যুক্তফ্রন্ট, ঐক্য প্রক্রিয়া পার হয়ে এবার হলো জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট৷
২০১৭ সালের নভেম্বরে বিকল্পধারা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য মিলে যুক্তফ্রন্ট আত্মপ্রকাশ করে। নতুন এই জোটের চেয়ারম্যান করা হয় অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। এরপর নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারসহ নানা দাবিতে বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে গত ২২ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে যোগ দেন। ঐক্য প্রক্রিয়ায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ যায়নি৷ সেখানে গিয়েছে জে এস ডি, নাগরিক ঐক্য, বিকল্প ধারা ও বিএনপি৷ এরপর বিকল্প ধারা বিএনপিকে জামাত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বর্জন করতে আহবান জানায়। অতঃপর ১৩ অক্টোবর গঠিত হলো জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট নামের একটি জোট৷ বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে ড. কামাল হোসেন বাসায় দাওয়াত দিয়ে তিনি বাসার গেট লাগিয়ে মতিঝিলে গিয়ে বৈঠকে মিলিত হলেন বিএনপি, জে এস ডি, নাগরিক ঐক্য, জাফর উল্লাহ চৌধুরী ও বিগত ওয়ান ইলেভেনের কুশিলব ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের সাথে। এর কী উদ্দেশ্য?
সম্প্রতি মাহমুদুর রহমান মান্না ও মাহী বি চৌধুরীর একটি ফোনালাপ ফাঁস হলো। আগে ফাঁস হয়েছিল সাদেক হোসেন খোকা ও মান্নার ভাইবার কথোপকথন। এবার ফোন। আসলে মাহমুদুর রহমান মান্না রাজনীতির নানা পথ মাড়িয়ে এখন কোন পথে যাচ্ছেন?
ফোনালাপের অংশবিশেষ,
মান্না: না এটা বলা হয়েছে, কোনো ভুলের কারণে হোক। উনি এখানে নাই, কিন্তু তাকে ঐক্যের মধ্যে আছেন আমরা ধরেই আছি।
মাহী: কাদের সাথে, কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্য? কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। ওনার নেতৃত্বে জামায়াতের সঙ্গে গোপনে আঁতাত হবে, সেগুলির সঙ্গে আমরা থাকতে চাই না তো। আলহামদুলিল্লাহ…আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন। বাট প্রশ্নতো সেইটা না, আপনারা জাতির সামনে পরিষ্কার করেই বলতেন যে, উনাকে দাওয়াত দেওয়া হয় নাই। উনাকে না বলে আমরা চুরি করে মিটিং করছি, এগুলো বললো না কেনো।
মান্না: এরকম প্রশ্নোত্তর কেউ করে নাই তো…করলে
মাহী: আপনারা নিজেরাই বলতেন কামাল হোসেন বাসা থেকে পালাই গিয়া উনার অফিসে বসে ওনাকে (বি. চৌধুরী) বাদ দিয়ে আমরা একটা ঐক্য করতে যাই, গোপনে গোপনে জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে উনাকে বাদ দিয়ে ঐক্য করতে চাই, বলতেন?
