চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মোনাজাতউদ্দিন, প্রেরণা হয়েই থাকুন

মোনাজাতউদ্দিন বেঁচে আছেন তার লেখনীর মাঝে। হাজারো পাঠক আজও তার শূন্যতা অনুভব করেন। অনুসারী আর সংবাদকর্মীদের মাঝে তিনি বেঁচে আছেন শিক্ষক হিসাবে। জীবদ্দশায় শিখিয়ে গেছেন। প্রয়ানের পরেও তার লেখা বইপত্র, আর সংবাদগুলো আমাদের বারবার সেই ধারায় নিয়ে যায়। হয়তো প্রতিবেদন লেখার আরও অনেক পরিকল্পনা ছিল তার। ইচ্ছে ছিল আরও কিছু দেওয়া। হয়নি সে আশা পূরণ। নিষ্ঠুর নিয়তি সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। মোনাজাতউদ্দিন আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু তার শতেক অনুসারী বেঁচে আছেন। তারাই হয়তো গ্রাম সাংবাদিকতার সেই আদর্শ সমুন্নত রাখতে এগিয়ে আসবেন। হ্যাঁ, আজ ২৯ ডিসেম্বর, চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ২৪তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৯৫ সালের এই দিনে আমাদেরকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চির বিদায় নেন তিনি। আমরা তাঁকে ভুলিনি। আজও তার লেখা থেকে শিখছি।

গ্রাম সাংবাদিকতার আকাশে ঝলমলে নক্ষত্র মোনাজাতউদ্দিন আজও অম্লান। তার লেখা প্রান্তিকের খবর ধাক্কা দিয়েছে কেন্দ্রে। গ্রামের খবরকে ঘিরে তার উপলব্ধি জাতীয় খবরের গণ্ডি ছুঁয়েছে। উত্তরের গ্রামীণ জনপদের সেই খেটে খাওয়া মানুষের খবরও জায়গা করে নিয়েছে জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায়; জাতীয় খবরের পাশে। খবরের গভীর অনুসন্ধান, অতি সহজ-সরল উপস্থাপন, পাঠকের বোধগম্য শব্দ আর বাক্য গঠনে বিশেষ পারদর্শিতায় মোনাজাতউদ্দিনের ঠাঁই হয়েছে পাঠক মনে। শুধু চোখের দেখা নয়, দেখার চোখ দিয়ে দেখেছেন তিনি। উপলব্ধি করেছেন অতি দরদ দিয়ে। আর তাই তার নিবিড় শব্দ-বুনন পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছে। তার বলপয়েন্টের ডগা থেকে নিউজপ্রিন্ট কাগজে এক একটি সংবাদ জীবন্ত হয়ে উঠতো। এই চারণ সাংবাদিকের খবরের ক্ষেত্র ছিল গ্রাম, যিনি অভাব-অনটন থেকে শুরু করে, সংকট-সম্ভাবনা আর দুর্নীতি অনিয়মের খবর প্রকাশের আলোয় নিয়ে এসেছেন। তিনি সৎ, নির্ভীক, নিষ্ঠাবান এবং কঠোর পরিশ্রমী সাংবাদিক হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। খবরের নেশায় গ্রামীণ জনপদের মাঠ-ঘাট চষে বেড়ানো প্রথিতযশা এই শেকড়ের মানুষটা সংবাদ সংগ্রহকালেই অকালে প্রাণ হারান।

তিনি সাংবাদিক, তিনি সাংবাদিকতার শিক্ষক। শুধু গ্রামের সাংবাদিক নয়, সকল স্তরের সাংবাদিকদেরই শেখার রয়েছে তার কাছ থেকে। মোনাজাতউদ্দিনের শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, সংবাদ-নির্মাণের পরিকল্পনা, এমনকি তথ্য সংগ্রহের কৌশল- সবকিছু থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত শিখছি। শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহার পাঠককে ঘটনার কাছে নিয়ে যেতো। কোন মানুষ সম্পর্কে বলতে গেলে মূল বিষয়ে বাইরে অসাধারণ একটা বিবরণ থাকতো, যাতে পাঠক সংবাদ পড়তে আগ্রহী হতেন। তার সংবাদে ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিছু শব্দ-বাক্য সংবাদকে করে তোলে আরও আকর্ষণীয়। লেখাতেই ফুটে ওঠে কতটা গভীর উপলব্ধি দিয়ে দেখেছেন তিনি। এখানেই দেখার চোখের বিশেষত্ব। সাধারণভাবে আমরা চোখ দিয়ে দেখি। দেখার চোখ আমাদের নেই বললেই চলে। আর এখনকার সাংবাদিকতায় দেখার চোখের খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না। গণমাধ্যম চায় তরতাজা গরম খবর। এর অধিকাংশই চলমান ঘটনা নির্ভর। দেখার চোখ দিয়ে দেখার সময় কোথায়?

