স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ, নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের পর হত্যা এসব ঘটনা এখন নিত্যদিনের। সাম্প্রতিক কিছু পরিসংখ্যানও বলছে- অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ধর্ষণ বেড়েছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন- সারাদেশে ধর্ষণের মহামারী চলছে।
সাভার, সিলেট বা নোয়াখালীতে বিভৎস ঘটনার পর যৌন-নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই ধর্ষণের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও অনেকেরই প্রশ্ন- এতে কি দেশে ধর্ষণের ঘটনা কমবে? আদৌ কি সর্বোচ্চ এ সাজা ধর্ষণ প্রবণতা কমাতে পারবে?
এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বললেন, ‘ভারতে নির্ভয়াকাণ্ডের পরে আইন করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো তারপর সেদেশে ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুণ হয়েছে।’
‘‘নির্ভয়ার ওই ঘটনার মতো অনেক ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটেছে। আমাদের দেশে ভালো ঘটনার অনুকরণের নজির কম, খারাপটা বেশি। মৃত্যুদণ্ডের সাজা হলেই যে ধর্ষণ কমে যাবে তা নয়; এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অসংখ্য সমস্যা আছে। আইনগত, প্রক্রিয়াগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক- বস্তুত এই চার রকম সমস্যার সমাধান যদি না করা হয় তাহলে তা ধর্ষণ প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা রাখবে না।’’
ধর্ষকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক সংশিষ্টতা রয়েছে। আর যাদের পেছনে তেমন কেউ নেই বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই- তারা হয়তো শাস্তি পাচ্ছে। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধর্ষকদের যদি রাজনীতি থেকে বহিস্কার না করা হয়, বিচারের মুখোমুখি করা, শাস্তি নিশ্চিত করা না হয় তাহলে সমাধান হবে না। আবার এসব ঘটনার ক্ষেত্রে অনেকে হয়তো মন থেকে সাক্ষী দিতে চান, কিন্তু বাস্তবতা তা হতে দেয় না। কারণ সাক্ষীর কোনো সুরক্ষা নেই। হয়তো তাকে হত্যা বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে তাকে।’
সুদীর্ঘ সময়ে ধর্ষণের সংজ্ঞাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, ‘মাদ্রাসায় যেসব ধর্ষণের কথা আসছে- সেগুলোকে এখনো আইনে ধর্ষণ বলে ধরাই হচ্ছে না। সেটাকে আনন্যাচারাল অফেন্স বলে মনে করা হচ্ছে। এখন তো সেটাকে ধর্ষণই বলতে হবে। এখন তো প্রায়ই কোনো না কোনো মাদ্রাসার ধর্ষণের কথা সামনে আসছে।’
‘‘বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে কোনো আইন নেই, কিন্তু বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অনেক মামলা আসছে। এখন মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হলে অনেকেই সেটা করবে না। ভাববে, যাকে এক সময় পছন্দ করতাম তার মৃত্যু হয়ে যাবে। অনেকে আবার এই আইনের অপব্যবহারও করবে। কারো বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করে হয়তো অনেকে ধর্ষণের মামলা করবে, দুই-তিনটা সাক্ষীও সাক্ষ্য দিয়ে বলবে ‘ওমুক ব্যক্তি ধর্ষক’। ফলে অনেক নিরপরাধীর সাজা হওয়ার শঙ্কাও থাকবে।’’
ফেসবুকে লেখালেখি আর শাহবাগে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের এমন একটা প্রতিশোধমূলক আইন করা ঠিক না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, জনতুষ্টির কথা না ভেবে রেশনাল চিন্তা করতে হতো।’
