটিতে তাঁরা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
১৭ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের অধিনায়ক সুজন সিং ওভান ও শেখ ফজলুল হক মণি ভারতীয় হেলিকপ্টারযোগে রাঙামাটির পুরাতন কোর্টবিল্ডিং মাঠে অবতরণ করেন। এখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান, আবদুর রশিদ, মো. ফিরোজ আহমদ, মনীষ দেওয়ান ও হাজার হাজার জনতা। বান্দরবান হতে যাঁরা যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন তাদের অনেকের মাঝে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সুকুমার দাশ, নিত্যরঞ্জন মল্লিক, চিত্তরঞ্জন মল্লিক, আবদুল ওহাব, ভুবন মোহন ভট্টাচার্য (শহীদ), হরিসাধন, শুক্ল দাশ, মো. শফি, সামশুল আলম, মং শিলা, মোখলেছুর রহমান প্রমুখ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রুপ কমান্ডার ও যোদ্ধাদের কয়েকজনঃ রণবিক্রম ত্রিপুরা, প্রভুধন চৌধুরী, মনীষ দেওয়ান, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, রণজিত দেববর্মণ, নীলামোহন ত্রিপুরা, আবদুর রহমান,ধীমান বড়ুয়া, সমর চক্রবর্তী, অং কিউ মারমা, ভুবন ত্রিপুরা, প্রিয় জ্যোতি রোয়াজা, কালাচান দেব বর্মণ, গমচন্দ্র ত্রিপুরা, বিজয় ত্রিপুরা, সুলতান আহমদ, আবদুস ছাত্তার, ম মং মগ, সুরেন্দ্র ত্রিপুরা, পরশুরামঘাট মৌজার হেডম্যান, পাগলাপাড়ির কার্বারি ডা. মাসুদ আহমেদ প্রমুখ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিএলএফ-অপারেশন ঈগলঃ ডিসেম্বরের দিকে বিএলএফ পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম মুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সময় চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালীর অসংখ্য বিএলএফ সদস্য রাঙামাটি হয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন। এ অপারেশনের বিবরণে জানা যায়, অপারেশনের সামরিক নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল ওবাম।
এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ও সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন বি এল এফ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মণি। এ যুদ্ধে চট্টগ্রামের বাইরে থেকে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাঁরা হলেন- ঢাকার হাশিম উদ্দিন খান পাহাড়ি, কুমিল্লার খুরশীদুল আলম পাখি, মনিরুল হক চৌধুরীসহ অনেকে। চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী (সাবেক মেয়র), নুরন্নবী চৌধুরী, রাজু (ডলফিন), সালাহউদ্দিন হারুন-এর নেতৃত্বে কয়েক হাজার বিএলএফ যোদ্ধা ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢোকেন।
হাশিম উদ্দিন পাহাড়ি’র নেতৃত্বাধীন দেড় হতে দু’শ যোদ্ধা রাঙামাটি, সালাহ উদ্দিন হারুন এর নেতৃত্বে দেড়শ’র মতো যোদ্ধা কাপ্তাই দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে আসতে থাকেন। দেমাগ্রী দিয়ে ৩ কলামে ভাগ হয়ে একটি দল নিয়ে ঢোকেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ডলফিন, নাজিম উদ্দিন আহমদ রাজু ও মিরেশ্বরাইর কবির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, এ দলে ছিলেন প্রায় ৪শ’ থেকে ৫শ’ যোদ্ধা।
এদের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। হাশিম উদ্দিন পাহাড়ি’র দলটি আসার পথে পাঞ্জাবি ও মিজো বাহিনীর যৌথ আক্রমণের শিকার হয় এবং এই যুদ্ধে ৮-১০ জন যোদ্ধা শহীদ হন ও সীতাকুণ্ডের হামিদ আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে যান। যুদ্ধে পাঞ্জাবি ও মিজোরা পিছু হটে। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, রাজু কবির, নুরন্নবী চৌধুরী ৩ কলামে ভাগ হয়ে দেশে ঢোকেন। একটি কলামের সরাসরি নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।
বিলাইছড়িতে তার দলটি পাকবাহিনী ও মিজোদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৪ ঘণ্টা যুদ্ধশেষে পাকবাহিনী পিছু হটে। এ দিনই ঢাকায় পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। অপর একটি কলামে ছিলেন নুরন্নবী চৌধুরী, কবির আহমদ চৌধুরী। এরা দু’জনই সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মিরেশ্বরাই-এ যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। রাঙাপাহাড় থেকে রওয়ানা দিয়ে এ গ্রুপটি ৭ দিন পায়ে হেঁটে মারিশ্যা পৌঁছে।
