‘আমার জীবনটা রং এ ভরপুর’ নিচুস্বরে বলে ওঠে দিনার।
আমি জিজ্ঞেস করি, কোন রং? Wrong; আই মিন ভুল নাকি রং মানে কালার এ ভরপুর!
কুৎসিত একটা হাসি দিয়ে দিনার বলে, ‘আপনি লেখক হয়ে আমার কাছে জিজ্ঞেস করেন! হতাশ ভাই রে!’
একটু লজ্জাই পাই। সামলে নিয়ে বলি, ‘দুটোর কোনোটার ই তো কমতি নেই তোমার’
সত্যিই ভুলে ভরা, কিন্ত রঙিন জীবন দিনারের।
সবশেষ ভুলটা করেছে একটু আগে। ওর দোকানে জামা বানাতে আসা কোন এক বাতেন সাহেবকে ভুল করে তাহসিনা ম্যাডামের পেটিকোট দিয়ে দিয়েছে। ওই লোক এসে তো হম্বিতম্বি। কে শোনে কার কথা। গলা মিলিয়ে লড়ে যাচ্ছে দিনার। স্টাইল টেইলার্সের মাস্টার।
এক পর্যায়ে wrong এর মধ্যেই একটুখানি রং ছড়িয়ে দেয় দিনার
‘ঠিকই তো করসি। আপনার মত হাতির জন্য ওই পেটিকোটই ঠিক আছে। ওইটা জামা হিসাবে পইরা বইসা থাকেন।’
বাতেন সাহেব রাগে লাল হয়ে যান। টুক করে তুইয়ে নেমে যান, “তোর মতো জানোয়ারের জন্য আমার ডাবল ভাড়া খরচ করে আবার আসতে হলো, তোকে দেখে নেব…”
বাতেন সাহেবের মতো অনেকেই এভাবে দেখতে চেয়েছে দিনারকে। কারোরই আর দেখা হয়ে ওঠে নি।
টেইলরদের জীবনটাই ভুলে ভরা। ভুল করলেও ভুল। না করলেও ভুল। আধা ইঞ্চি বেশি হলে ভালো হতো, গলাটা চারকোনা হবে, ফুলটা বামে দিতে পারতে, জামার কাটিংটা চাইনিজ হবে, প্যান্টের চেইনটা কেমন কেমন লাগে…
এত ভুলের মাঝে দিনার একটা ঠিক কাজ ঠিকই করেছে। সে টেইলর। তবে লেডিস টেইলর নয়। নর-নারী সবার পোশাকই বানায় সে। লেডিস টেইলর হবার জ্বালা অনেক…
‘আচ্ছা, তুমি দর্জি কেন হলে?’
‘ভাই, আমার ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল টেইলর হবো! Aim in life…কেমন প্রশ্ন করেন আপনি! কেউ সাধে টেইলর হইসে বলে তো আমার জানা নেই। হইসি পেটের দায়ে। খানিকটা সময়ের দোষে। আর দর্জি কি? বেশি বাংলা বিশারদ হইসেন? তাহলে চ্যালেঞ্জ আর চেয়ারের বাংলা বলেন তো! দর্জি!!! আমি মাস্টার। এই নামেই ডাকবেন আর সবার মতো।’
দিনারের দর্জি, মানে মাস্টার হবার কাহিনীটা হয়তো কমন পড়বে অনেকের।
বাবা মারা যাওয়ার পর ১৩-১৪ বছরের ছেলেটা দ্বারে দ্বারে ঘুরে মাস্টার মজিদের দেখা পায়। দিনারের গুরু। সেই জামার হাতা কাটা থেকে শুরু। এখন দিনার নিজেই মাস্টার।
মাস্টারদের জীবনটা কেমন হয়? ভুলে ভরা? হয়তো তাই। দিনারের কথা মতো দর্জি হওয়ার স্বপ্ন কারো থাকে না। পরিস্থিতি মানুষকে দর্জি বানায়। আর বড়লোকের বা লেখাপড়া জানা লোকের দর্জি হওয়ার শখ জাগলে তাকে আদর করে আমরা বলি ফ্যাশন ডিজাইনার।
ওটার একটা স্ট্যাটাস আছে। দর্জির হয়তো নেই। তা না হলে, দিনারের ছেলে জামিল স্কুলে ওর বাবার পেশা কাপড়ের ব্যবসায়ী বললো কেনো!