তাই সমাধান হিসেবে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বললেন, ‘অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না- এই বার্তাটা সবাইকে বোঝাতে হবে। তাতে সাজা মৃত্যুদণ্ড হোক বা যাবজ্জীবন হোক।’
তবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কথাটার পরিবর্তে, আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড বলার পক্ষপাতি এই আইনজীবী বলেন, ‘কারণ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড শব্দটি নিয়েই অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। সে তো মৃত্যুদণ্ডে তেমন সাজা ভোগ করবে না। সে সারাজীবনের জন্য মেয়েটার যে ক্ষতি করে গেলো তা কয়েক মিনিটে শেষ।’
‘‘তার চেয়ে কারাবন্দী থাকলে সে দেখবে পৃথিবীর সবকিছুর বয়স বাড়ছে। কিন্তু কোনো কিছুর রূপ-রস-গন্ধ সে নিতে পারছে না। এটা যে কত বড় শাস্তি; তা আমরা করোনাকালে কয়েক মাস ঘরে আটকে থেকেই তো বুঝেছি।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, সামাজিক-রাজনৈতিক-আইনী জটিল এবং ভয়াবহ সমস্যাগুলোর সমাধানে এডহক ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তাতে সুফল আসবে না।
‘‘আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়ে ধর্ষণ সমস্যার কোনো সমাধান হবে বলে মনে হয় না।’’
রাজপথের দাবি-দাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র ও সমাজে মহামারী বা কর্কট রোগের মতো কোনো সমস্যা- যেমন ধর্ষণ, প্রতারণা, সড়ক দুর্ঘটনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বেহাল অবস্থা; এসব বিষয়ে সমাধানের জন্য সকল স্টেকহোল্ডার ও বিষয়ভিত্তিক এক্সপার্টদের দিয়ে সমস্যাটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।’
‘‘নির্মোহ গবেষণা এবং প্রামাণিক তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র ও প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তার বদলে ফেসবুক পোস্ট এবং রাজপথে উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র কিংবা প্রশাসন যদি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার ফল হিতে বিপরীত হবে।’’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রসঙ্গ টেনে এই অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, ‘মনে রাখতে হবে যে, মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর বিধান থাকার পরও বহুদেশ জঘন্য ধরনের অপরাধসমূহ থেকে মুক্ত হতে পারছে না। আবার মৃত্যুদণ্ডের বিধানই নেই এরকম বহুদেশ রয়েছে যেখানে অপরাধ সংঘটনের হার একেবারেই অপ্রতুল। যেমন নেদারল্যান্ডস এরকম একটি দেশ যেখানে মৃত্যুদণ্ডের কোন বিধান নেই -অথচ এ দেশটি কারাগারে পুরে রাখার মতো কোন অপরাধী খুঁজে পায় না ‘
‘‘এর রহস্য কি? এর রহস্য কঠোর আইন প্রণয়নের মধ্যে লুকিয়ে নেই, বরঞ্চ লুকিয়ে রয়েছে কঠোর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্যে। প্রচলিত আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলেই হলো। বিদ্যমান আইনে কোনো অপরাধের শাস্তির বিধান অপর্যাপ্ত হলেও হতে পারে। কিন্তু বিচার বিভাগকে যদি দুর্নীতি ও যেকোনো ধরনের প্রভাবের উর্দ্ধে রাখা সম্ভব হয় তাহলে সব ধরনের অপরাধমুক্ত রাষ্ট্র নির্মাণ সম্ভব।’’
এই সমস্যার সমাধানে এই তিনি মনে করেন, ‘তাড়াহুড়ো করে মৃত্যুদণ্ডের মতো এন্টিবায়োটিকের ব্যবস্থা না করে সরকারের উচিত ছিল সমাজবিজ্ঞানী, পুলিশ কর্মকর্তা, অপরাধ বিজ্ঞানী, আইনজীবী, সাংবাদিক, আমলা, আইনের অধ্যাপক ও বিচারপতিদের নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা।
কমিটির টার্মস অব রেফারেন্স হবে- ধর্ষণের মহামারী হয়ে ওঠার কারণ নির্ণয় ও এটি সমাধানে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করা।’