অবশেষে মুখ খুললেন লিওনেল মেসি। কেটে গেল প্রাণের ক্লাব বার্সেলোনার সাথে লেগে যাওয়া তার জট পরিস্থিতি। অনড়ভাব কাটিয়ে আর্জেন্টাইন মহাতারকা জানালেন, আসছে মৌসুমে ন্যু ক্যাম্পেই থাকছেন।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে ব্যুরোফ্যাক্সের মাধ্যমে বার্সার সঙ্গে চুক্তির একটি বিশেষ শর্ত ব্যবহার করে ফ্রি ট্রান্সফারে ক্লাব ছাড়ার যে বার্তা দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন ফুটবল বিশ্বের মনোযোগ, শুক্রবার সেটি থেকে সরে আসার কথা জানালেন মেসি।
দশ দিন চলল মেসির দলবদল পরিস্থিতির স্নায়ুচাপ। আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড বার্সেলোনায় থাকছেন নাকি চলে যাচ্ছেন ন্যু ক্যাম্প ছেড়ে, সেটা পরিষ্কার না হলেও জয়টা বার্সার হতে চলেছে ইঙ্গিত মেলে বৃহস্পতিবার। দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ার আভাস মেলে।
বার্সা সভাপতি জোসেপ মারিয়া বার্তেমেউয়ের সঙ্গে প্রথমদফা আলোচনার পর মেসির বাবা ও এজেন্ট হোর্হে মেসি ইঙ্গিত দেন, আরেকটা মৌসুম কাতালোনিয়াতে কাটিয়ে দিতে পারেন ছয়বারের ব্যালন ডি’অর জয়ী মহাতারকা। শুক্রবার দ্বিতীয়দফায় আলোচনায় বসার কথা ছিল দুপক্ষের, তাতে মিলে যেতে পারে সমাধান পথ, এমন খবরও দেয় স্প্যানিশ সংবাদ মাধ্যমগুলো।
কিন্তু শুক্রবার শুরুটা হয় মেঘ জমার আভাস দিয়ে। বাবা হোর্হে পুত্র মেসির পক্ষে এক বিবৃতি পাঠ করেন। তাতে বেশ কড়া করে বলা হয়, মেসি চাইলে ফ্রি ট্রান্সফার ফিতে যেতে পারবেন। লা লিগা ও বার্সেলোনা বাই আউট ক্লজের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। ২০১৯-২০ মৌসুমেই মেসির ক্লজ শর্ত শেষ হয়ে গেছে।
এরপর আবারও কিছুটা শঙ্কিত সময়। সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি যদিও। মেসির বাবার বিবৃতির খানিক পরেই ইউরোপের সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়ে দেয়, মেসি অন্তত আরও একটা মৌসুম থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি সেটা প্রকাশ করবেন।
পরে ঘণ্টা দুইয়ের অপেক্ষা। শেষে মেসির মনোকাশে উদয় হওয়া সূর্যের দেখা মিলল, শেষ হয় অপেক্ষা প্রহরের। অচলাবস্থার শেষে মেসি জানান, চুক্তির সময়টা পূর্ণ করতে আসছে মৌসুমে বার্সাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে অবশ্য একটা বিষয় পরিষ্কার, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই থেকে যাচ্ছেন ন্যু ক্যাম্পে। আসলে চলেই যেতে চেয়েছিলেন।
বরফটা গলল শুক্রবার। মেসি ২০২০-২১ মৌসুমটা বার্সেলোনায় থেকে যাওয়ার কথা জানান সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। তাকে আদালতে নেয়ার কথাও বলেছিল বার্সা। কিন্তু প্রাণের ক্লাবের সঙ্গে বিচ্ছেদটা আইনি লড়াই পর্যন্ত গড়াতে দিতে চাননি, থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সেজন্যই, এটিও জানিয়েছেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড।
বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ক্লাব সভাপতি সবসময় বলত মৌসুম শেষে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারব, থাকব নাকি চলে যাব। ভেবেছিলাম এবং নিশ্চিত ছিলাম, চাইলে ক্লাব ছাড়ার স্বাধীনতা পাব। সেটি হয়নি।’
