চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

যেভাবে আইএসকে নিমন্ত্রণ করে প্যারিসে নিয়ে গেলো ফ্রান্স

দেশটিতে মুসলিমরা মোট জনগোষ্ঠির মাত্র ৯.৬ ভাগ। কিন্তু কারাবন্দীদের ৭০ ভাগই মুসলমান। কারাগারে বন্দী মুসলমানদেরকে আধ্যাত্মিক ধর্মীয় শিক্ষায় উদ্ধুদ্ধ করার কোনো ব্যবস্থাও নেই। কারাগার থেকে বের হয়ে মুসলমানদের একটি অংশ যে তাই জঙ্গিবাদী দীক্ষায় দীক্ষিত হতে পারে সেটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। সেই জঙ্গি বা তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে প্যারিসে ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞ তাই ফ্রান্স সরকারের কাছে অবশ্যই অনাকাঙ্খিত হলেও মোটেই বিস্ময়ের কিছু নয়।

প্যারিসে রক্তাক্ত শুক্রবারের পর প্যারিস কেনো আইএস বা ইসলামিক স্টেটের টার্গেট হলো সেই প্রশ্ন এখন ঢাকা থেকে ডাকার, লন্ডন থেকে লস এঞ্জেলেস, ক্যানবেরা থেকে কিংস্টন সব জায়গাতেই। পশ্চিমা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিতে আইএস বা এরকম জঙ্গি সংগঠনগুলো যে কোনো পশ্চিমা দেশের রাজধানীকে টার্গেট করবে বা করছে সেটা খুব সহজে বোঝা গেলেও প্যারিসই কেনো প্রথমে রক্তাক্ত হলো তার সুলুক সন্ধান তাই চলছে সর্বত্র।

সবারই প্রশ্ন: কেনো প্যারিস? কেনো প্রথমে প্যারিসই রক্তাক্ত?

এর সহজ উত্তর: যুক্তরাষ্ট্র প্রথম টার্গেট হলেও সেখানে নাইন ইলেভেনের পর এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটানোর মতো শক্তি জঙ্গিরা এখনো অর্জন করতে পারেনি। টুকটাক যে হামলার ঘটনা সেখানে ঘটে সেগুলো আইএস সমর্থক বা সহানুভূতিশীলদের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ, সুসংগঠিত কোনো জঙ্গি কার্যক্রম না। বিপরীতে প্যারিসে জঙ্গিরা সেই শক্তি অর্জন করতে পেরেছে।

ফ্রান্সের ভেতর থেকে এই শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপট যেমন তৈরি হয়েছিলো তেমনি তার বৈশ্বিক সামরিক কৌশলও সেই মঞ্চটাকে সামনে নিয়ে এসেছে। ফ্রান্সও যে এটা জানতো না এরকম নয়। তবে ঘরের ভেতরেই এমন হামলা তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবেলার কৌশলের জালটা পুরোপুরি বিস্তৃত করার আগেই হামলার ঘটনা ঘটে গেছে। জঙ্গিরাও জানতো, হামলার জন্য এটাই সেরা সময়।

প্যারিসে ওই হামলার সময় একজন বন্দুকধারী চীৎকার করে বলছিলো: সিরিয়ার জন্যই এই হামলা, সিরিয়াতে তোমরা যা করেছো এটা তার প্রতিশোধ।

তবে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ লড়াইয়ে ফ্রান্সের যে অবস্থান তাতে ওই জঙ্গি সিরিয়া না বলে অন্য নামও বলতে পারতো। বলতে পারতো মালি অথবা লিবিয়া কিংবা ইরাকের নাম। এর এক বড় কারণ বিভিন্ন জায়গা থেকে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির পিছিয়ে আসার খবরের মধ্যে জিহাদীদের বিরুদ্ধে সাফল্যে প্রকাশ্যেই গৌরবের কথা জানিয়ে আসছিলো ফ্রান্স।

সেই গৌরবের অংশ হিসেবে এ মুহূর্তে ১০ হাজার ফ্রেঞ্চ সৈন্য বিদেশে আছে। এর মধ্যে তিন হাজার আছে পশ্চিম আফ্রিকায়, দুই হাজার মধ্য আফ্রিকা এবং প্রায় সাড়ে তিন হাজার ইরাকে। মাত্র গত সপ্তাহেই প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ আইএসবিরোধী অভিযান জোরদার করতে পারস্য উপসাগরে এয়ারক্রাফট কেরিয়ার মোতায়েনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন।

এর আগে মালিতে ২০১৩ সালে ফ্রান্স আল কায়েদার বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালনা করেছিলো তাতে জঙ্গিরা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। মাত্র এক পক্ষ আগেই আল কায়েদা ইন দ্যা ইসলামিক মাগরেব (একিউআইএম) এর এক নেতা তার অনুসারীদের ওই অঞ্চলে ফরাসি সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে ফ্রান্সে প্রতিশোধমূলক অভিযান পরিচালনার ডাক দিয়েছিলেন।

সঙ্গে মনে রাখুন আইএস মুখপাত্র আবু মোহাম্মদ আল আদনানী তার সমর্থকদের যে কথা বলেছিলেন সেটাও। গত বছর তিনি তার সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছিলেন: তোমরা যদি একজন বিধর্মী আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান বিশেষ করে নোংরা, কদর্য এবং নির্মম ফরাসীকে হত্যা করতে পারো, তাহলে যেভাবে সম্ভব সেভাবেই সেটা করো।

