চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

যেভাবে চলচ্চিত্র পরিচালক হলেন হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ। তিন শতাধিক বই লিখেছেন। নির্মাণ করেছেন আটটি চলচ্চিত্র। লেখক থেকে চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার গল্প খুব একটা সুখকর না। কলম জাদুকর ছবি নির্মাণের পেছনের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন ‘ছবি বানানোর গল্প’ নামে একটি বই। বরাবররেই মতোই রসিকতা ও  আনন্দময় উপস্থাপনে নিদারুণ দুঃখের ঘটনাও হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য।

চ্যানেল আই অনলাইনের নতুন বিভাগ ‘স্যাটায়ার’ এ আজ থাকছে হুমায়ূন আহমেদের ছবি বানানো নিয়ে মজার কিছু ঘটনা।

হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র বানাবেন। আগুনের পরশমণি। ছবির প্রধান চরিত্র বদিউল আলমকে খুঁজছেন। একদিন শিল্পী ধ্রুব এষকে দেখে তিনি সেই চরিত্রের জন্য ধ্রুব এষকে পছন্দ করে ফেললেন। কারণ, বদিউল আলমের নির্লিপ্ত ভঙ্গি ধ্রুব এষের মধ্যে পুরোপুরিই আছে। প্রস্তাব শুনে ধ্রুব এষ বললেন, ‘অসম্ভব! আমি জীবনে অভিনয় করিনি।’
হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘তাতে কী? আমিও তো জীবনে সিনেমা বানাইনি।’

বাংলাদেশে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে তাকে পরিচালক সমিতির সদস্য হতে হয়। সদস্য হওয়ার গল্প হুমায়ূন আহমেদ তার বইতে লিখেছেন  এভাবে-
সব তো হয়ে গেল। এখন কাজে নেমে পড়া যায়। পঞ্জিকা দেখে শুভদিন বের করতে মহরত করে ফেলা যেতে পারে। সহকারী পরিচালক তারা চৌধুরীকে বললাম হুইসেল বাজিয়ে দিতে। সে দেখি কেমন আমতা আমতা করে। কিছু কি বাদ পড়ে গেল? সমস্যাটা কি? আমি তারাকে বললাম, আর কোন সমস্যা আছে?
সে বলল, স্যার আছে।
‘থাকলে বলে ফেল। সমস্যা পেটের ভেতর লুকিয়ে রাখলে আমি বুঝব কি করে?’
‘স্যার আপনার একটা পরীক্ষা দিতে হবে।’
‘আমার পরীক্ষা দিতে হবে মানে? কিসের পরীক্ষা?’
‘পরিচালক সমিতি আপনার একটা পরীক্ষা নিবে। আপনি পরিচালক হবার যোগ্য কিনা তা পরীক্ষা করে দেখবে। ওরা যদি যোগ্য মনে করে তাহলে আপনি পরিচালক সমিতির সদস্য হবেন, তখন ছবি পরিচালনা করতে পারবেন।’
‘কী ধরণের পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা?’
‘জ্বি না ভাইবা।’
‘বল কি তুমি। এই যন্ত্রণার কথাতো আগে শুনি নি। পরীক্ষায় তো আমি ডাহা ফেল করব।’
তারা চৌধুরী হাসি মুখে বলল, আপনি ফেল করলে আর কেউ পাশ করতে পারবে না…।

আমার প্রতি তারা চৌধুরীর বিশ্বাস দেখে আমার আনন্দিত হবার কথা। তেমন আনন্দ পেলাম না বরং কলজে শুকিয়ে গেল। ছবি পরিচালনায় আমার বিদ্যা বুদ্ধি শূন্য। এই বিদ্যা বুদ্ধি নিয়ে ধরা খেলে লজ্জার ব্যাপার হবে।

একটা ভরসা অবশ্যি আছে, আমার মত শূন্য বিদ্যা বুদ্ধি নিয়ে আমার আগে আরও অনেকেই ছবি করতে এসেছেন। এসে কাজ শিখেছেন। অসাধারণ ছবি বানিয়েছেন। আবার অনেকেই কিছুই শিখতে পারেন নি। তারাও শূন্য বিদ্যা বুদ্ধি নিয়েই করে খাচ্ছেন।

এক সকালে দুরু দুরু বক্ষে পরীক্ষা দেবার জন্যে পরিচালক সমিতির অফিসে প্রবেশ করলাম। তিনবার ‘ইয়া মুকাদ্দেমু’ বলে ডান পা প্রথমে ফেললাম। পরীক্ষার হলে ঢুকে সত্যিকার অর্থেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কুড়ি জনের মত পরীক্ষক (সবাই পরিচালক) গম্ভীর মুখে বসে আছেন। পরীক্ষা কমিটির সভাপতি চাষী নজরুল ইসলাম। সবার হাতেই কাগজ কলম। আমাকে নাম্বার দেয়া হবে। আমি মনে মনে খাস নেত্রকোনার ভাষায় বললাম, ‘আমারে খাইছেরে!’