এখানে প্রশাসনিক কাজে নুরন্নবী চৌধুরী থেকে যান। কবির চৌধুরী একটি দল নিয়ে খাগড়াছড়ির বোয়ালখালী বাজারে পৌঁছেন। তাদের দেখার সাথে সাথে পাহাড়ি সম্প্রদায় দৌঁড়ে তাদের আস্তানায় চলে যায়। এ সময় যোদ্ধাদের এ দলটি মিজোদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। মিজোরা চারিদিক হতে তাদের ঘিরে ফেলে। সারারাত দলটি বাংকারে কাটায়। মিজোরা চারিদিক হতে ঘিরলেও সরাসরি আক্রমণ করে নি।
সকালে যোদ্ধারা পাহাড়িদেরকে ঘর হতে এনে তাদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে সামনে এগুতে নির্দেশ দেয়। পিছনে যোদ্ধাদের দলটি এগুতে থাকে। হঠাৎ মর্টার শেলিং শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধারা আবার বাংকারে আত্মগোপন করে। এর মধ্যেই ভারতীয় বাহিনীর ক্যাপ্টেন বাদলের নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর একটি দল এসে বিএলএফ যোদ্ধাদের সাথে মিলিত হয়।
পাল্টা মিজোবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু হয় নতুনভাবে। মিজোরা পালিয়ে যায়। উল্লেখ্য, ঐ যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। এদিনই এ গ্রুপের যোদ্ধারা জানতে পারে ৬ দিন পূর্বে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সালাহউদ্দিন হারুনের দলটি পারুয়াতে পাঞ্জাবিদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে পড়ে, এখানে ৭ জন যোদ্ধা শহীদ হন। পুরান পদুয়া বাজারে বিএলএফ-এর একটি গ্রুপের সাথে মিজোদের যুদ্ধ হয়। এখানেও বেশ কিছু যোদ্ধা শহীদ হন।
পানছড়িতে বি এল এফ-এর সাথে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুইগ্যাশ্বরা বাজারে যুদ্ধে আহত হন মৃদুল কান্তি সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে বি এল এফ ঢোকার আগেই যৌথবাহিনী চট্টগ্রাম দখল করে। ১৬ ডিসেম্বর বিএলএফ-এর পরিচালক জেনারেল ওবাম পৌঁছেন রানীর হাট, সাথে ছিলেন সুলতান আহমদ কুসুমপুরীসহ অনেকেই।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় মং রাজা মপ্রু সেইনঃ ২ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম শহর দখল করার মধ্যে দিয়ে শহর জুড়ে চালায় ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ।
ভীত-সন্ত্রস্ত নগরবাসী সবকিছু ফেলে শুধুমাত্র প্রাণে বাঁচানোর জন্য শহর ছেড়ে চট্টগ্রাম-হাটহাজারী-নাজিরহাট-ফটিকছড়ি-নারায়ণহাট-হেঁয়াকো-রামগড় হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমে গিয়ে ভারতীয় এলাকায় আশ্রয়গ্রহণ বা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করে। নরনারী শিশুসহ আবালবৃদ্ধ-বনিতার ঐ জনস্রোত মানিকছড়িতে এসে জমায়েত হতে থাকে।
ক্রমেই রাজা মপ্রু সেইনের মানিকছড়ি রাজবাড়িটি অসহায় জনতার একটি আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ সকল অসহায় মানুষের মুখে অন্তত একমুষ্টি অন্ন তুলে দেবার জন্য রাজা মপ্রু সেইন তার রান্নাভাণ্ডার খুলে দেন। রাজবাড়ির বিশাল আকারের রান্নাঘরটিতে (যা এখনও বিদ্যামান রয়েছে) বড় বড় হাঁড়িতে পাক চলতে থাকে রাতদিন ভর। রাজবাড়ির নানুমা দেবী হলঘরটি রূপ নেয় একটি হাসপাতালের।
রাজা মপ্রু সেইনের স্ত্রী রানী নিহার দেবী নিজেই ধাত্রী হিসেবে লেগে যান অসুস্থ মা-বোনদের চিকিৎসাসেবায়। গর্ভবতী মা-বোনদের গর্ভপাত নিজ হাতেই করতে লাগলেন। রানীকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে পার্বত্যবাসী অনেক মা-বোন। সে ছিল এক অপূর্ব দৃশ্য! মানবতার সেবায় এমন দৃষ্টান্ত, যা ইতিহাসে বিরল। একাত্তরের অবস্থানে নিজেকে না ফেলা পর্যন্ত এমনতর দৃশ্যের কল্পনা করাও আজ অসম্ভব।
রাজা মপ্রু সেইন রামগড় পর্যন্ত পথিমধ্যে জনবল নিয়োজিত করে সর্বস্ব দিয়ে এসকল অসহায় ও আশ্রয়প্রার্থী জনসাধারণের খাবার-দাবার ও আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা নেন। হাজার হাজার শরণার্থীর আশ্রয়, খাবার এবং চিকিৎসাদানের পাশাপাশি রাজা মপ্রু সেইন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাকে শত্রুমুক্ত রাখার লক্ষ্যে জনসাধারণকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরকে মানিকছড়ি এবং রামগড় প্রতিরক্ষার কাজেও তার নিজস্ব বিভিন্ন ধরনের ৩৩টি আগ্নেয়াস্ত্র বিতরণ করেন। এছাড়া তার নিজস্ব প্রাইভেট কার এবং জীপগুলো মুক্তিবাহিনীর কাজে নিয়োজিত করেন।