শুক্রবার রাতে আইএস সেটা পেরেছে। এক বা দুইজন ফরাসী নয়, নিহতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১৩২। আইএসের শক্তিশালী অবস্থানের চারপাশের দেশ যেমন তুরস্ক, লেবানন বা মিশরের বাইরে এটাই আইএসের প্রথম বড় অভিযান। অন্যগুলো ছিলো বিচ্ছিন্ন, আইএস সমর্থক বা সহানুভূতিশীলদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ।

এভাবে নিজেদের অবস্থানের বাইরে পশ্চিমা বিশ্বে নিজেদের সশস্ত্র অবস্থান জানান দিতে প্যারিসই আইএসের প্রথম বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এখানে মনে রাখতে হবে যে জানুয়ারিতে শার্লি হেবদোর রক্তাক্ত ঘটনার জন্ম দিয়েছিলো আল কায়েদা।

তবে যে প্রেক্ষাপটে শার্লি হেবদোর উপর আল কায়েদার হামলা সেই একইরকম পরিপ্রেক্ষিতে শক্তি সঞ্চয় করে প্যারিসে আইএসের আঘাত। এবং সেটা ফ্রান্স, যারা আইএসকে প্রথম অপমানজনক ‘দায়েশ’ নামে ডাকা শুরু করে, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক রাজনীতি-রণনীতির সঙ্গে ঘরোয়া বিষয়ও কম ছিলো না।

বিশ্লেষণে এ তথ্যটাও রাখুন। দুয়েকজন ছাড়া ফ্রান্সের ব্যবসা এবং রাজনীতিতে মুসলিমরা খুবই অস্তিত্বহীন। বুরকা নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়েও মুসলমানদের প্রতি ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় সংশয়ও মুসলিমদেরকে আরো মানসিকভাবে দুর্বল করেছে যার প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে সবল এবং সশস্ত্র আক্রমণে।

দুটি বিষয়ই একসঙ্গে ঘটেছে। একদিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কারণে মুসলিমদের একটি অংশের দিকে রাষ্ট্রীয় সন্দেহ অমূলক ছিলো না। কিন্তু অন্যদিকে এই সন্দেহপ্রবণতা কয়েকজন থেকে পুরো সম্প্রদায়ের দিকে চলে যাওয়ার কারণে সেটা সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত অনেককেও জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

একটি তথ্য থেকেই সেটা অনেকটা বোঝা যাবে। রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্স কারো ধর্মীয় পরিচয় জিজ্ঞেস করতে না পারলেও বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ফ্রান্সে কারাবন্দীদের ৭০ শতাংশই মুসলিম যেটা যুক্তরাজ্যের জন্য ১৪ আর যুক্তরাষ্ট্রে সেটা সাড়ে ছয় শতাংশ।

এরকম অনেক উদাহরণ আছে যে ফ্রান্সে একজন মুসলিম যুবক সাধারণ অপরাধী কিংবা শুধু সন্দেহের বশে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেছে। মুক্তি পেয়ে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেকে জঙ্গি তালিকায় নাম লিখিয়েছে সে। এরকম ঘটার আরেক কারণ কারাগারে থাকার সময় যুক্তরাজ্যের মতো ইমাম বা ধর্মীয় নেতার মাধ্যমে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা না থাকা।

ফ্রান্সের সাবেক বিচারমন্ত্রী রাশিদা ডাটিও স্বীকার করেছেন, কারাবন্দীদের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে ফ্রান্স যথেষ্ট কিছু করছে না।

বেলজিয়াম হয়ে ফ্রান্সে সহজে অস্ত্র চলে যাওয়ার সুযোগের পাশাপাশি এভাবে ফ্রান্সেও জঙ্গি চিন্তাধারার একটি প্রজন্ম গড়ে উঠছে। আর এরকমটাই চায় আইএসসহ অন্য জঙ্গি গোষ্ঠি। তাদের এখনকার চাওয়া শুক্রবারের ঘটনার পর ফ্রান্স সরকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে আরো বেশি আগ্রাসী মনোভাব দেখাক যাতে মুসলিম তরুণরা আরো বেশি করে আইএসে যোগ দেয়।

এখন পর্যন্ত যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আইএসের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিতে সিরিয়া যাওয়া মার্কিনীর সংখ্যা কয়েক ডজন সেখানে ফরাসী নাগরিকের সংখ্যা ৫০০। প্যারিস হামলার তাই আরেক কারণ যে দমন-নির্য়াতনের শিকার হয়ে ফরাসী মুসলিমনরা আরো বেশি করে আইএসে নাম লেখাক।

রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনালকে ঠিক এমনটাই বলেছেন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ফরাসী বিশেষজ্ঞ জ্যাঁ-পিয়েরে ফিলি। তিনি বলেছেন: তারা এখন ফ্রান্স এবং ফরাসী সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ আশা করে। তারা চায় আমরা প্যারিসে এবং ফ্রান্সে মুসলমানদের হত্যা শুরু করি। তারা একটা গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থা চায়।

এরকম কিছু হয়তো হবে না। কিন্তু, ফ্রান্সে এখন পুলিশের প্রতিটি অভিযানে পাঁচজন গ্রেফতার হলে জন্ম নেবে নতুন একজন জঙ্গি। সেটাই চায় আইএস।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)