এ জাতীয় পরিস্থিতিতে নিজের অজ্ঞতা শুরুতেই স্বীকার করে নেয়া ভালো এই মনে করে আমি শুরুতেই দীর্ঘ এক ভাষণ দিয়ে ফেললাম। ভাষণের সারমর্ম হচ্ছে–ছবি পরিচালনার আমি কিছুই জানি না। আমি শিখতে এসেছি। আমি খুব দ্রুত শিখতে পারি। আমি যখন কোন সমস্যায় পড়ব–আপনাদের কাছে যাব। আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন এবং শেখাবেন। এই ভরসাতেই ছবি পরিচালনার দুরূহ কাজে এসেছি।
আমার বক্তৃতায় তেমন কাজ হলো বলে মনে হলো না।

চাষী নজরুল ইসলাম সাহেব বোর্ড মেম্বারদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন আপনাদের যা প্রশ্ন আছে একে একে করুন।
পরীক্ষকরা নড়েচড়ে বসলেন। প্রথম প্রশ্ন করা হল।
‘হুমায়ূন কবীর সাহেব ছবি পরিচালনা বলতে আপনি কী বুঝেন?’
আমি বিনীত ভাবে বললাম, কিছু মনে করবেন না। আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ।
‘সরি আহমেদ সাহেব–আমার প্রশ্ন হচ্ছে ছবির পরিচালকের কাজটা আসলে কী?
আমি বললাম, ছবি পরিচালকের মূল কাজ হচ্ছে ক্রিকেট খেলার আম্পায়ারের মত একটা শাদা টুপি পরে হাসি মুখে চেয়ারে বসে নায়িকাদের সঙ্গে ফষ্টি নষ্টি করা।
আমার কথায় পরীক্ষকদের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। আমি বললাম, ভাই রসিকতা করছি। এটাতো নিশ্চয়ই ফরমাল কোন পরীক্ষা না। রসিকতা করার উপর বিধি নিষেধ নিশ্চয়ই নেই।
চাষী নজরুল ইসলাম বললেন, হুমায়ূন সাহেব প্রশ্নের জবাবটা দিন। পরিচালকের সংজ্ঞা দিন।
আমি যথাযথ গম্ভীর গলায় বললাম, আইজেনস্টাইনের মতে ছবি যদি স্টিম ইঞ্জিন হয় তাহলে পরিচালক হচ্ছেন সেই স্টিম ইঞ্জিনের স্টিম।
{আইজেনস্টাইন এই জাতীয় কথা কখনো বলেননি। আমি দেখলাম আমার অবস্থা শোচনীয়। ভারি কিছু কথা না বললে পার পাওয়া যাবে না। অন্যের নাম দিয়ে নিজের কথা বললাম। পরীক্ষায় রচনা লেখার সময় যে কাজটা অনেকে করে–রচনার মাঝখানে নিজের কথা বিখ্যাত কারো নামে চালিয়ে দেন–(এই জন্যে জনৈক বিখ্যাত কবি বলেছেন বলে নিজের দুর্বল দু’ লাইন কবিতা)}

আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করা হতে লাগল।
‘লেন্স কী?’
‘টপ শট কখন নেয়া হয়?’
‘কত ধরনের ক্যামেরা আছে?’
‘হাই স্পিড ফিলম কী?
‘সেকেন্ডে কটা করে ফ্রেম পার হয়?’
যা শুরু হলো তাকে হাস্যকর কর্মকাণ্ড ছাড়া আর কিছু বলার কোনই কারণ নেই। যারা প্রশ্ন করছিলেন তাঁরা তাদের অজ্ঞতার কথাই আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। একজন প্রশ্ন করলেন আউট অব ফোকাস কখন হয়। তিনি হয়তো জানেন না যে পদার্থ বিদ্যার একটি শাখা আছে যার নাম ‘অপটিকস’। লেন্স, তার ফোকাল লেংথ এইসব বিষয় অপটিকস এর অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ যা আমাকে পড়ে আসতে হয়েছে।

আমি আমার জীবনে অনেক হাস্যকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। এরকম হাস্যকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হই নি।
পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। জানা গেল আমি কোনোক্রমে পাশ করেছি। পরিচালকদের কেউ কেউ আমাকে ১০০র ভেতর শূন্য দিয়েছেন। আবার দু’ একজন ১০০ তে ৯০ দিয়েছেন। নম্বরের এরকম হেরফের কি করে হলো সেও এক রহস্য।
আমার রেজাল্ট খুব খারাপ হওয়াতে আমাকে সরাসরি পরিচালক সমিতির সদস্যপদ দেয়া হলো না। সহযোগী সদস্যপদ দেয়া হলো।

সেই ‘সহযোগী সদস্য’ হুমায়ূন আহমেদ একের পর এক বানালেন জাতীয় পুরস্কার পাওয়া সব চলচ্চিত্র।

সিনেমায় বড়  একটা চিন্তার বিষয় হলো বাজেট।
হুমায়ূন আহমেদ সিনেমা বানাবেন, টাকা প্রয়োজন। হঠাৎ মনে হলো, সরকার যদি সাহায্য করে, তাহলেই তো হয়ে যায়। তিনি তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। মন্ত্রী সব শুনে বললেন, ‘আপনি লেখক মানুষ। ছবি বানানোর আপনি কী জানেন?’
: আমি কিছুই জানি না। তবে আমি শিখব।
: শিখে ছবি বানাবেন?
: জি।
: নিজের ওপর আপনার এত বিশ্বাসের কারণ কী?
হুমায়ূন আহমেদ এবার দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘অন্যের ওপর বিশ্বাস করার চেয়ে নিজের ওপর বিশ্বাস করাটা ভালো না?’