এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের দৌড়ে আলোচনায় ছিলেন অনেকেই। শান্তি পুরস্কারের আশায় ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, জলবায়ু আন্দোলনকর্মী কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ, নিউজিল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠতম নারী প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরর্ডান ছাড়াও করোনার দুঃসময়ে অবদান রেখে চলা ফেভারিটের তালিকায় ছিলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।
কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১০১তম নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি।
শুক্রবার নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে নোবেল কমিটি এবারের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করে।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাত ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দুর্ভোগে থাকা মানুষের ক্ষুধা নিরসনে অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও, জাতিসংঘের এই অঙ্গ সংস্থা খাদ্য সুরক্ষাকে শান্তির উপকরণ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক সহযোগিতায় মূল ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধ ও সংঘাতের অস্ত্র হিসেবে ক্ষুধার ব্যবহারকে মোকাবেলা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করার জন্য জোরালো অবদান রেখেছে।
সাধারণত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বিশ্বের ৭৫টি সমস্যা-সংকটাপন্ন দেশের মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু ২০১৯ সালে সংস্থাটি তাদের নিয়মিত অবদানকে ছাড়িয়ে গেছে। ওই বছর বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ ও সমস্যাপ্রবণ ৮৮টি দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে খাদ্য সহাযতা দিয়েছে, যারা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও ক্ষুধায় জর্জরিত ছিলো।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি জানায়, ২০১৫ সাল থেকে ক্ষুধা নিরসন কর্মসূচি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলির মধ্যে একটি। ডব্লিউএফপি এই লক্ষ্যটি সর্বোত্তমভাবে উপলব্ধি করেছে এবং ক্ষুধা নিবারণে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্য সংকট পরিস্থিতি মারাত্মক নেতিবাচকতায় মোড় নিয়েছে। ২০১৯ সালে বিশ্বের ১৩৫ মিলিয়ন মানুষ তীব্র ক্ষুধায় ভুগেছে। যা বেশ কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সশস্ত্র যুদ্ধ ও সংঘাত।
নোবেল কমিটি আরও বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির সময় বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির আরও শঙ্কা জেগেছে। ইয়েমেন, গণতান্ত্রিক কঙ্গো, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, এবং বুরকিনো ফাসোর মতো দেশগুলোতে সহিংস সংঘাত ও মহামারির সংমিশ্রণে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই দুঃসময়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করেছে। তারা নিজেরাই ঘোষণা দিয়ে বলেছে যে, ‘শেষ অবধি আমাদের একটি একটি ভ্যাকসিন রয়েছে, বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে ভালো ভ্যাকসিন খাদ্য সহায়তা’।
নোবেল কমিটি বলছে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও অন্যান্য খাদ্য সহায়তা সংস্থা তাদের অবদানের মাধ্যমে সহায়তা না করলে অকল্পনীয় ক্ষুধা সংকটের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকতো সারা বিশ্বে। মূলত ক্ষুধা ও সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে যোগসূত্র আছে। যুদ্ধ ও সংঘাতের ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়। ক্ষুধা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সু্প্ত সংঘাতকে আরও উদ্দীপ্ত করতে পারে এবং সহিংসতা বৃদ্ধি করতে পারে। আমরা যদি যুদ্ধ ও সশস্ত্র সংঘাতের অবসান না ঘটাই তাহলে কখনোই ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী অর্জন করতে পারবো না।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি জোর দিয়ে জানায়, যে খাদ্য সুরক্ষা বৃদ্ধির জন্য সহায়তা প্রদান কেবল ক্ষুধারোধ করে না বরং স্থিতিশীলতা ও শান্তির সম্ভাবনা উন্নত করতেও সহায়তা করে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার দেশগুলোতে অগ্রণী প্রকল্পের মাধ্যমে শান্তি ও মানবিক পথে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের এই অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এই বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেছে।
“সংগঠনটি আলফ্রেড নোবেলের লক্ষ্য-দেশগুলোর ভ্রাতৃত্ববোধকে এগিয়ে নিতে নিত্যদিন অবদান রেখে চলেছে। জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বিশ্ব শান্তি স্থাপনের একটি আধুনিক সংস্করণ, যা নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকায় রাখতে সহায়তা করেছে”।
নোবেল কমিটির প্রত্যাশা, মানবজাতির কল্যাণে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রচেষ্টা আগামীতে আরও বেশি বিস্তৃত হবে।’।
কার্যকর কোনো সংস্থা হিসেবে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)-ই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রথম কোনও সংস্থা নয়। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ পুরস্কার পেয়েছিল।
এছাড়াও এর আগে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জিমি কার্টার, পাকিস্তানের নারী অধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাই, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান, নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র প্রমুখ।