মানুষের অস্বাভাবিক আচরণকে ইঙ্গিত করে অনেকেই বলে থাকেন মানুষটিকে বদ জিনে ধরেছে। তাই তাকে সুস্থ করতে ফকির, ওঝা বা এলাকার ইমামকে ডেকে এনে চলে ঝাড়-ফুঁক। গ্রামে গঞ্জে এ দৃশ্যটি খুবই পরিচিত; জিন ছাড়াতে ওঝা আসে, তার এলাহী কাণ্ড দেখতে রোগির বাড়িতে ভিড় জমায় পাড়ার মানুষ। কিন্তু ঢাকার হযরত হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদের খাদেম বলছেন, কোন ঝাড়-ফুঁকের দরকার নাই, এই মসজিদের আঙিনায় পা দিলেই মানুষের ওপর আছড় করা জিন নাকি পালিয়ে যায়!এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা নাকি জিনের সঙ্গে এই মসজিদে নামাজও পড়তেন!
বাংলা একাডেমি এবং হাইকোর্টের মাঝামাঝি তিন নেতার মাজারের পেছনে অবস্থিত মসজিদটি ১৬৭৯ সালে নির্মান করেণ ঢাকার ধনাঢ্য বণিক ও সুফি শাহজাদা খাজা শাহবাজ । জনশ্রুতি আছে, তিনি নাকি টঙ্গি থেকে এখানে এসে জিনদের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন।
মানুষকে জিনে ধরার ব্যাপারটির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও মসজিদের খাদেম রাশেদ হাসান স্বপনের দাবি, এ মসজিদের আঙিনায় পা রাখলেই মানুষের ওপর থেকে জিনে আছর ছুটে যায়।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে জিন ছাড়াতে। এখানে পা রাখলেই তারা সম্পুর্ণ ভালো হয়ে যায়। তাই যারা জানেন তারা দেশের দূর-দূরান্ত থেকে এখানে আসেন।
মসজিদের আঙিনায়ই রয়েছে খাজা শাহবাজের মাজার শরীফ। এখানে নারীরাও আসতে পারেন। শুক্রবার জুমার নামাজের আগ পর্যন্ত ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মাজার শরীফে নারীদের প্রবেশাধিকার রয়েছে।
এক মসজিদ অনেক নাম
শায়েস্তা খান আমলের স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত নির্মাণ করা নান্দনিক এ মসজিদ নিয়ে প্রচলিত আছে নানা লোকগাথা। কেউ একে বলে জিনের মসজিদ, কারো কাছে পরিচিত জোড়া মসজিদ নামে। লোকশ্রুতি রয়েছে, খাজা শাহবাজ টঙ্গী থেকে এসে জিনদের নিয়ে এ মসজিদে নামাজ পড়তেন। সে জন্যই এর নাম হয় জিন মসজিদ। খাজা শাহবাজ মসজিদের পাশেই নিজের জন্য মাজার নির্মাণ করেছিলেন। মাজারের কাঠামোও প্রায় মসজিদের মতো। এ কারণে এটি জোড়া মসজিদ নামেও পরিচিত। আবার আগে দেয়ালের রং লাল থাকায় মসজিদটি ‘লাল মসজিদ’ নামেও পরিচিতি পায়।
গঠন
তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি ৬৮ ফুট দীর্ঘ এবং ২৬ ফুট চওড়া। এর মিম্বর এবং চৌকাঠ কালো পাথরের তৈরি। মসজিদের আঙিনাতেই খাজা শাহবাজকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধিসৌধ খাজা শাহবাজের দরগা নামে পরিচিত। মসজিদের চার কোণে চারটি অষ্ট কোনাকৃতির মিনার রয়েছে। পূর্ব দিকের দেয়ালে আছে তিনটি প্রবেশপথ। দক্ষিণ ও উত্তর দেয়ালে একটি করে দরজা রয়েছে। এ অঞ্চলে জলবায়ুর আর্দ্রতার কারণে মসজিদের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য দেয়ালে পাথরের আবরণ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি দরজার চৌকাঠ কালো পাথর দিয়ে তৈরি। ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে তিনটি আকর্ষণীয় মেহরাব আছে। প্রধান মেহরাবের অলংকরণ বেশ সুন্দর। মসজিদের পাশেই রয়েছে হাজী খাজা শাহবাজের মাজার ইমারত। এটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। মসজিদের স্থাপত্য নকশা মুসা খাঁ মসজিদ বা লালবাগ কেল্লার মসজিদের মতোই।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমান মসজিদটি অতটা জমজমাট নেই, হাইকোর্ট ও বাংলা একাডেমি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আশেপাশের এলাকার মানুষ মাঝে মাঝে এখানে নামাজ পড়তে আসেন বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান মসজিদটির খাদেম রাশেদ হাসান স্বপন। তবে জুম্মার দিনে মসজিদটি জমজমাট হয়ে ওঠে বলে জানান তিনি। কারণ ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসেন শহরের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ।
মসজিদটির একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে রয়েছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সদস্যসহ অন্যরা। তারাই এটি দেখভাল করেন। তাছাড়া মসজিদের দানবাক্সে যে অর্থ থাকে তা দিয়েই চলে কার্যক্রম।
প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছরের স্থাপনাটির স্থাপত্যশৈলী অটুটু থাকলেও বাইরের রঙে শেওলা ধরেছে। তবে নান্দনিক নকশা বিশিষ্ট ভেতরটা এখনও বেশ পরিপাটি।
যেভাবে যাওয়া যায়
তিন নেতার কবরের সামনের রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই মসজিদটির প্রবেশপথ। এই মসজিদকে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। তাতে মসজিদটির অনিষ্ট বা বিকৃত না করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। সাইনবোর্ড পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ডান দিকে গেলেই মসজিদ। বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাগোয়া এই মসজিদের কাছেই ঢাকা গেট, যার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল মসজিদ নির্মাণের ২০০ বছর পর। অনেকেই মনে করেন, শাহবাজের মসজিদটিই রমনা এলাকার প্রথম স্থাপনা।