সেদিন সন্ধ্যার দিকে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে আগারগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখলাম একজন যুবক ওখানে বেশ বড় করে তৈরি একটি ডেকোরেশন ফলকের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলেন।
ঢাকা শহরে এটা তেমন কোন বিরল দৃশ্য নয়, কিন্তু আমার মনে হল লোকটি যেখানে দাঁড়িয়ে এই কাজটি সারছে, দেয়ালের ওপারে ঠিক সেখানেই আরবিতে ‘আল্লাহু’ কথাটি লেখা আছে। আমার ধারণা সত্য। পরদিন সকালে অফিস যাওয়ার পথে, আমি সেটাই নিশ্চিত হলাম। স্কুলের টয়লেটে বহুবার অন্য বইয়ের পাতার সাথে আরবি ও ইসলামিয়াত বইয়ের ছেঁড়া পাতা পড়ে থাকতে দেখেছি। ধর্মের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে এমনই হবে।
সদ্য দেখা দৃশ্যটি নিয়ে গেল প্রায় ২৩/২৪ বছর আগের একটি ঘটনায়। আমাদের এক আত্মীয় মারা যাওয়ার পর তার রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। মরহুমের বাসার দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে সারাদিন ধরে দোয়া দরুদ চলছিল। কুলখানি পর্যন্ত চলবে বলে কথা ছিল।
কিন্তু বাগড়া বাধালেন একজন মুরুব্বি আত্মীয়। উনি আরবি ভাষা খুব ভালো জানতেন। ভদ্রলোক লক্ষ করলেন ওই ঘরের ভেতর থেকে একই দোয়া বারবার পড়া হচ্ছে। কোরআন খতমতো হচ্ছে না। হঠাৎ ঘরে ঢুকে উনি আবিস্কার করলেন হুজুরদের দলটি দিব্যি একটা ক্যাসেট প্লেয়ার বাজিয়ে যাচ্ছে আর নিজেরা রেস্ট নিচ্ছে। তারপরের ঘটনা আর বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
ঘটনাটি বলার কারণ হচ্ছে ওই ভদ্রলোক আরবি ভাষাটি জানতেন বলেই গোলমালটি ধরতে পেরেছিলেন। কিন্তু আমরা এতগুলো মানুষ ওখানে ঘোরাফেরা করলেও এই ফাঁকি বুঝতে পারিনি, পারতামও না। কারণ আমরা শুধু আরবি পড়েছি, কিন্তু ভাষাটি শিখিনি।
আমরা যারা মুসলিম, ছোটবেলায় সবাই আরবি পড়তে শিখি কিন্তু ভাষা শিখি না, শুধু কোরআন শরীফ পড়ার জন্য আরবি শিখি। মানে না বুঝেই পুরো কোরআন শরীফ বারবার পড়ি, দোয়া দরুদ পড়ি, নামাজ পড়ি কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এর অর্থ বুঝি না বা বুঝতে চাইও না।
আমাদের এই না বোঝার সুযোগ গ্রহণ করে কিছু অসাধু মানুষ, যারা ধর্মকে বিক্রি করে খায়, এর থেকে সুবিধা গ্রহণ করে। আমরা ক্রমেই এদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছি। কারণ আরবি ভাষা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞানতা এবং নিজের ভাষায় ধর্মচর্চা না করা।
আরবি ভাষার প্রতি মুসলমানদের একটা আলাদা সম্মানবোধ কাজ করে। কারণ এই ভাষাতেই কোরআন শরীফ নাযিল হয়েছিল। রাসুল মুহাম্মদ (স:) এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। আর সেকারণে কোরআন শরীফ আরবিতেই নাযিল হয়েছিল যাতে উনি কোরআনের কথা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। আল্লাহতালা বলেছেন, “আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।” (সুরা ইবরাহিম, আয়াত: ৪)
এ থেকে একথাই স্পষ্ট যে ধর্মের বাণী যদি মনে না নেয়া যায়, তাহলে পুরোটাই বৃথা হয়ে যায়।
আরবি ভাষার যত্রতত্র প্রয়োগ করা মানেই কিন্তু একে সম্মান জানানো নয়। অথচ আমরা তাই করে যাচ্ছি। কেন এরকম একটি ডেকোরেশন পিসে আরবি লিখতে হলো? যার মর্যাদা আমরা দিতে পারছি না? কেন বাংলাদেশ বিমানের ভেতরে জরুরি তথ্য ইংরেজী আর আরবিতে লেখা, বাংলায় নয়! এদেশে কতজন মানুষ আরবি ভাষাটি জানেন? আরবিতো আমাদের অফিসিয়াল ভাষা বা সবার জন্য নিয়মিত বলা বা লেখার ভাষা নয়। তাহলে কেন এই ভাষা এভাবে ব্যবহার করছি? আল্লাহু লেখা যেখানে, সেখানে যুবক দাঁড়িয়ে ওই কাজ করার সাহস পায় কীভাবে?
আমাদের নবী বলেছেন: তিন কারণে তোমরা আরবিকে ভালবাসো, যেহেতু আমি আরবি ভাষায় কথা বলি, কোরআন আরবি ভাষায় লেখা আর জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি।
আমরা জানি তাওরাত কিতাব ইবরানি ভাষায় হযরত মূসা (আ:) এর উপর নাযিল করা হয়। জাবুর কিতাব ইউনানি ভাষায় হযরত দাউদ (আ:) এর উপর নাযিল করা হয়। ইঞ্জিল কিতাব সুরিয়ানি ভাষায় হযরত ঈসা (আ:) এর উপর নাযিল করা হয় । আর সর্বশেষ আসমানি কিতাব কোরআন আরবি ভাষায় সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর উপর নাযিল করা হয় ।
পবিত্র কোরআন কেন আরবি ভাষায় নাযিল করা হয়েছে, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ নিজেই বলেছেন এভাবে – “ইহা আমি অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।” (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ২)। তার মানে আরবদের কাছে আরবি ভাষাভাষী নবী ও আরবি কিতাব কোরআন শরীফ নাযিল করা হয়েছে, যেন তারা সেটা বুঝতে পারেন ও প্রচার করতে পারেন, কারণ তাদের মাতৃভাষা আরবি। অনারবি ভাষায় তা নাযিল করলে তাদের বুঝতে ও অনুসরণ করতে সহজ হবে না । (ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব: প্রথম আলো)
কাজেই যার কদর আমরা করতে পারবো না, তা শুধু লোক দেখানোর নিমিত্তে এইভাবে ব্যবহার করা কেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)