জামিলের এক শিক্ষক সেদিন দোকানে এসে বললো, ‘ও। আপনি তাহলে দর্জি। জামিল যে বললো…কাপড়ের দোকান আপনাদের’
লজ্জা, কষ্ট, ক্ষোভ কোনটা সেদিন হয় নি দিনারের? কিন্তু কি ই বা বলবে? আমরা এমনই।
শুধু লেডিস টেইলর হলে ঘরে সন্দেহ ঢোকে। বউ খোটা দেয়। তাই ও ল্যাঠাটা চুকিয়ে ফেলেছে দিনার। কিন্তু, পরিসংখ্যান বলে, তার ৯০% কাস্টমার নারী। ইদানিং কেমন জানি ছেলেদের পোশাক বানাতেও মেয়েদের কাটিং চলে আসছে। এ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড কম হলো না।তাই বাতেন সাহেবের মতো কয়েকজন ছাড়া পুরুষেরা দিনারের দোকানে ঘেঁষে না।
জগৎ ভর্তি মানুষ আর ঘরের বউয়ের দর্শন: লেডিস টেইলার্স মানেই চরিত্রহীন। দিনারের মতে, টেইলর হলো চিকিৎসকের মতো। রোগ নিয়ে কারবার। রোগীর দিকে নজর নয়। আর যদি বলেন চরিত্রের দোষ, তাহলে কোন পেশায় চরিত্রহীন নেই? যাদের কাছ থেকে শিখি আমরা, সেই শিক্ষকদের মধ্যেও কি চরিত্রহীন নেই? তবে শুধু আমাদের দোষ কেন ভাই?
তবে ওই রোগ আর রোগীর দর্শন থেকে গুরুতর ভাবে দিনারের পা ফসকেছে একবার।সত্যি বলছি একবারই।
রোকসানা ম্যাডাম। মজিদ মিয়ার পুরোনো কাস্টমার। তার স্কুল ড্রেস হতে শুরু করে সব পোশাকই মজিদ মিয়া, মানে দিনারের গুরু বানাতো। তার মৃত্যুর পর শিষ্যের কাছেই রোকসানা ম্যাডামের পোশাক তৈরির দায়িত্ব পড়ে। দুনিয়ার সকল মরিচের ঝাল যেন কেউ এই মহিলার মুখে ডলে দিয়েছে। এত বদমেজাজী আর দর্জাল মানুষ হয়?
প্রতিটা পোশাকে ভুল কিছু না কিছু হবেই। দিনার ক্লান্ত হয়ে যায় ঝাড়ি শুনতে শুনতে। একদিন দিনারের জীবনেও ঝড় আসে। ঝাড়িগুলোর মাঝে। মিলি। রোকসানা ম্যাডামের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। মা যদি শাপলা হয়, তাহলে মেয়ে যমুনা সেতু! মানে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ আর কি!
চুপচাপ,শান্ত আর চোখ ভর্তি না বলা কথা। দিনার ভেসে যায়। না বলা কথার স্রোতে। কেন জানি মনে হয়, একবার। এই একটাই wrong তার জীবনে রং লাগিয়ে গেল।
মিলি আসে মায়ের সাথে। চুপ করে একপাশে চেয়ার নিয়ে বসে থাকে। আবার চলে যায়। মিলির চোখেও কিছু একটা দেখেছিল কি দিনার? হয়তো। হয়তো না।
ইদানিং মহা সমস্যা হয়েছে। রোকসানা ম্যাডামের গালিগুলোও ভালো লাগছে তার!