ঐ সময় মহালছড়িতে মিজোরামের দু’টি ব্যাটেলিয়ান পাকবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। রাজা মপ্রু সেইন মিজো ব্যাটেলিয়ান দু’টির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ পরিচালনার জন্য রামগড়ে গিয়ে ভারতীয় বিএসএফ অফিসারের সাহায্য কামনা করেন। ভারতীয় বিএসএফ বাহিনী রাজা মপ্রু সেইনের অনুরোধে সাড়া দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদ দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করে।
৩০ এপ্রিলে অগ্রসরমান পাকবাহিনী তিনদিক দিয়ে রামগড়কে ঘিরে ফেলে। মানিকছড়ি এবং রামগড়ের পতন ছিল তখন অত্যাসন্ন। তড়িঘড়ি করে রাজা মপ্রু সেইন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতের সাবরুমে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হন। ১ মে খুব ভোরে রাজা মপ্রু সেইন তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব দুটি গাড়িতে করে জালিয়াপাড়া হয়ে রামগড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
সেখানে গিয়ে তিনি ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে দেখা করেন। ঐদিন সকাল থেকেই রামগড় শহরের উপর শত্রুর ব্যাপক আর্টিলারির গোলা বর্ষণ চলছিল। পাকবাহিনীর কিছু গোলা ভারতীয় এলাকার সাবরুম শহরের উপরেও গিয়ে পড়ছিল। রামগড়ের পতন অত্যাসন্ন ভেবে রাজা মপ্রু সেইন প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যেই তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রামগড় সংলগ্ন নদী অতিক্রম করে সাবরুমে গিয়ে পৌঁছান।
ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরটিও তখন নিরাপদ ছিল না। কারণ মাঝে মধ্যেই পাকিস্তানিদের নিক্ষিপ্ত আর্টিলারির গোলা এই শহর ও শহরতলী এলাকায় পড়ছিল। এই সময় রাজা মপ্রু তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর জন্য স্থাপিত হরিনা ক্যাম্প সংলগ্ন রূপাইছড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। রূপাইছড়িতে স্থাপিত হয়েছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য বিশাল ক্যাম্প।
অন্যান্য শরণার্থীর মত রাজা মপ্রু সেইন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি কুঁড়েঘরে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তিনি পার্শ্ববর্তী হরিণা ক্যাম্পের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের রিক্রুটিং, সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণদান এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা পদ্ধতির ছোটখাটো অপারেশন পরিচালনার কাজে সাহায্য করতে থাকেন।
ওদিকে বিভিন্ন দেশের সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকরা রূপাইছড়ি ও হরিণা ক্যাম্পে এসে রাজা মপ্রু সেইনের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেন। আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে রাজা মপ্রু সেইন-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাৎকারদান করে রাজা মপ্রু সেইন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করার আবেদন জানান।
উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাঙামাটির চাকমা সার্কেল ও বান্দরবানের বোমাং সার্কেলের দুই রাজা তখন পাকহানাদারদের পক্ষে। এমনই সময় রাজা মপ্রু সেইনের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান ছিল পাকহানাদারদের জন্য একটি বিষকাঁটাসম। রাজা মপ্রু সেইনকে হত্যা অথবা ছিনতাই করে নেবার জন্য দখলদার বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। এ উদ্দেশ্যে তারা খাগড়াছড়ির পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানকারী মিজো বিদ্রোহীদের নিয়োজিত করে।
এ সংবাদ যথাসময়ে ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর কানে পৌঁছলে রাজা মপ্রু সেইন ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা প্রদানে আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে আগরতলায় স্থানান্তরিত করেন। এখানে অবস্থান করে মপ্রু সেইন মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। রাজা মপ্রু ছিলেন একজন চৌকস শ্যুটার। তিনি তার ঐ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান।
