এক.
আমার চারপাশে সব স্বপ্নবান মানুষের আনাগোনা। তাদের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। তারা কিছু কিছু স্বপ্নের কথা ফেসবুকে শেয়ার করে। কিছু শেয়ার করে চায়ের আড্ডায়। কিছু লেখে মেইলে। কিছু আবার বলে ফোনে। এতো পজেটিভ মানুষের ভীড়ে কখনো হতাশ হই না। এতো স্বপ্নবাজ মানুষের এই দেশ ৪৫ বছরেও কেন সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ হলো না, সে নিয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা হয়। সবাই মনে করেন, কেন এর উত্তর খুঁজে পেতে খোলামনে আলোচনা হওয়া দরকার। এই কথা থেকে বোঝা যায় আমরা যতো বড় পজেটিভ মানুষই হই না কেন, আমাদের মনের মধ্যে কোথায় যেন সঙ্কীর্ণতা লুকিয়ে রয়েছে।
দুই.
এমন অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকে হয় যে, পথে বাস ড্রাইভার ইঞ্জিনের সব শক্তি ব্যবহার করেও ছোট গর্ত থেকে বাস তুলতে পারছে না। গো গো শব্দে যাত্রীরা কেউ বিচলিত হচ্ছে, কেউবা বিরক্ত। কেউ কেউ ড্রাইভারকে বকাঝকা করছে গর্ত দেখে না চালাতে পারার জন্য। তখনই হেলপার কিংবা বাসের কোনো একজন উৎসাহী যাত্রী কিছু ইটের টুকরো জোগাড় করে গর্তে ফেলার পর ঠিকই বাস গর্ত থেকে উঠে আসে। আবার কখনো এক টুকরো ইট পেছনের চাকার নিচে থাকার কারণে বাস পেছনে সরে না। কেউ একজন সেটা দেখে চাকার নিচের ইটের টুকরোটা সরিয়ে দেয়। আবার এমনও হয় যে, স্টার্ট না নেওয়া বাসটি যাত্রীরা মিলেই ঠেলা দিয়ে চালু করে দিলো। বাস ঠেলতে সব যাত্রী কিন্তু একবারে উঠে আসে না। প্রথমে একজনকে হাত লাগাতে হয়। তারপর অন্যরা যোগ দেয়। আমার চারপাশে আমি হাজারো মানুষ দেখতে পাই যারা একজনের হাত লাগানোর অপেক্ষায়।
তিন.
দেশ আজ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ইত্যাদি নানান ধারায় বিভক্ত। আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিভক্ত ধারাগুলো কৌশলগত কারণে পরস্পর একই মঞ্চে সমবেত হচ্ছে। যেমন, আওয়ামী লীগের আজকের শত্রু জামায়াতে ইসলামী ১৯৯৬ সালে কৌশলগত বন্ধু ছিল। বিএনপি মনে করে জামায়াতকে তাদের সঙ্গে না রাখলে জামায়াতে ইসলামী আবার যে কোনো নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কৌশলগত বন্ধুতে পরিণত হবে। হেফাজতে ইসলাম নিয়েও কৌশলের রাজনীতি চলছে। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এমনটা করার একটি সহজ যুক্তি দেয়, সেটি হলো রাজনীতিতে নাকি চিরশত্রু ও চিরমিত্র বলে কিছু নেই। ইতিবাচক যুক্তিবাদী মানুষেরা প্রশ্ন তোলেন তাই বলে রাজনীতিতে নীতি নৈতিকতা থাকবে না? রাজনীতিতে মিথ্যাচার ও প্রতারণা কি তাহলে বৈধ? মূল্যবোধের কি কোনো মূল্য রাজনীতিতে নেই? তাহলে রাজনীতি কি শুধুই ক্ষমতায় যাওয়ার একটি পদ্ধতি ও উপায়মাত্র?
এমন প্রশ্নের সূত্র ধরেই আরো অনেক প্রশ্ন জাগে মনে। যেমন, ক্ষমতা কেন ও কিসের জন্য? বলা হয়, জনগণের ভোটের মাধ্যমে যে ক্ষমতা অর্জন সেটা জনগণকে ক্ষমতায়ন করারই লক্ষ্যে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে, জনগণ যদি নিজেই নিজের ক্ষমতায়ন ঘটুক সেটা না চায় তাহলে কি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ক্ষমতায়ন করতে পারে? এই প্রশ্ন থেকেই নতুন প্রশ্ন জাগে মনে- আসলে জনগণ কী চায়?
চার.
