২৪ মার্চ। এই দিনকে বলা হয় রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের দিন। কোনো ধরনের রক্তপাত ছাড়াই এই দিন ক্ষমতা দখল করেন হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। তবে এই ক্ষমতা দখলের একটি লম্বা প্রেক্ষাপট ছিলো। যেটার শুরু ১৯৪৭ সাল থেকে।
১৯৪৭ সালের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র পাই। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের মোহ ভঙ্গ হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা লুণ্ঠন ও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত করতে গিয়ে যা করেন তারা প্রথমেই আমাদের ভাষা অধিকারের উপর হাত দেয়। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই বাঙালি জাতিসত্তার এক নতুন দিগন্ত সূচনা হয়। এরপর ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং সেই আন্দোলনে জয় আসে।
১৯৫৮ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে যে সরকার নির্বাচিত হয় সেটা কিছুদিনের মধ্যেই ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং ক্ষমতা দখল করেন আইয়ুব খান, মার্শাল ল’ জারি করে।
এরপর ১৯৬২ সালে শিক্ষার দাবিতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আদালত সেই হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন স্থগিত করে।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। সেই সময়ে পাকিস্তানিরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশীদের নিয়ে সেখানে আশ্রয় দেয়, ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বুহ্য আলোচনা করে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থাকে অরক্ষিত।
এরপরই ১৯৬৬ সালে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবিতে ছয় দফা পেশ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই ছয় দফা আন্দোলন পরে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ক্ষমতায় এসে এক ভোট এক মাথা নীতির ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করে। তাতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
৭০ এর নির্বাচনের পর এখানে একটি প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাস হয়। তাতে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু সেদিকেও পাকিস্তানী সরকার কর্ণপাত করেনি। এরপরই ছাত্রসমাজ ও জনগণ ছয় দফা আন্দোলনকে এক দফায় পরিণত করে। একদিকে আন্দোলন চলে আর একদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি।
১৯৭১ সালে মার্চ সংসদ অধিবেশন চলছিলো সেটা স্থগিত করে। ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো ও শেখ মুজিবের মধ্যে যে আলোচনা চলছিলো সেটা স্থগিত করে দেশ ছেড়ে চলে যায়। এরপর ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে তারা দেশের মানুষের উপর আক্রমণ করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু অন্তরীণ হন। বঙ্গবন্ধুকে তারা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। নেতৃবৃন্দও ভারতে আশ্রয় নেন। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। সেই প্রবাসী সরকার ভারত সরকারের সহযোগিতায় আমাদের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বশস্ত্র ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। এরপর সেখানে মুজিব বাহিনী নামে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠিত হয়।
১৬ই ডিসেম্বর আমাদের বিজয় সূচিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের সেই মর্মান্তিক ঘটনা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকে। ১লা নভেম্বর থেকেই অস্থিরতা শুরু হয়। ৩ নভেম্বর ঘটে নৃশংস জেল হত্যাকাণ্ড। ওই দিন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে আটক করা হয়। আবারো জাসদের গণবাহিনী ও কর্নেল তাহেরে নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াকে আবার স্বপদে ফিরিয়ে আনা হয়।
জিয়া ক্ষমতাসীন হয়েই কর্নেল তাহেরসহ জাসদের নেতাদের আটক করেন। তারপর ক্যাঙ্গারু ট্রায়ালের মাধ্যমে কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যা করেন। এরমধ্যে জেলখানায় প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বদানকারীদের হত্যা করা হয়।
এই সময়ে ৩১টি অভ্যুত্থান হয়। জিয়া অনেককে হত্যা করেন এবং একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে একটি পাল্টা অভ্যুত্থানে জিয়া খুন হন। তখন চট্টগ্রামের জিওসি ছিলেন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল মনজুর। তাকেও ক্যান্টনমেন্টে ধরে এনে হত্যা করা হয়। ক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ। তখন জিয়ার হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড এবং কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের বেশিরভাগই মুক্তিযোদ্ধা ছিলো।
আবদুস সাত্তার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময়ে সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন প্রভাবের মাধ্যমে দেশকে আবার স্বৈরশাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়।
তখন যে ঘটনাগুলো ঘটে তার মধ্যে প্রধান এজেন্ডা ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা। সেই সময়ে সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ড সারা বাংলাদেশে বিরুপ পরিস্থিতি তৈরি করে। তখনকার যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাড়ি থেকে খুনি ইমদুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মন্ত্রীর বাড়ি থেকে খুনিকে উদ্ধার করা সহ্য করতে পারছিলো না সাধারণ মানুষ। সেই সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ।
জিয়া হত্যার পরে এরশাদ সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বিচারপতি সাত্তারের সরকারকে অচল করে দেয়। এমন পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতে জনমনে ধারণা তৈরি হয় যে, এই সরকারকে দিয়ে হবে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমঝোতার মধ্যে দিয়েই এরশাদ ক্ষমতায় আসে। সেই জন্য এই দিনকে বলা হয় ‘রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের দিন’।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিভিন্ন পৌণপুনিক সামরিক শাসন, অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠন ও সংস্থার ধারাবাহিক আন্দোলন হয়। সেই সময়ে নানান ছাত্র সংগঠন আন্দোলনে যোগ দেয়।
২৬ মার্চ স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে গেলে এরশাদের বাহিনী হামলা চালায় তাতে জননেত্রী শেখ হাসিনাও আহত হন। এরপর দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলন হয়। এসময় শিক্ষক এবং সাংবাদিকরা আন্দোলনে যোগ দেন। সমস্ত শ্রেণিপেশার মানুষ তাতে যুক্ত হয়। নুর হোসেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। তখনই এরশাদের ক্ষমতা ত্যাগের অবস্থা তৈরি হয়। কিন্তু বিদেশি ও দেশীয় শক্তি সেগুলোকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যায়।
তখন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য একদিকে আরেকদিকে অন্যান্য জোট। ১৯৯০ সালে পুনরায় সকল ছাত্র সংগঠন একত্রিত হয় এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলন ঘণীভূত হয়। ডাক্তার মিলনের হত্যার মধ্যে দিয়ে সবাই রাজপথে নেমে আসে। এতে আন্দোলন আরো ঘনীভূত হয়। এরপর থেকেই তার পতনের দিনক্ষণ শুরু হয়ে যায় এবং কার্যত ক্ষমতায় থাকলেও তার সমস্ত হুকুমও অকার্যকর হয়ে যায়। কারফিউ ভঙ্গ করে রোকেয়া হলের মেয়েরাও বেরিয়ে আসে। অবশেষে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ তার পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)