আগরতলা অবস্থানকালেও তিনি বিভিন্ন অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। নভেম্বর মাসের শেষদিকে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে রাজা মপ্রু সেইন মিত্র বাহিনীর সাথে প্রত্যক্ষযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মিত্রবাহিনীর সদস্যরা রাজা মপ্রু সেইনকে অনারারী কর্নেল র্যাঙ্ক প্রদান করে তাদের একটি ট্যাঙ্ক ব্যাটেলিয়নের সাথে সম্মুখযুদ্ধে পাঠান। আখাউড়া অপারেশনের পর তিনি মিত্রবাহিনীর ইউনিটের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসেন।
আশুগঞ্জ এবং ভৈরব অপারেশনে রাজা মপ্রু সেইন অংশগ্রহণ করেন। ১৭ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সাথে রাজা মপ্রু সেইন ঢাকা এসে পৌঁছান। দেশ স্বাধীনের পর তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানিকছড়ির রাজবাড়িতে চলে আসেন। সেখানে স্থানীয় অধিবসীরা তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা জানায়। উল্লেখ্য যে, রাজা মপ্রু সেইনকে ছিনতাই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে যুদ্ধ চলাকালীন পাক-দখলদার বাহিনী তার মানিকছড়ির রাজবাড়িতে তাদের আঞ্চলিক সদর দপ্তর স্থাপন করে।
দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালাল-রাজাকাররা শত বৎসরের ঐতিহ্যবাহী তার রাজবাড়ির সমস্ত সম্পদ লুটে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীনের পর রাজবাড়িতে ফিরে এসে পরিবারের সদস্যরা একবেলা আহারের জন্য একটি প্লেট বা একটি হাঁড়িও অবশিষ্ট পাননি।
বান্দরবানের মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং বীরবিক্রমঃ মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ইতিহাসের অংশীদার ইউ কে চিং। মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ খেতাবধারী পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের একমাত্র বীরবিক্রম তিনি। স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর পরও অভাব অনটনে দিন কাটছে তার।
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের শঙ্খ নদীর তীর ঘেঁষে পাহাড়ের পাদদেশে লংগীপাড়ায় এক ভাঙ্গা ও জীর্ণ-শীর্ণ ঘরে পরিবার নিয়ে বাস করছেন। তাঁর এই দুরবস্থার কথা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর নজরে আসে গতবছর বান্দরবান সেনা রিজিয়ন কর্তৃপক্ষের। বান্দরবান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের পক্ষ থেকে পার্বত্যাঞ্চলের একমাত্র বীরবিক্রম ইউ কে চিং-এর বাড়িটি ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে পুনঃনির্মাণ করে দেয়।
বাড়ির পাশেই আরো ১০ হাজার টাকার মালামাল দিয়ে একটি ছোট দোকান করার সুযোগ করে দেয়া হয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। উল্লেখ্য যে, ১৯৫২ সালে তিনি যোগদেন ইপিআর-এ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে তিনি পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ইপিআর-এর নায়েক হিসেবে রংপুর জেলার হাতিবান্ধা বিওপিতে কর্মরত ছিলেন। সেখানে এক বিহারী ও দুই পাঞ্জাবিকে হত্যা করে তিনি ৯ বাঙালি ইপিআর সৈনিককে সাথে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। তারই স্বীকৃতি হিসেবে সরকার তাকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে।
চন্দ্রঘোনায় সশস্ত্র যুদ্ধঃ চন্দ্রঘোনা রেয়ন ও পেপার মিল হতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন-এদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন, আবদুল হামিদ, হাফিজ উল্লাহ, দুলা মিয়া, নুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম, আবুল কালাম, জাহাঙ্গীর, আবদুর রব, জাফর আহমদ, সিদ্দিক আহমদ, নুরুল আলম, মোহাম্মদ ইলিয়াস, নুরুল আজিম, শাহজাহান, মোশারফ হোসেন, মনছুর আমিন, বাদশা মিয়া, আবদুল আলী, শাহাদাত হোসেন, হারিছ, ফয়েজ আহমদ, শহীদুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম বাঙালি, আনিছুর রহমান, রমজান আলী, নুরুচ্ছফা, নওয়াব আলী সরকার, শহীদুল আলম, নুরুল আলম খোকা, রুবেল আমিন, আবদুল্লা হেলালী, আবুল বশর, আবদুল খালেক, কাসেম মল্লিক, শেখ মুজিব, নুরুল হোসেন মিয়া প্রমুখ।