একদিন। বৃষ্টি হচ্ছে খুব। বাসার একজন কাজের মহিলাকে নিয়ে দোকানে এলো মিলি।রোকসানা ম্যাডাম অসুস্থ। তার স্থানটা নিয়েছে ওই মহিলা। ধমকের সুরে কথা বলছে। দিনার শান্ত থাকে। মিলিও চুপ।
হঠাৎ মিলি জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আপনার নাম কি?”
অজানা,অচেনা তরঙ্গ নিয়ে দিনারের কানে বাজে প্রশ্নটা।
‘দিনার’
-কি? ডিনার? হা হা হা।
একজন মানুষের নাম Dinner? আপনার ভাইয়ের নাম কি Lunch?
দিনার না সূচক মাথা নাড়ে। তবে মন চায়, ভাইকে গিয়ে বলতে, তোর নাম আজকে থেকে lunch. মিলি বলেছে মানে বলেছেই। ‘আমার’ মিলি বলেছে।
কথা ওটুকুই। দর্জির সাথে আর কতটুকু কথাই বা হবে! এটা তো আর সিনেমা না!
নতুন স্বপ্ন পেয়ে বসে মিলির ডিনারকে। ধনী হবার স্বপ্ন। জান লাগিয়ে দেয়। দিন-রাত পরিশ্রম করে। টাকা লাগবে। ধনী হতে হবে। নাওয়া -খাওয়া ভুলে শুধু কাজ। ইদানিং রোকসানা ম্যাডামের ঝাড়ি খুব একটা শুনতে হচ্ছে না। পাকা মাস্টার হয়ে উঠেছে দিনার। মিলি তার মায়ের সাথে আসে। আর যায়। দিনারের স্বপ্নটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে যায়।
দোকানটা বড় করেছে দিনার। কর্মীও বেড়েছে। বেড়েছে ব্যবসাও। কিন্তু কমেনি দূরত্ব। মিলি যেন টিভির নাটকের কোনো নায়িকা। স্পর্শের বাইরে।
বছর দুয়েক পর। বৃষ্টির দিন। কাজের মহিলা বদল হয়েছে। নতুন একজনসহ দোকানে আসলো মিলি।
‘ডিনার ভাই, জরুরি কাজ নিয়ে এসেছি।’
-জ্বি, বলেন।
২৫ তারিখ আমার বিয়ে।
ওড়নার ডিজাইনটা আপনাকেই করতে হবে। মায়ের নির্দেশ। আর আমিও অন্য কাউকে দিতে চাই না কাজটা।
দিনার নিজেকে সামলাতে পারে না। দুনিয়াটা এলোমেলো লাগতে থাকে। মরে যেতে মন চায়। কিন্তু, মুখে কিছুই বলে না।
‘অবশ্যই করে দেব। কি ডিজাইন লাগবে?’
‘রংধনুর সাত রং চাই আমার’
-হবে। আমি আজ রাতের মধ্যেই করে দেব।
মিলি খুশি মনে চলে যায়।
দিনারের জগতটা ভেঙ্গেচুরে দিয়ে যায়। অসময়ে দোকানের সবাইকে ছুটি দিয়ে কাজে বসে দিনার। চোখ ভেঙে জল নামছে। হাতের কাজ চলছে। মিলির বিয়ের ওড়নার কাজ। এ জগত জানলো না দিনারের মনের কোণের প্রচণ্ড ভালোবাসার গল্প। রংধনুর সাত রং মিশিয়ে রাতভর চললো বুনন। ফোঁটায় ফোঁটায় চোখের জল গড়িয়েছে ওড়নায়। সব রঙ্গের সাথে ওটা আবার দেখবে না তো মিলি? এজন্যই হয়তো চোখের জলের রং নেই!!
‘আজ মিলির বিয়ে!’