গ্রাম সমাজের আসল চেহারা পাঠকের সামনে তুলে এনে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এক ভিন্নধারা যুক্ত করেছেন মোনাজাতউদ্দিন। কঠোর পরিশ্রম, প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতা অতিক্রমের ভেতর দিয়ে সারাক্ষণ কাজের মনোনিবেশ করেছেন তিনি। গ্রামীণ সমাজ-জীবনের অভ্যন্তরের ক্ষত তুলে ধরেছেন শহরের চশমা আঁটা পাঠকের সামনে। প্রশাসনের ঘাপলা, সরকারি বরাদ্দ বিতরণে অনিয়ম, সুবিধাভোগীর দাপট, ভূমিহীন মানুষের জীবনের লড়াই, খেয়ে-না খেয়ে জীবন অতিবাহিত করা মানুষের অধিকার-সবই নিপুণ দক্ষতায় তুলে এনেছেন খবরে। তৎকালীন সংবাদের পাঠকেরা তার একটি খবরের জন্য অপেক্ষা করতেন। পাঠকের চিন্তায় কাজ করতো, কাল সকালে মোনাজাতউদ্দিন নতুন কী নিয়ে আসছেন! শুধু সংবাদ লেখার মধ্যেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকতেন না। সংবাদের পেছনের গল্পগুলোও তিনি জানাতেন পাঠকদের। এক একটি সংবাদ তৈরির পেছনেও যেন রয়েছে বড় বড় গল্প। দিনের পর দিন অপেক্ষা একটি নতুন তথ্যের জন্যে। মোনাজাতউদ্দিনের লেখা ‘সংবাদ নেপথ্য’ ও ‘পথ থেকে পথে’ বইয়ে এমন অনেক গল্পের বিবরণ রয়েছে। সংবাদ সংগ্রহে কতটা কৌশলী হওয়া যায়, কত ধরণের বিকল্প অবলম্বন করা যায়, তা আমরা জানতে পারি এইসব বই থেকে।

পেশাগত জীবনে সত্য প্রকাশে কখনো আপোস করেননি মোনাজাতউদ্দিন। কোন ঘটনা ঘটলে, তা যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন, প্রকাশ করতেই হবে। সরকারি বরাদ্দ, ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের খবর, কালোবাজারির খবর লিখতে গিয়ে কোন পরিচিতজনের বিরুদ্ধেই হয়তো কলম ধরতে হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি আর সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে প্রতিবেদন লিখে বহুবার সংশ্লিষ্টদের চাপের মুখেও পড়েছেন মোনাজাতউদ্দিন। তবে অভিযোগ পেলে সত্যটা তুলে ধরেছেন তিনি। সোজাসাপ্টা বলে ফেলেছেন সব কথা। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেটা তার কাছে কোন বিষয় ছিল না। বিবেচনায় ছিল ঘটনাটি সত্য কীনা। দৈনিক সংবাদ-এ ‘সরেজমিন প্রতিবেদন-নাচোল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে মোনাজাতউদ্দিন লিখেছেন, ‘‘জমি জালিয়াতির ঘটনা চলছে নাচোলে। ধনী ও প্রভাবশালীরা বিভিন্ন পন্থায় বাগিয়ে নিচ্ছে সরকারি খাসজমি ও পুকুর। বেহাত হয়ে যাচ্ছে ঘোষিত ‘শত্রুতা সম্পত্তি’। এ অভিযোগ করেছেন রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিক্ষক; এমনকি অভিযোগ করা হয়েছে উপজেলা প্রশাসন থেকেও। তাদের অভিযোগের সুর শুনে মনে হয়েছে, ব্যাপারটা তাদের চোখের সামনে ঘটছে, অথচ তারা সবাই বড় অসহায়। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের ফাইলে জমা হয়ে আছে এ সংক্রান্ত শতাধিক অভিযোগপত্র, সাধারণ দরখাস্ত, কিন্তু এর একটিরও কোন ব্যবস্থা তিনি আজ পর্যন্ত নিতে পারেননি। ফাইলবন্দি হয়ে আছে বহু কৃষকের ফরিয়াদ।’’

