সরকারের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না শেয়ারবাজারে। একের পর এক ধসে সূচক নেমেছে তলানিতে। অব্যাহত দর পতনে অক্টোবর মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক হারিয়েছে প্রায় ৩শ’ পয়েন্ট। কমেছে লেনদেনও। পুঁজি হারিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাই শেষ ভরসার স্থান হিসাবে সম্প্রতি তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে ২১ দফা দাবিও জানিয়েছেন।
তবে বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো ঢেলে সাজানো জরুরি হয়ে পড়ছে। নতুবা এই তলানি থেকে বাজারকে টেনে তোলা সম্ভব নয়। এছাড়াও ভালো কোম্পানি নিয়ে আসা, সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়াসহ প্রয়োজনীয় কয়েকটি ইতিবাচক উদ্যোগ নিলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন তারা।
পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করতে বিএসইসি পুনর্গঠনসহ ৪টি পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, প্রথমত,বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অন্যায় কাজে নিজেই জড়িয়ে পড়েছেন অথবা তারও অদক্ষতা রয়েছে। এ কারণে চেয়ারম্যানের উপরে মানুষের আস্থা নাই। এখন আস্থা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই কমিশনকে রেখে শেয়ারবাজারে গতি আনা সম্ভব নয়।
‘‘কিন্তু শুধু কমিশন পরিবর্তন করলেই হবে না, এক্ষেত্রে দক্ষ ও সৎ লোক বসাতে হবে। এর আগে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীও কমিশনের দায়িত্বে ছিলেন। তখন তো এই ধরনের অনৈতিক কাজ হয়নি। কারণ তারা শক্ত হাতে দমন করেছেন এবং কখনো ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত হননি। এখন বিনিয়োগকারিদের আস্থা ফেরাতে হলে এই ধরনের একজন দক্ষ ও চৌকস লোককে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে বসাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে বড় ধরনের একটি সিন্ডিকেট। যে কোনোভাবেই হোক এই সিন্ডিকেটকে ভেঙ্গে দিতে হবে।
তৃতীয়ত, সরকারের উদ্যোগে একটি ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ করা যেতে পারে। যেমন ভারতে পুঁজিবাজারে পতন হওয়ার পর তারা জাতীয়ভাবে ন্যাশনাল স্টক একচেঞ্জ গঠন করেছে। এরপর বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশেও এখন বাজারে ব্যাপক ধস নেমেছে। এই ধস মোকাবেলা করতে ভারতের আদলে একটি জাতীয় স্টক একচেঞ্জ বা ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ গঠন করা জরুরী হয়ে পড়ছে। এটি গঠন করলে ব্যবসায়ীদের যে সিন্ডিকেট রয়েছে তা ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব হবে।
চতুর্থত, আইন অনুযায়ী বিএসইসির বোর্ডে যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা কেউ ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ বা ব্যবসা করতে পারবেন না। কিন্তু বর্তমান কমিটিতে যারা রয়েছেন তাদের প্রায় ৪০ শতাংশ লোকই খেলোয়াড় অর্থাৎ ব্যবসার সাথে জড়িত এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। এসব লোকের কারণে বাকি ৬০ শতাংশ লোক নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না। তাই বোর্ড এবং খেলোয়াড় এই দুটোকে আলাদা করতে হবে।’’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বাজারে মূলত সমস্যা তৈরি হয়েছে ২০১৮ সালে। তখন উদ্যোক্তারা এবং প্লেসমেন্টধারীরা লাখ লাখ শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। সে কারণেই ৭/৮ মাস পরে বাজারে তার প্রভাব পড়ছে।
তিনি বলেন, বাজারে ভালো কোম্পানি আসছে না। আসছে দুর্বলগুলো। এ বছর অধিকাংশ কোম্পানিই গতবারের চেয়ে অনেক কম লভ্যাংশ দিয়েছে। অনেক কোম্পানি লভ্যাংশ দেয়নি। তাই বাজারে সূচক নিম্নগামী। তবে কৃত্রিমভাবে বাজারকে টেনে তোলা কোনভাবেই ঠিক হবে না।
“বাজার চাঙ্গা করতে ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসতে হবে। প্লেসমেন্ট বন্ধ করে উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রি দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ করতে হবে। এছাড়া বিএসইসিকে ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ বাজার ধসে তাদের চরম ব্যর্থতা রয়েছে।”
পুঁজিবাজার বিশ্লেষণকারী এবং ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জিয়াউর রহমানও মনে করেন ইতিবাচক কয়েকটি পদক্ষেপ নিলে সব অসুখ সেরে যাবে।
এর উদারহণ হিসাবে তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোয় যোগ্য, সৎ ও দেশপ্রেমিক দিয়ে নেতৃত্ব নিশ্চিত করা। পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা ও জরুরি ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
গত কয়েক মাস ধরে ভয়াবহ দর পতন চলছে শেয়ার বাজারে। গত অক্টোবর মাসে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক হারিয়েছে প্রায় ৩শ’ পয়েন্ট। কমেছে লেনদেনও। মাসজুড়েই প্রতি কার্যদিবসের ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২শ’ থেকে ৩শ’ কোটি টাকার। যদিও মাসের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেন ৪শ’ কোটি টাকা ছুঁয়েছে। এইদিন ৪০৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে। লেনদেন কিছুটা বাড়লেও সূচকের পতন অব্যাহত রয়েছে। ডিএসই ও সিএসই উভয় বাজারে প্রধান মূল্যসূচকের পতন হয়ছে।
এর মাধ্যমে গত সপ্তাহের ৫ কার্যদিবসের মধ্যে ৪ কার্যদিবসেই সূচকের পতন হয়েছে। বৃহস্পতিবার ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স দশমিক ৩০ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৬৮২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর ডিএসই-৩০ সূচক ৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৬২৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
পুঁজিবাজারের চলমান মন্দায় পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়প পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। একই সাথে দুর্দিন চলছে ব্রোকারেজ হাউজগুলোতেও। খরচ মেটাতে নীরবে কর্মী ছাঁটাই করছে তারা। কারণ লেনদেন থেকে পাওয়া কমিশনের ওপর ভর করেই মূলত ব্রোকারেজ হাউজগুলো চলে।
বাজারে গতি আনতে বিনিয়োগকারীরা গত ২৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিএসইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এসময় বাজারকে দাঁড় করাতে তারা ২১ দফা দাবিও জানান।