ফোনালাপের আরও কিছু অংশ নিম্নরূপঃ
মান্না: ভাই এরকম বলেন কেন? সেটা ভালো কাজ হয়নি, মানছি, তার মানে এই না যে সেখানে বলবো আমরা খুব অন্যায় কাজ করছি। তাহলে প্রেস কনফারেন্সে আসলেন কেন? ওটাতো হয় না। যেহেতু ঐক্যটা করতে চাই, এজন্য করেছি। আপনার কথার পর বলবো যে, একটা বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলাম।
ফোনালাপে উঠে আসে জাতীয় ঐক্যের নামে ষড়যন্ত্রের দিক৷ এতে আরও বলা হয়,
মাহী: মান্না ভাই আপনাকে আল্লাহর কসম বলি, আমি আপনাকে পছন্দ করি দেখে বলতেছি। ঐক্যের ব্যাপারে আপনি হানড্রেড পারসেন্ট আন্তরিক আমিও ঐক্যের ব্যাপারে হানড্রেড পারসেন্ট আন্তরিক। বাট ঐক্যের নাম দিয়ে এখানে কোনো রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র হইতেছে, আপনাকে দিয়ে ঘোষণাপত্র পাঠ করাইতেছে। আমাকেও সেখানে ঢোকানোর চেষ্টা করছিলো। আজকের এ কথাটা শুধু মনে রাইখেন আর কিছু বলবো না।
মান্না: ও…হ…চিন্তা করবো, আরও কথা বলবো সামনা-সামনি।
মাহী: জি, আমার মনে হয় একটা চক্রান্তের মধ্যে আপনারা ভিকটিম হয়ে যাচ্ছেন মান্না ভাই। আমার মনের বিশ্বাস থেকে বললাম, এখানে ঐক্য প্রক্রিয়া নামে একটা চক্রান্ত, একটা ষড়যন্ত্র হইতাছে। এবং এটার মধ্যে আমাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হইছিল, আল্লাহর রহমত ছিলো আমি বাঁইচা গেছি। আপনাকে দিয়ে ঘোষণাপত্র পাঠ করাইলো। ইট ইজ নাথিং বাট অ্যা কন্সপিরেসি। এখানে কোনো জাতীয় ঐক্যের বিষয় নেই। একটা কন্সপিরেসি হচ্ছে, চক্রান্ত হচ্ছে।
জাতীয় ঐক্যের নেতারা নিজের মুখেই বললেন এটা জাতীয় ঐক্য নয় এটা কন্সপিরেসী৷ কিন্তু কি সে কন্সপিরেসি? ড.কামাল, আ.স.ম. আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না তাদের না হয় ছোট খাট সংগঠন আছে কিন্তু ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন কী সূত্রে গেলেন সেখানে? আসন্ন সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে কী ঘটতে চলেছে? প্রেসক্লাবে জাফর উল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্যেও কনস্পিরেসির দিক স্পষ্ট। তিনি ৮ অক্টোবর (সোমবার) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশ গণ সাংস্কৃতিক দলের (বাগসদ) উদ্যোগে আয়োজিত এক নাগরিক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিভীষিকাময় রাতের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে সরকার পতনের হুমকি দেন। তিনি দাবি করেছেন যে, ১৫ আগস্টের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রুখে দিয়ে বিপদগামীরা জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করবে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, আপনি সাবধান হন। এমন কিছু করবেন না যাতে ৭৫ ফিরে আসে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ডা. জাফরুল্লাহর এমন উসকানিমূলক এবং অনৈতিক বক্তব্যে কি ষড়যন্ত্রের দিক স্পষ্ট হয়ে উঠল না?
যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, ঐক্যফ্রন্ট ইত্যাদি নামের জোট গঠনের কী সে উদ্দেশ্য?যুক্তফ্রন্ট হতে সরে গেল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ঐক্য প্রক্রিয়া হতে ছিটকে পড়লো বিকল্প ধারা৷ ১৪ অক্টোবর সংবাদ পত্রে শিরোনাম হলো, চৌধুরী বাদ, নতুন জোট ড.কামালের নেতৃত্বে /বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর ঐক্যে নেই বিকল্পধারা৷এলডিপির সভাপতি কর্ণেল অলি আহমেদ বলেছেন,আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কিনা এব্যাপারে আমি এখনও নিশ্চিত না৷ দেশের অবস্থা এক বাক্যে বলবো ভালোনা৷ জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, কথিত জাতীয় ঐক্যের নেতারা রাজাকারদের সাথে বিএনপির সম্পর্কের বিষয়ে নিরব।