‘এখন আমি বার্সেলোনায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ সভাপতি আমাকে বলেছেন, ক্লাব ছাড়তে হলে ৭০০ মিলিয়ন রিলিজ ক্লজ পরিশোধ করেই কেবল আমাকে যেতে হবে, এবং সেটা অসম্ভব।’
১০ জুনের আগে কেনো চলে যাওয়ার কথা জানাননি মেসি? যেটা চুক্তিতে বলা আছে। সেটি নিয়ে বললেন, ‘এখন তারা বলছে আমি ১০ জুনের আগে চলে যাওয়ার কথা জানাইনি। সেসময় আমরা লা লিগার জন্য লড়ছিলাম করোনা ভাইরাসের মধ্যে, এবং এই ভাইরাসটি মৌসুমের সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছিল।’
‘আরেকটা পথ ছিল, আদালতে যাওয়া। কিন্তু আমি কখনোই বার্সার বিপক্ষে আইনি লড়াইয়ে যাব না, কারণ এই ক্লাবকে আমি ভালোবাসি, এই ক্লাবটি আমাকে সবকিছু দিয়েছে। এই ক্লাবটি আমার জীবন, এখানে আমি জীবন গড়েছি। আমি জানি, আমার মন বার্সাকে আদালতে নিতে কখনোই সায় দেবে না।’
অচলাবস্থা কাটতে শুরু করেছিল মেসির বাবা বার্সেলোনায় এলে। নিজ ফ্ল্যাটে ক্লাব সভাপতি জোসেপ মারিয়া বার্তেমেউয়ের সঙ্গে বুধবার আলোচনায় বসেছিলেন হোর্হে মেসি। তার সঙ্গে ছিলেন আরেক ছেলে, তথা মেসির ভাই এবং উপদেষ্টা রদ্রিগো মেসি। বার্তেমেউয়ের সঙ্গে ছিলেন বোর্ডের একজন পরিচালক হাভিয়ের বোর্দাস।
আলোচনায় বার্তেমেউ একটা কথাই বারবার পুনরাবৃত্তি করেছেন, কোনো অবস্থাতেই তারা মেসিকে যেতে দেবেন না। বরং মেসিকে ঘিরেই ভবিষ্যতের নতুন বার্সা গড়ার পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে এবং তিনিই হবেন এর মূল স্তম্ভ। আর মেসি যদি যেতেই চান, তাতে যেকোনো ক্লাবকে বিনিময়ে ৭০০ মিলিয়ন রিলিজ ক্লজ পরিশোধ করতেই হবে। কোনভাবেই তাকে বিনা ট্রান্সফার ফিতে যেতে দেয়া হবে না।
বার্সার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এমুহূর্তে দলবদল করা উচিৎ হবে না তাদের অধিনায়কের। বরং তাদেরকে একটা মৌসুম সময় দেয়া হোক, মেসিকে ঘিরেই তাদের ভবিষ্যৎ বার্সা গড়ে তোলা হবে। যদি সামনের মৌসুমেও দল মনের মতো না হয়, তখন না হয় বিনা ট্রান্সফার ফিতেই চলে যাবেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা।
হোর্হে মেসি তখন বুঝিয়ে দেন, তার ছেলে আর কিছুতেই ন্যু ক্যাম্পে খেলতে নামছেন না। রোজারিও থেকে এল প্রাত বিমানবন্দরে নেমেও তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তার ছেলের বার্সায় থাকা খুব কঠিন।
সেসব কথার পরপরই আবার মিডিয়াসেটকে অন্য কথা বলেন হোর্হে। আলোচনা শেষে মেসির বাবার বক্তব্য, সবকিছু ঠিক আছে। আলোচনা সফল! তাহলে ২০২১ সাল পর্যন্ত মেসি থাকছেন বার্সাতে? এমন প্রশ্নের উত্তরে হোর্হের জবাব ছিল একশব্দে, ‘হ্যাঁ’! তখনই বোঝা যায় বরফ গলছে।
মেসির ন্যু ক্যাম্প ছাড়ার গুঞ্জন অবশ্য গত কয়েকমাস ধরেই আলোচনায়। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টারে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে ৮-২ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর সেই পালে জোর হাওয়া লাগে। বার্সা নতুন কোচ হিসেবে ডাচম্যান রোনাল্ড কোম্যানকে নিয়োগ দেয়। এর কয়েকদিনের মধ্যেই দল পুনর্গঠনের নানা আলোচনার মাঝে বিরক্ত হয়ে পড়া মেসি ব্যুরোফ্যাক্সের মাধ্যমে কর্তাদের জানিয়ে দেন ক্লাব ছাড়তে চান।