মুসলিম বিশ্বের সারা বছরব্যাপী উৎসবের মধ্যে ঈদ অন্যতম। ঈদের আনন্দ ও উৎসব উপলক্ষে ধনী গরিবের মধ্যে প্রচলিত বিভেদ অনেকটা কমে আসে। তাই ঈদের জন্য সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে অস্ফুট আকাঙ্ক্ষা পরিলক্ষিত হয়। ঈদকে সামনে রেখে নানা শ্রেণির-পেশার মানুষের নানামুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা থাকে। সেই জন্য একটা সময় নিয়ে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়। আবার কেউ কেউ আছে ঈদকে সামনে রেখেই ব্যবসা বাণিজ্য ও অন্যান্য প্রচলিত পরিকল্পনা করে থাকে। কে কি করবে, কাদের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করবে, ঈদের খরচ ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিকল্পনার মধ্যে থাকে।
তবে একটা বিষয় সকলের মধ্যে দেখা যায় তা হল: ঈদের আনন্দকে পরিপূর্ণতা দিতে গ্রামের বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে একসাথে ঈদের ছুটি কাটানো ও উপভোগ করা। পরিবারের সিনিয়র জুনিয়রদের মধ্যে মিলনমেলার আয়োজনও হয়ে থাকে। পারস্পারিক শেয়ারিং, কেয়ারিং, পারিবারিক দায়িত্ববোধ, বিবেকবোধ ইত্যাদি বিষয়ের মিশেল দেখা যায়। এই ধরনের অনুষ্ঠান সকলের কাছে পার্থিব হিসেবে আবির্ভূত হয় বিশেষ করে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য।
তবে সকলের আনন্দ বিমর্ষ হয়ে ধরা দেয় যখন কোন ধরনের অপার্থিব দুর্ঘটনায় কারোর কোনরূপ ক্ষতি হয়ে থাকে। বলতেছি সড়ক দুর্ঘটনার কথা। সড়ক দুর্ঘটনা প্রত্যয়টি বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বিভীষিকাময় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মৃত্যুর মিছিলে মিলতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিদিনই বাংলার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দেখলে গা শিউরে উঠে ভয়াবহতায়। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া মানুষটি অন্যের নির্ভরতায় বেঁচে থাকে। এভাবে বেঁচে থাকলে আহত মানুষটি নিজের উপর বিতৃষ্ণার পাশাপাশি নানা রকম মানসিক সংকট নিয়ে বেঁচে থাকে। পরিবারের বোঝা হয়ে জীবনধারণ করা কারোরই কাম্য হতে পারে না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৩৯৭ (সাত হাজার তিনশত সাতানব্বই) জন মানুষ মারা যায় এবং আহত হয় ১৬১৯৩ জন (ষোল হাজার একশত তিরানব্বই)। যে উপার্জনক্ষম মানুষগুলো মারা গিয়েছে তাদের পরিবারের অবস্থা বেশির ভাগেরই শোচনীয় হওয়ার কথা।আবার যারা কোনমতে বেঁচে আছে, তাদের অবস্থাও নাজুক পর্যায়ের। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায় তা হল: দেশের মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৮ শতাংশ গণমাধ্যমে এলেও তার শতকরা ৪০ শতাংশ প্রকাশিত হয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটে তার সবগুলো প্রকাশিত হয় না, অপ্রকাশিত থেকে যায় একটি বড় অংশই। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আমরা যা জানি তার থেকে অনেক বেশি।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃতি হল: পথচারীকে চাপা দেওয়ার ঘটনা, বাস-ট্রাক-বাস-লেগুনা-প্রাইভেটকার-মোটর সাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, খাদে পড়া, পিছন থেকে ধাক্কা দেওয়া, চাকায় ওড়না পেঁচানো, বেপরোয়া গতির কারণে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি উপায়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। প্রকৃতিগুলো বিবেচনা করলেই সড়ক দুর্ঘটনার কারণ সম্বন্ধে প্রতীয়মান হওয়া যায়। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপদজনক ওভারটেকিং, রাস্তা ঘাটের ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রীদের অসচেতনতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন (সম্প্রতি মাদক বিরোধী দেশ বিরোধী অভিযানের সময় জানা যায়, চালকদের একটি বড় অংশই মাদক সেবন ও পাচারজাত এবং বাজারজাতের সাথে জড়িত), রাস্তাঘাটের নির্দেশনা মেনে না চলা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। আমরা যেহেতু কারণগুলো জানতে পেরেছি, প্রতিকারের ও প্রতিরোধের উদ্যোগ নিলে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের রক্ষা করা যাবে। আবার গবেষণায় জানা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব সচেতন হলেই। তবে এই সচেতনতা যাত্রী, চালক, যথাযথ কর্তৃপক্ষ সকলকেই হতে হবে। তা না হলে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি ঈদকে সামনে রেখে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে পরিবহন চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। ঈদ বোনাসের নামে যাত্রীদের নানাভাবে ভোগান্তি শুরু করে থাকে পরিবহণ শ্রমিকেরা। নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যাত্রীদের যাতায়াতে বাধ্য করে থাকে পরিবহন সেক্টরের সাথে যুক্ত সংগঠনগুলো। অতিরিক্ত ভাড়া কেন আদায় করছেন? এ মর্মে শ্রমিক সংগঠনের কোন নেতার সাথে যোগাযোগ করলে হাসিমুখে চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করে থাকে। প্রতিউত্তরে আরো বলে থাকে: বছরে দু একটা ঈদের বোনাস না পেলে পরিবহন শ্রমিকেরা কিভাবে চলবে? যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, ঈদ বোনাস নেওয়া (জোর করে) ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। অর্থাৎ যাত্রীরা তাদের কাছে জিম্মি।
ঈদে অতিরিক্ত যাত্রীর ভার বহন করতে না পেরে এবং প্রতিযোগিতামূলক ড্রাইভিং এর কারণে অনেক গাড়ীই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে। কোন নিয়মকানুনের বালাই থাকে না ঈদ যাত্রাকে সামনে রেখে। গাড়ীতে ৪২ সিটের ব্যবস্থা থাকলেও যাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় একশতে। প্রত্যেক রাস্তায় চলমান গাড়িগুলোতে এ চিত্রই দেখা যায়। কিছু যানবাহনে ব্যতিক্রম থাকলেও ভাড়ার পরিমাণ নির্ধারিত এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। বিষয়টা এমন: যাত্রীরা খুবই অসহায়! পাশাপাশি একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, পরিবহন মালিকরা সারাবছর গাড়ি সংক্রান্ত রাস্তা ঘাটে যে রকম উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; (সন্ত্রাসী এবং বিভিন্নজনকে ঘুষ প্রদান) সব ক্ষতিপূরণ সাধারণত ঈদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের মৌসুমে যাত্রীদের কাছ থেকে সুকৌশলে আদায় করে থাকে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন হতে হবে এবং রমজানের মাহাত্ম্যে আত্মশুদ্ধি ও আত্মমুক্তির পথ খুঁজতে হবে।
সুতরাং উৎসবের রঙকে আনন্দের আতিশয্যে রাঙিয়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা ও ইতিবাচক মানসিকতার বিকল্প নেই। একবার ভাবা যায়, দুর্ঘটনায় নিহত মানুষটি যদি নিজের পরিবারের সদস্য হয় তাহলে ঈদের আনন্দ বলতে কিছু কি থাকে? শোকের চাদরে মোড়ে থাকে সমগ্র পরিবারটি। তাই মৃত্যুর মিছিল থেকে এবারের ঈদকে দূরে রাখার জন্য যাত্রী সহ সকলকে যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সময় বাঁচাতে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে বাস কিংবা লঞ্চে ভ্রমণ করা কোনভাবেই সমীচীন হবে না। তাছাড়া একটি মৃত্যু একটি পরিবারের জন্য সারাজীবনের কান্না হয়ে উঠে। আশা রাখবো, যাত্রী সাধারণ আরও বেশি সচেতন হয়ে রাস্তা ভ্রমণ করবেন। সকলের ঈদ যাত্রা নিরাপদ হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)