তিনি বলেন, তাদের ৭ দফার প্রথম সারকথা হচ্ছে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে ভোটের আগে একটি অস্বাভাবিক সরকার আনা। যার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। দ্বিতীয় সারকথা হচ্ছে চিহ্নিত, স্বীকৃত, সাজাপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ, জঙ্গি-সন্ত্রাসী, আগুন সন্ত্রাসী, একাত্তরের খুনিদেরকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনে আবার পুনর্বাসন করার প্রস্তাব৷ আসলে ছোট দলের নেতৃত্বে বড় দল মিশে কী ঘটাতে চাচ্ছে দেশে? বড় দল ক্ষমতায় যেতে পারছেনা তাই তারা ভর করল ছোট দলের উপর৷ ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, আ.স.ম. আব্দুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যের কয় হাজার ভোট আছে দেশে? এ দলের কেউ কি নির্বাচনে জিততে পারবে? যারা নিজেরা জামানত হারাবে তারা অপরকে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসাবে এও কি সম্ভব? একটা বড় দল কতটা দেউলিয়া হলে এমন নির্ভরতার দিকে যেতে পারে? নাকি এ নির্ভরতা আসলে নির্ভরতা নয় ষড়যন্ত্রের সিঁড়ি? কি সে ষড়যন্ত্র? জাফর উল্লাহ চৌধুরী যা বলল, তবে কি তা-ই? জাতীয় ঐক্যের নেতা ও বিকল্পধারার যুগ্মমহাসচিব মাহী বি চৌধুরী বলল, জাতীয় ঐক্যের নামে একটা একটা চক্রান্ত হচ্ছে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে৷ তাদের সাম্প্রতিক কার্যকলাপেও সেরকমটিই মনে হয়৷ বিএনপিতেও শুরু হয়েছে বিবাদ কেউ কেউ বলছে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া তারা কিভাবে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিল৷ এদিকে ১৪ দলের নেতারা বলছেন জাতীয় ঐক্যেরও কেউ কেউ আমাদের সাথে আসবে৷ তবে কি শেষ মুহূর্তে বিকল্প ধারা ১৪ দলে যাবে? যুক্তফ্রন্ট হতে ছিটকে পড়া কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও কি তাই করতে যাচ্ছে? বিকল্প ধারা বলছে, বিএনপি জাতীয় ঐক্যের সাথে আছে আবার জামাতের সাথে পরকীয়াও করছে ও জাসদের রব ও নাগরিক ঐক্যের মান্নার আসল বিবাহ বুঝি ঐক্যপ্রক্রিয়ার সাথে ঐক্যফ্রন্টে গেছে তারা পরকীয়া করতে৷ এক্ষেত্রে বিকল্প ধারাও আওয়ামী লীগের সাথে পরকীয়া করছেনাতো? এদিকে যুক্তফ্রন্টের নেতা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের সিদ্দিকী আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ১৫ আগস্টের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সভা ডেকেছেন৷ এতে ১৪ দল নেত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন এ উদ্যোগকে যুক্তফ্রন্টের মূল্যায়ন কী? আসলে কে কার সাথে পরকীয়া করছে আর কোন সংসার ভাঙ্গতে চলেছে? পরকীয়ায় কিন্তু খুন খারাবীই বেশী হয়৷ জাফর উল্লাহ চৌধুরীর ৭৫ এর পুনরাবৃত্তির হুমকি উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়৷ কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তার ঝুঁকির কথা বলেছেন৷ রাজনীতিতে পরকীয়ার ফল ভয়াবহ হয়৷ ৭৫ এর আগেও মোশতাক বঙ্গবন্ধুর সাথে থেকে পরকীয়া করতো খুনীদের সাথে৷ এই পরকীয়াই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটায়৷ চ্যানেল আই অনলাইনের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সাংগঠনিক প্রধান ওবায়দুল কাদের ভয়ংকর এবং গুরুতর এক অভিযোগ করে বলেছেন, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পাঁয়তারা চলছে। তার দাবি, এ নিয়ে পর্দার অন্তরালে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
দেশের সবচেয়ে বড় দলের সাধারণ সম্পাদকের মতো পদে থাকার পাশাপাশি মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি যখন এই ধরনের অভিযোগ করেন, তখন কোনোভাবেই তাকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। বিশেষ করে সেই অভিযোগ যদি হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধানকে নিয়ে।
নিশ্চিত করেই বলা যায়, ওবায়দুল কাদের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এই ধরনের অভিযোগ প্রকাশ্যে আনবেন না। তার ভিত্তিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই মঙ্গলবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন-আইইবি মিলনায়তনে সাম্যবাদী দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দেয়া তার বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা৷ এই আশঙ্কার রেশ যেতে না যেতেই জাফর উল্লাহ চৌধুরী এমন কথা বলল৷ মান্না-মাহীর ফোনালাপেও উঠে এলো চক্রান্তের কথা৷ কি সে চক্রান্ত?আমরা ৭৫ এর পুনরাবৃত্তি চাইনা ও চাইনা অগণতান্ত্রিক কোন শক্তির আত্মপ্রকাশ৷ রাজনীতিতে পরকীয়ার নামে ষড়যন্ত্র বন্ধ হবে কি? গণতন্ত্র কি চলবে গণতন্ত্রের ধারায়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)