এদের মাঝে যুদ্ধাবস্থায় আবুল কালাম সিপাহী হতে ল্যান্সনায়েক পদে উন্নীত হন। নুরুল আলম এফ এফ সদস্য হিসেবে নোয়াখালীতে যুদ্ধে অংশ নেন। অন্যান্যরা ‘জেড ফোর্স’ এর সদস্য হিসেবে ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় শ’দুয়েক যোদ্ধাসহ মেজর টি এম আলী ও পরে সুবেদার আবু বকর সিদ্দিকী আরও শ’দুয়েক যোদ্ধাসহ এখানে আসেন এবং এরা চন্দ্রঘোনা ও রাঙ্গুনিয়ায় বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন।
সার্জেন্ট আলমও এ অঞ্চলে যুদ্ধ করেন। এছাড়া ক্যাপ্টেন করিমও এ অঞ্চলে অসংখ্য অপারেশন করেন।
অন্যান্য অপারেশনঃ ৪ এপ্রিল পুলিশ হাবিলদার মো. হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে নায়েক আবুল কাসেম, নায়েক জহির আহমদ, নায়েক ওসতরা আলী প্রমুখ মহালছড়ি থানার চাকমাপাড়া আক্রমণ করে। উল্লেখ্য যে, এই পাড়ার বাসিন্দারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানান কার্যক্রমে জড়িত ছিল।
তাদেরকে প্রতিরোধে এই অপারেশন পরিচালিত হয়। তাছাড়া এই গ্রুপ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কোন না কোন সময় অপারেশনে জড়িত থাকত। ৩ নভেম্বর রানীরহাট-রাঙামাটি রোডে একটি ব্রীজ ধ্বংসের সময় যোদ্ধারা পাকবাহিনীর আক্রমণে পড়ে। পরিমল সিকদার নামক একজনকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে গেলে যোদ্ধারা পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে ৪ জনকে হত্যা করে এবং পরিমলকে নিয়ে আসে।
গ্রুপ কমান্ডার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ ডিসেম্বর বেতবুনিয়া ও বালুখালীতে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে। এই যুদ্ধে গ্রুপ কমান্ডার নাজিম উদ্দিন ও মোহাম্মদ জাফর শহীদ হন। ১১ ডিসেম্বর মাহবুব আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে বেতবুনিয়াস্থ চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের উপর কালভার্টের উপর অতর্কিতে পাকবাহিনীর জীপের উপর গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে ঘটনাস্থলে গাড়ির চালকসহ দু’জন পাক অফিসারকে হত্যা করে। এই অপারেশনে মাহবুব আলম নিজেও আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান করে যুদ্ধ করেছে। শেষদিকে যৌথবাহিনী এসেছে এলাকাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। বিএলএফ বাহিনী রাঙামাটি দখলের জন্য তাদের পূর্বাঞ্চলীয় সব শক্তি নিয়োগ করে। তারা রাঙামাটি থাকতেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ঢাকা স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর। অথচ ২২ ডিসেম্বরও পার্বত্য এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাঃ ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং বান্দরবান থেকে এ এস প্রু চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন এবং তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ইলেকশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।
কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এই তিন জনপ্রতিনিধির কেউই মুক্তিকামী জনগণের পাশে দাঁড়াননি। ত্রিদিব রায় দেশের মুক্তিকামী জনতার পাশে না দাঁড়িয়ে যোগ দেন পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে। অন্যদিকে এ এস প্রু চৌধুরী যোগ দেন মালেক সরকারের মন্ত্রিসভায়। চাকমা রাজা হিসেবে ত্রিদিব রায় তার প্রভাবাধীন হেডম্যান-কারবারিদের ব্যবহার করে চাকমা যুবকদের দলে দলে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করেন।
তাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী জনতার বিরুদ্ধে। এ সময় ত্রিদিব রায় এবং তার রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একের পর এক হামলা পরিচালনা করে। এতে নির্মমভাবে শহীদ হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় মিয়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান।
ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত তৎকালীন রাজাকার বাহিনী এবং তাদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে একাধিক হামলা ও হত্যাকান্ড চালানো হয়েছিল। কিন্তু এ কারণে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কোন প্রকার অনুতাপ স্বীকার করা তো দূরের কথা বরং মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে ২০০৩ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থতে লিখেছেন, ‘Increasing lawlessness and violence of the rebel Bengali forces promised no safety to anyone (Page-214) In Rangamati, from 26 March onward, Awami League cadres, in league with the rebel police and tha East Pakistan Rifles, began rounding up the Biharis (Page-216) . There was a constant supply of food and firearms in commandeered trucks to the Mukti Bahini, comprising rebel EBR (East Pakistan Regiment), EPR (East Pakistan Rifles), and the police. These elements were fighting the The Army at Chittagong and elsewhere. People were forced by Awami League cadres to pay money and rice under threat of violence. Many shopkeepers had closed shop and run away. ( Page- 217)..’
একই বইয়ে ত্রিদিব রায় পাক হানাদারদের প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘On the way back, at Ranirhat, 18 miles from Rangamati, a number of very frightened people asked us when the army was going to take over these areas. They said they were suffering at the hands of the Mukti Bahini. We told them that the army would be coming at any moment. That evening at dusk the army, in launches and speedboats made a sort of miniature Normandy landing (the Allied landing in France of 6 June 1944) at Rangamati and swiftly took command of the situation. (page-221)’.
ঢাকার তাম্রলিপি প্রকাশনা থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯-এ প্রকাশিত ডা. এমএ হাসানের বই ‘যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ’-তে রাজাকার হিসেবে ত্রিদিব রায়ের সিরিয়াল এবং তার পরিচয় হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, 948. Mr. Raja Tridiv Roy, Father Late Raja Nalinakhya Roy, Village Rajbari Rangamati, Thana Kotowaly, Chittagong (page- 152).বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বের হওয়া হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’ (সশস্ত্র সংগ্রাম-১) নবম খন্ডের (জুন, ২০০৯) ৯৩ পৃষ্ঠায় মে. জে. মীর শওকত আলী (বীর উত্তম) লিখেছেন, ‘চাকমা উপজাতিদের হয়ত আমরা সাহায্য পেতাম।
কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়।’ অন্যদিকে ১৯৭১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) এইচটি ইমাম তার বই ‘বাংলাদেশ সরকার-১৯৭১’-এর (মার্চ, ২০০৪) ২৬০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় প্রথম থেকেই নির্লিপ্ত এবং গোপনে পাকিস্তানিদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন।’
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক)-এর বই ‘মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের বীর উত্তম’ (ডিসেম্বর, ২০০৮)-এর ৬৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মার্চ মাসের প্রথম থেকেই রাজা ত্রিদিব রায় এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কোনো কারণে মুক্তিকামী বাঙালিদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন।’
১৯৭১ সালে ত্রিদিব রায়ের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে বলাকা প্রকাশনী থেকে ২০১১ সালের একুশে বই মেলায় প্রকাশিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’-এর ৩৭৯-৩৮০ পৃষ্ঠায় গবেষক জামাল উদ্দিন লিখেছেন, ‘…অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালাল খ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) বিশ্বাসঘাতকতায় ওই দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙ্গামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এ দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গামাটির আবদুল শুক্কুর, এসএম কামাল, শফিকুর রহমান, ইফতেখার, ইলিয়াস, অবদুল বারী, মো. মামুন ও আবুল কালাম আজাদ।
ধৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র আবুল কালাম আজাদ ও ফুড ইন্সপেক্টর আবদুল বারী ছাড়া অন্যদের পাকবাহিনী নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে মানিকছড়িতে নিয়ে হত্যা করে।’ ত্রিদিব রায়দের সহায়তায় পাকিস্তানিরা পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রবসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই হত্যা করেছে। অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত শরদিন্দু শেখর চাকমা তার ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক বইয়ের ৩০-৩১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমি তাকে (রাজা ত্রিদিব রায়কে) বলি, আমার তো মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে এবং তার পক্ষে স্রোতের বিপরীতে যাওয়া ঠিক হয়নি। রাজা ত্রিদিব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।
তারপর বলেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে না, যদি ভারত পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে না পারে। আর ভারত পাকিস্তানকে পরাস্ত করতে পারবে না, কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে চীন এবং আমেরিকা রয়েছে। তারা কোনদিন পাকিস্তানকে ভারতের নিকট পরাজিত হতে দেবে না। রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি তিনি তখন পাকিস্তানিদের চেয়ে বেশি পাকিস্তানি হয়েছেন।’
চিত্র: রাজা ত্রিদিব রায়রাজা ত্রিদিব রায় সম্পর্কিত বিভিন্ন দলিল ও গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় মিয়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে ওই বছরই ব্যাংকক প্রেরণ করে। জাতিসংঘের ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রদানের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ার পর পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং করার জন্য ত্রিদিব রায়কে প্রধান করে এক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে।
বিষয়টি অনুধাবন করে ত্রিদিব রায়কে নিবৃত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ত্রিদিব রায়ের মাতা বিনীতা রায়কে এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে জাতিসংঘে পাঠানো হয়। রাজমাতা বিনীতা রায়সহ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল ত্রিদিব রায়কে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা না করে তার মাতৃভূমিতে ফিরে আসার আহ্বান জানালেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন।
বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ত্রিদিব রায়ের লবিংয়ের কারণে চীন ভেটো প্রয়োগ করে, ফলে সেবার বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তানের পক্ষে তার এই সফলতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তার মন্ত্রিসভা জাতিসংঘ ফেরত ত্রিদিব রায়কে ‘জাতীয় বীর’ খেতাব দিয়ে লালগালিচা সংবর্ধনা প্রদান করে।
সোসাইটি ফর ন্যাশনাল রিসার্চ এন্ড প্রোগ্রেস (এসএনআরপি) কর্তৃক গত ১ নভেম্বর ২০১১ মেঘনা প্রিন্টার্স, ঢাকা থেকে ‘প্রেক্ষাপট : পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়’ শীর্ষক প্রকাশিত এক গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, শুরু থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা চাকমা রাজপরিবারের সদস্যসহ বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাব সম্পন্ন অন্যদের মধ্যে কখনো প্রত্যক্ষ কখনো পরোক্ষভাবে যোগাযোগ ও সমন্বয়কের ভূমিকাও রক্ষা করে গেছেন ত্রিদিব রায়।
যার পুরস্কারস্বরূপ ত্রিদিব রায় পাকিস্তানে আজীবন মন্ত্রিত্বের পদমর্যদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ফেডারেল মন্ত্রী, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত পর্যটন ও সংখ্যালঘু বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার ৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত করে আর্জেন্টিনায় প্রেরণ, ১৯৯৫ সালের মে মাস থেকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ‘অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ’ হিসেবে নিয়োগ, ২ এপ্রিল ২০০৩ থেকে পাকিস্তানের দপ্তরবিহীন ফেডারেল মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর করাচীতেই মৃত্যু হয় ত্রিদিব রায়ের। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে, এতকিছুর পরও মৃত্যুর আগে রাঙ্গামাটিতে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। আর রাজাকারবিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ সরকার সেই আমৃত্যু বাংলাদেশ বিরোধিতাকারী ত্রিদিব রায়ের মরদেহ দেশে আনার ব্যাপারে রাজকীয় আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত কিছু প্রতিবাদী তরুণ এবং সচেতন মানুষের প্রতিরোধের মুখে সরকারের সে সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়ন হতে পারেনি। অপরদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের রেখে যাওয়া রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) গড়ে তোলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং এর সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী। এ প্রসঙ্গে ১৩৯২ বাংলা সালে কলিকাতা, নাথ ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘প্রসঙ্গ : পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক গ্রন্থে সিদ্ধার্থ চাকমা লিখেছেন, ‘…উপজাতীয় রাজাকাররা এ সময় গভীর অরণ্যে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তারা সশস্ত্র ও সংগঠিত হয়ে শান্তিবাহিনী নামে সংগঠন গড়ে তোলে।
এখানে একটি বিষয় উল্ল্যেখযোগ্য, মুক্তিযুদ্ধে উপজাতি রাজাদের অবস্থান সমর্থন করতে গিয়ে অনেক ‘বিশারদ’ বলেন, নিজ প্রজাদের যাতে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক কোনও ক্ষতি সাধিত না হয়, সে জন্যেই তারা পাকিস্তানের পক্ষে লড়তে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে চাকমা রাজা নিজ জন্মভূমি ও নিজ প্রজাদের ছেড়ে পাকিস্তানের মন্ত্রী হওয়াটাই বেছে নিলেন কেন? কেন তিনি জীবদ্দশায় নিজ প্রজাদের দেখতে একটি বারের জন্যও এই দেশে এলেন না? কেন তিনি আজীবন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অস্তিস্ব স্বীকার করেননি বরং পাকিস্তানের আনুগত্যশীল ছিলেন? কেন তিনি সদ্য গঠিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে জাতিসংঘে পাকিস্তানের হয়ে গিয়েছিলেন?
এসবের কোনও জবাব ‘বিশারদ’ গণ দিতে পারেননি। মূলত, চাকমা রাজাকে রাজাকারের সংজ্ঞায় ফেলা যায়। এই সম্পর্কিত আরও তথ্য পেতে পারেন বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, অমি রহমান পিয়ালের ‘রাজা(কার) ত্রিদিব রায় : এ লাশ সইবে না বাংলার মাটি’ নামের এই পোস্ট থেকে। শুধু তারাই নন, লারমা ভাইয়েরা (এম এন লারমা ও সন্তু লারমা- শান্তি বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা), যারা নিজেদের মার্ক্সবাদী বলে দাবী করেন, তারাও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেছিলেন (হুমায়ুন আজাদ- ১৯৯৭ ;২১/২২)। ফলে, স্বাধীনতার পর তারা জাতিগতভাবে পড়েন মুক্তিবাহিনীর রোষে। বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে।
‘৭১-এ সন্তু লারমার অবস্থানের কারণে, তার বিচার সে ক্ষেত্রে হওয়া উচিত। রাজাকারদের যে কেবল দাড়ি-টুপি পরিহিত হতে হবে, এমন কোনও কথা নেই।৭১ এ পার্বত্য চট্টগ্রামের উসাখিং, রমণীমোহন চাকমা , মং প্রু সেইনের মতো অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সমতলের ভাইদের পাশাপাশি দেশ মাতৃকার বন্ধন মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।
অসংখ্য আদিবাসী রমণী সম্ভ্রম হারান। ত্রিদিব রায়ের মতো গুটিকয়েক পাকিস্তানী গোলামদের কারণে সমতলের সন্তানদের মধ্যে যে বিরূপ মনোভাব তৈরী হয়, তার কারণে স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরাও তাদের যথাযথ মূল্যায়ণ করেননি। অনেক ক্ষেত্রে অত্যাচারেরও শিকার হয়েছেন। যা পরবর্তী সামরিক শাসকদের আমলে মহীরুহের আকার ধারণ করে। যার রেশ আজো চলছে।
তাই আজ স্বাধীনতার ৪ দশক পরে, মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়ের সন্তানদের অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন হউক সেই প্রত্যাশাই করি।
তথ্যসূত্রঃ
১। মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামঃ শরদিন্দু শেখর চাকমা
২। চট্টগ্রামের ইতিহাসঃ জামালউদ্দিন আহমেদ
৩। অমি রহমান পিয়ালের ব্লগ