বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে একাত্তরের রণাঙ্গণের ফ্রন্ট ফাইটার হিসেবে যেসব মুক্তিযোদ্ধার নাম কিংবদন্তী হয়ে আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার বরিশাট গ্রামের মোল্লা নবুয়ত আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিনায়ক আকবর হোসেনের নেতৃত্বে মাগুরা অঞ্চলে গড়ে ওঠা শ্রীপুরবাহিনী তথা আকবরবাহিনী’র টুআইসি (সেকেন্ড ইন কমান্ড) ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে দক্ষতা, বিচক্ষণতা, সাহসে তিনি ছিলেন অনন্য এক বীরযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিরোচিত অবদান যেমন অতুলনীয় তেমনি তা আমাদের জনযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধও করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই সাহসী বীর, সবার শ্রদ্ধেয় মোল্লা নবুয়ত আলী ১০ ফেব্রুয়ারি ভোরে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন বার্ধক্যের কাছে হার মেনে। সেদিন কুয়াচ্ছন্ন ভোরে বরিশাটের নিভৃত আলয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের একটি নক্ষত্রের কেবল শারীরিক প্রস্থান ঘটেছে। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন রণাঙ্গনের সাহস আর সংগ্রামের তেজদীপ্ত সব গল্প। তাঁর প্রয়াণে সাধারণ জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধারা অন্যতম এক পদ প্রদর্শক হারিয়ে ফেলেছেন চিরকালের জন্য।
মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন সত্যিকার এক সাহসী বীর। মৃত্যুঅব্দি সেই সাহসী মুকুট তিনি মাথায় রাখতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে কখনই সরে দাঁড়াননি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নানা ঝড়ঝাপটা এলেও সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছেন। পিছপা হননি। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনী কর্তৃক তিনি মারাত্বভাবে নির্যাতিত হন। নির্যাতনের সেই ক্ষত তাঁর শরীরে ছিল। নির্যাতিত হলেও তিনি হারেননি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় মাগুরার রণাঙ্গনে ‘আকবর-নবুয়ত’ এই তেজদীপ্ত দুটি নাম ছিল প্রতিটি মানুষের মুখে মুুখে। অধিনায়ক আকবর হোসেন আগেই পরলোকগমন করেন। পাক হানাদারদের বন্দুকের নলের মুখ থেকে আপমর জনগণের বেঁচে থাকার মহা-প্রাণশক্তি ছিল দুটি নাম। এই দুই অভিভাবককে সামনে রেখেই প্রতিটি মানুষ পাকহানাদার আর তাদের দোষরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আকবর-নবুয়ত কিংবদন্তীই বটে। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে আহ্বান ছিল সেই আহ্বানের বাইরে এ দুজন একচুলও সরেননি।
আর তাই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর দুজনই বুক চিতিয়ে দাঁড়ান। সাধারণ জনগণকে সংগঠিত করেছেন মুহূর্তেই। সাহস আর দেশ স্বাধীন করার শপথ ব্যক্ত করে তরুণ যুবকদের নিয়ে অঞ্চলিক বাহিনী গড়ে তুলেছেন। আর যুদ্ধের পুরো সময় ধরে মাগুরা, ঝিনেদা অঞ্চলে পাকহানাদার নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছেন এই সাহসী জুটি।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুুক্তিযুদ্ধ-সব লড়াই-সংগ্রামে মোল্লা নবুয়ত ছিলেন অগ্রবর্তী একজন। তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বাধীন প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে থেকেছেন। পঞ্চাশ দশকে ছাত্রবস্থায় তিনি মাগুরা অঞ্চলের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, নেতৃত্বে থেকেছেন। ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা, ৬৯ এর গণ অভূত্থান, ৭০ এর নির্বাচন সবখানেই তিনি সক্রিয় থেকেছেন এবং জীবনবাজি নিয়ে লড়াই করেছেন। ষাট দশকে ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ মহকুমা শাখার নেতৃত্ব দিয়েছেন।