শুধুমাত্র বর্ণনা দিয়ে পাঠককে ঘটনার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জাদুকর ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। এই বর্ণনা থেকে পাঠক তথ্য পেতে পারে। খবরটি পড়তে উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে। জাদুকরী বর্ণনাই যেন গ্রামের নিরন্ন, অপুষ্টিতে ভোগা, কংকালসার মানুষদের সেই সাদামাটা খবরগুলো যেন জীবন্ত হয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হতো। ‘শাহা আলম ও মজিবরের কাহিনী’ নামক বইয়ের কয়েকটি লাইন থেকে বাক্য গঠনের বিশেষত্ব ফুটে ওঠে। এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘ফিরোজা বেগমের মাথায় বাসন-কোসন ঠাসা একটা চটের বস্তা। কোথাও ফাটা, কড়াইয়ের কান কিংবা পাতিলের গোটা গোটা কালো তলা ঠেলে বেরিয়েছে। বস্তার কোন অংশে সুতলির ত্যাড়াব্যাড়া সেলাই। মহিলার আরেক হাতে কাঁথা কাপড়ের বোচকা। বিবর্ণ আগোছালো শাড়ি। হাতাফাটা ব্লাউজ। রগফোলা কবজিতে এক টুকরো সবুজ সুতো পেঁচানো। গলা ও বাহুতে একগুচ্ছ করে তাবিজ।’’

পাঠক হিসাবে এই কয়েকটি লাইন পড়লেই একটা চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ফিরোজা বেগম কীভাবে যাচ্ছেন, তা খুব সহজেই অনুভব করতে পারেন পাঠক। এ সবই মোনাজাতউদ্দিনের গভীর উপলব্ধির ফসল। যে কোন প্রতিবেদনই বলে দেবে সাংবাদিক ঘটনার কতটা গভীরে দিয়েছেন, কতটা উপলব্ধি করেছেন। নগর সাংবাদিকতাকে টেক্কা দিয়ে গ্রাম-সাংবাদিকতাকে নগরে পৌঁছে দিয়েছেন মোনাজাতউদ্দিন। তিনি দেখিয়েছেন শহরের চেয়েও অনেক বড় খবর থাকতে পারে প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামীণ খবরের শেকড়ে দৃষ্টি ছিল তাঁর। আর কোনভাবেই সেটা একদিনে হয়নি। প্রতিটি খবরের পেছনে তিনি সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন প্রচুর। উত্তরবঙ্গের বেশকিছু গ্রামের ওপর সিরিজ প্রতিবেদন লিখেছেন তিনি। আবার সেগুলোর ফলোআপও করেছেন। ছোট ছোট খবর; কিন্তু খুবই ধারালো।

প্রতিবেদন তৈরিতে পূর্ব-পরিকল্পনা যে কতটা জরুরি, তা মোনাজাতউদ্দিনের প্রতিবেদনগুলো পড়লে সহজেই অনুমান করা যায়। গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এই সাংবাদিকের প্রতিবেদন পরিকল্পনা ছিল গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই পরিকল্পনায় আগেই ঠিক করে নিতেন তার কী চাই? কোন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে, কোথায় সরেজমিনে যেতে হবে, কাদের সাক্ষাতকার নেওয়া হবে, কী কী ছবি লাগবে, সবকিছুই থাকতো এসব পরিকল্পনায়। আবার কোন কোন প্রতিবেদন তৈরির জন্য পরিকল্পনার আগেও মাঠ ঘুরে আসতেন, যাতে পরিকল্পনাটা সঠিকভাবে করা যায়। এভাবে কঠোর পরিশ্রমে নির্মিত হয়েছে এক একটি শক্তিশালী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। গ্রামের খবর নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন ছাড়াও মোনাজাতউদ্দিন উত্তরবঙ্গের নানান বিষয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন দৈনিক সংবাদে। এতে উঠে এসেছে উত্তরের গ্রামের সমাজ-জীবনের চিত্র। গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষকের ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চিকিৎসার বেহাল দশা, যুবকের স্বপ্ন, সমস্যা-সম্ভাবনা, শিল্প-সংস্কৃতি, এমনকি রঙলেপা গ্রামীণ সমাজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বহুমুখী অনিয়মের কাহিনী উঠে এসেছে তার প্রতিবেদনে।