জনগণ কী চায় এই প্রশ্নের আসলে সহজ জবাব নেই। কারণ জনগণের চাওয়া বদলাতে থাকে। খুব কম মানুষের দেখা পেয়েছি যে বা যারা তাদের চাওয়া-পাওয়ার রাশ টানতে পেরেছেন। একবার এক ব্যাংকারের দেখা পেয়েছিলাম। যিনি রাজশাহীতে বাড়ি থাকায় ঢাকায় আর বাড়ি করেননি। তার যুক্তি ছিল, একটি দেশে একজনের কয়টি বাড়ি দরকার? এমন মানুষ সমাজে কতোজন আছেন? আর জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কতোজন আছেন?
স্বচক্ষে দেখি, পত্রিকায় পড়ি, টেলিভিশনে সচিত্র সংবাদে দেখি যে, আমাদের জনপ্রতিনিধিরা ইচ্ছেমতো সরকারি জমি দখল করছেন, নদী ভরাট করছেন, রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুট করছেন, আরো কতো কি। একবারও তারা ভাবেন না যে, জনগণকে তারা কী বার্তা দিচ্ছেন। তারা জনগণকে বলছেন, সুযোগ পেলেই তোমার চাওয়া-পাওয়ার রশি ছেড়ে দাও। রাশ টানার কোনো দরকার নেই। কারণ আবার কবে সুযোগ পাবে সেটা তো তুমি নিজেও জানো। তারা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, সুযোগ পেলে তুমি দেশটাকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে পারো। যে কারণে আমরা দেখি দোকানদার যখন সুযোগ পায় ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে। মন্ত্রীরা তাদের পক্ষে সাফাই গায়। রাষ্ট্রীয় অর্থ দেখভাল করার দায়িত্ব যে মন্ত্রীর তিনি নির্দ্বিধায় বলেন, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সাগর চুরি হচ্ছে। তাতে জনগণের কোনো ভাবাবেগ তৈরি হয় না। কারণ ৪৫ বছর ধরে জনগণকে এভাবেই তৈরি করা হয়েছে। তারা সবাই যেন অপেক্ষা করছে নিজের পালার জন্য।
পাঁচ.
এ এক অদ্ভুত সময়। একদিকে স্বপ্নবান মানুষের ভীড়। অন্যদিকে, পত্রিকার পাতায় টেলিভিশনের খবরে সব লোপাটকারীদের ছবি আর খবর। এই সব বৈপরীত্যের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই যে দেশ এগোচ্ছে তার কারণ দেশকে ভালোবাসে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। এই দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা স্বপ্নবান মানুষের কর্মফল। যাদের কাজের কারণে দেশ এগোচ্ছে তারা প্রায় সবাই একজন ভালো মানুষের অপেক্ষায় আছেন। তারা সবাই মিলে একজন ভালো নেতার অপেক্ষায় আছেন। অথচ সত্যটি হলো যিনি অপেক্ষা করছেন দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে তিনি নিজেই ভালো মানুষ। তিনি নিজেই সেই নেতা। তার আসলে কারো জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। তার দরকার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নষ্ট রাজনীতি প্রত্যাখান করা এবং নিজেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা। আর দরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়া।
ছয়.
খুব পরিষ্কার বুঝতে পারি, ইতিবাচক স্বপ্নের সঙ্গী মানুষেরা যখন অন্যের নেতৃত্বের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে আসবেন। দায়িত্ব নেবেন। সেদিন বাসের যাত্রীর মতো অন্যরাও হাত লাগাবে। খুব দ্রুত দু’চোখ ভরা স্বপ্ন আলো ছড়াবে একজন থেকে অন্যজনে। সেই আলোতে ভরে যাবে চারপাশ। এই দেশের শিশু, কিশোর ও তরুণরা সেই আলোতে উদ্ভাসিত হবে। তারাও স্বপ্ন দেখবে। তারা বুঝতে শিখবে সুযোগ পাওয়া মানে দেশের সম্পদ লুটপাট করা নয়, বরং সুযোগ পাওয়া মানে মুক্তিযোদ্ধার সোনার ছেলে রুমি, বদি, জুয়েলদের মতো দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা।
সাত.
আমি আমার চারপাশের স্বপ্ন দেখা মানুষদের বলতে চাই, যে স্বপ্ন অন্যের জীবনে আলো ছড়ায় না, শুধু নিজের জীবনকে ঘিরে রাখে সেই স্বপ্ন তো ইলেকট্রিক বাল্ব। আমাদের দরকার ম্যাচের কাঠি কিংবা মোমবাতির স্বপ্ন। যা নিজে জ্বলবে। অন্যকে জ্বলতে দেবে। আসুন, আর স্বপ্ন দেখা নয়। এবার স্বপ্ন পূরণ শুরু করি। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)