লেখাপড়া শেষে ভাল চাকরি পেলেও যোগ দেননি। জনগণের মাঝেই নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। মহাকুমা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতৃত্ব গুণে তিনি এতোটাই স্পর্ধিত ছিলেন যে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দলমত নির্বিশেষে কেউ অহেতুক টু শব্দ করার সাহস পেত না। সবাই তাঁর সামনে নত থেকেছে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়। জানাযার দিন তাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাতে জনশ্রোত নেমেছিল বরিশাট ঈদগাহ ময়দানে। এর আগে মাগুরাতে আরও একবার সবার উপস্থিতিতে প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর আঞ্চলিক বাহিনী কিছু বিরল ঘটনার জন্ম দেয়-যা ইতিহাস হয়ে আছে।
প্রথমত: যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রীপুর থানার গোটা অঞ্চল শ্রীপুর তথা আঞ্চলিক বাহিনীর সাহসী যোদ্ধারা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
দ্বিতীয়ত: এই বাহিনীর কারণে যুদ্ধকালীন পুরো সময়ে শ্রীপুর থানার কোনো গ্রামে স্থায়ীভাবে কোনো পাকহানাদার ও রাজাকার ক্যাম্প গড়ে উঠতে পারেনি। খুব সম্ভবত বৃহত্তর খুলনা বিভাগে এটিই ছিল ব্যতিক্রম ঘটনা। ফলে এটি ছিল মুক্তাঞ্চল।
তৃতীয়ত: এই বাহিনী কর্তৃক শ্রীপুর থানাতে হরিন্দী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেনকে বাহিনী কর্তৃক ওসি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
চতুর্থত: শৈলকূপা বালিয়াকান্দি, পাংশা, রাজবাড়ী, বোয়ালমারী, ফরিদপুরসহ আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সাধারণ মানুষের নিরাপদ স্থান ছিল শ্রীপুর। বহু পরিবার এসে তাই শ্রীপুরের বিভিন্ন গ্রামে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে। পঞ্চমত: শ্রীপুর থানা মুক্তাঞ্চল হওয়ার কারণে বিভিন্ন স্থানের শরণার্থীরা ভারতের বর্ডারে (বনগাঁও, করিমপুর, জাভা, গেদে) যাওয়ার জন্য শ্রীপুরের গ্রামগুলো নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করতো। এই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা শরণার্থীদের নিরাপত্তা রক্ষা করতেন এবং নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতেন। এরকম আরও ঘটনা আছে।
মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে মোল্লা নবুয়ত আলী ছিলেন বাঘ্র্য সদৃশ এক মানুষ। রাজাকার আর পাকসেনারা তাঁকে যমের মতো ভয় করতেন। যুদ্ধের শুরুতে মাগুরা-শ্রীপুর এলাকায় একশ্রেণীর ডাকাত দল লুটতরাজ, রাহাজানি, খুন-অপহরণ শুরু করলে অধিনায়ক আকবর হোসেন এবং সহ-অধিনায়ক মোল্লা নবুয়ত আলী মিলে সিদ্ধান্ত নেন সাধারণ জনগণের নিরাপত্তায় ডাকাত-লুটেরাদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। যে কথা সেই কাজ মোল্লা নবুয়ত আলী রাইফেল হাতে নেমে পড়েন। যুদ্ধের মাঝখানে ডাকাত সুরুজসহ কয়েকজনকে কুপোকাত করেন তিনি। এরকম আরও কত ঘটনা। পাকহানাদারদের কাছে তিনি ছিলেন যমদূত। আর তাইতো তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করেছিল পাকসেনারা।
প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি থাকতেন সামনে কাতারে। নেতৃত্বদানে তিনি ছিলেন অনন্য। গাংনালিয়ার যুদ্ধ, কাজলীর যুদ্ধ, শ্রীপুর থানা দখল-এরকম অসংখ্য যুদ্ধে তিনি সবার আগে থেকেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে তিনি কখনই পরাভূত হননি। মুক্তিযুদ্ধের পাঠ তিনি নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই। যে কথা আগেই বলেছি মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশ যে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে উঠে তাঁর প্রতিটিতেই তিনি সাহসের সাথে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ, কথা তিনি অনুসরণ করতেন।
২০১৫ সালের ২ মে অধিনায়ক আকবর হোসেন মারা যাওয়ার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা নবুয়ত আলী মাগুরা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করে আসছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে মুক্তিযোদ্ধারা যে তাঁদের গৌরবময় এক অহংকারকে হারিয়ে ফেলেছে তা বলাই বাহুল্য। বলতেই হয় মাগুরার মাটিতে একজন ক্ষণজন্মা বীর মুক্তিযোদ্ধা নবুয়ত মোল্লার আর দ্বিতীয়বার জন্ম হবে না। জ্ঞানে, নেতৃত্বে এবং বোঝাপড়ায়-এমন উচ্চতা সম্পন্ন মানুষেরা কেবলই হারিয়ে যাচ্ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)