ছোটবেলা থেকে সংগঠন করার ঝোঁক ছিল চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের। বাল্যকালে মুকুলফৌজের কর্মী হিসাবে যোগদানের মধ্যদিয়ে সামাজিক কর্মকান্ডে যুক্ত হন তিনি। আর সংবাদকর্মে যাত্রা শুরু হয় ‘বগুড়া বুলেটিন’-এ লেখালেখির মধ্যদিয়ে। ১৯৬২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আওয়াজ’-এর স্থানীয় সংবাদদাতা হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে উত্তরাঞ্চলের সংবাদ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন ‘দৈনিক আজাদ’-এ। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে নিজের সম্পাদনায় রংপুর থেকে বের করেন ‘দৈনিক রংপুর’। এক সময় ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-এ কাজ করেছেন। ১৯৭৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এর উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ পান তিনি। টানা কুড়ি বছর সেখানেই কাজ করেন। ‘দৈনিক সংবাদ’ থেকে পাওয়া নিয়োগপত্রে উত্তরাঞ্চলীয় স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে মোনাজাতউদ্দিনের বেতন ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’-এ সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে যোগ দেন তিনি। একই বছর ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

গ্রাম সাংবাদিকতায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এই সাংবাদিক আপদমস্তক একজন সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। শুধু সংবাদ লেখায় নয়, তার সৃজনশীলতা প্রকাশ পেয়েছে পত্রিকার প্রচ্ছদ অংকনে, কবিতা-ছড়া লেখায়, নাটক লেখায়। এমনকি পরিকল্পনা অনুযায়ী গুছিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি সৃজনশীলতার সাক্ষর রেখেছেন। অসাধারণ সুন্দর হাতের লেখার অধিকারী ছিলেন তিনি। মোনাজাতউদ্দিন রেডিও বাংলাদেশ রংপুর কেন্দ্রের একজন তালিকাভুক্ত নাট্যকার, গীতিকার ও কথক ছিলেন। মঞ্চ নাটকের রচয়িতা হিসাবেও তার সুনাম রয়েয়ে। শুধু রংপুরের মঞ্চে নয়, ঢাকার মঞ্চেও উঠে এসেছে তাঁর লেখা নাটক। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার।

ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সাদাসিধে নির্মোহ একজন মানুষ ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। সত্য গোপনের বিনিময়ে অন্য কোন লোভ কখনোই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বাংলাদেশের গ্রাম সাংবাদিকতায় নতুন ধারা সৃষ্টিকারী এই সাংবাদিকের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুরের গঙ্গাছড়ার হারাগাছের মরনিয়া গ্রামে। আর সাংবাদিকতার অঙ্গনে বিপুল শুন্যতা সৃষ্টি করে সবার মাঝে থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর। বাবার নাম মৌলভী আলিমউদ্দিন আহমদ। আর মা মতিজান নেছা। স্ত্রী নাসিমা আখতার ইতি। তিন ছেলেমেয়ের বাবা ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। দুই মেয়ে চৈতী আর সিঁথি ডাক্তার। আর একমাত্র ছেলে সুবর্ণ বুয়েটে অধ্যয়নকালে প্রাণ হারিয়েছেন।

খবর সংগ্রহের নেশায় উত্তরের পথ থেকে পথে ছুটেছেন মোনাজাতউদ্দিন। একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিদিনই পাঠকের সামনে হাজির হয়েছেন নতুন নতুন বিষয় নিয়ে। রঙলেপা সমাজের সামনে তুলে ধরেছেন নেপথ্যের পচাগলা সমাজের চিত্রটা। তার সংবাদ উপস্থাপনায় পাঠক কখনো মাথা নিচু করেছেন, আবার কখনো বা প্রতিবাদী হয়েছেন। এই ভিন্নধর্মী সাংবাদিকতার কারণে ব্যক্তিগত জীবনে মোনাজাতউদ্দিনকে অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়েছে। অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন মাঠে, পথে-প্রান্তরে, উত্তরের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হয়েছে তাকে। কখনো নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহের কাজ, আবার কখনো অফিসের এসাইনমেন্ট। মাসে ৫দিনও নিজের বাসা রংপুরের ধাপলেনে অবস্থান করতে পারেননি তিনি।

একজন জীবনবাদী, আশা নির্ভর, প্রাণবন্ত, উচ্ছল মানুষ এভাবে চিরবিদায় নিবেন, তা কারও কল্পনায়ই ছিল না। দৈনিক সংবাদ ছেড়ে দৈনিক জনকণ্ঠে যোগদানের বছর ঘুরতে পারেনি। এপ্রিলে যোগদান আর ডিসেম্বরে প্রয়াণ। কেউ প্রত্যাশা করেনি, এই সময়ে তার প্রস্থান ঘটবে। রংপুর শহরের মুন্সিপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছেন সাড়া জাগানো এই গ্রাম সাংবাদিক। মোনাজাত ভাই ঘুমিয়ে আছেন, বিশ্রামে আছেন, আমরা জেগে আছি। মোনাজাত ভাই বেঁচে আছেন আমাদের মাঝেই। থাকুন প্রেরণা হয়ে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)