কায়রোতে আদালতকক্ষে মামলার বিচার চলাকালে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে সেখানেই মারা যান মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। সরকার এ মৃত্যুকে স্বাভাবিক বললেও অনেকেরই অভিযোগ, এর মধ্যে ‘কিন্তু’ রয়ে গেছে।
কী হয়েছিল আদালত কক্ষে
নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিস্ট আন্দোলন সংস্থা মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মুরসিকে সোমবার গুপ্তচরবৃত্তির মামলার শুনানিতে হাজিরা দিতে আদালত কক্ষে নেয়া হয়েছিল।
কাচের তৈরি খাঁচার মতো কাঠগড়ার ভেতর দাঁড়িয়ে তিনি মিনিট পাঁচেক কথা বলেন। তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন মুরসি। হাসপাতালে নেয়ার পর তাকে স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে মৃত ঘোষণা করা হয়।
মৃত্যুর কারণ নিয়ে বক্তব্য-অভিযোগ
মিশরের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে মুরসির মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট অ্যাটাকের কথা বলা হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানিয়েছেন, প্রাথমিক পরীক্ষায় মুরসির দেহে সম্প্রতি লাগা কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড বলছে, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, বরং ‘পুরোদস্তুর হত্যাকাণ্ড’।
মিশরের ‘আরব বসন্ত’ নামে খ্যাত সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর ২০১২ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তার মাধ্যমে ৬৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ক্ষমতার একবছর পূর্ণ হওয়ার পর গণবিক্ষোভ এবং তারপর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২০১৩ সালের ৩ জুলাই ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি।
তখন থেকেই তিনি ফিলিস্তিনি কট্টরপন্থি সংগঠন হামাসের সঙ্গে সন্দেহজনক যোগাযোগ রেখে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির মামলায় বন্দী অবস্থায় বিচারাধীন আছেন।
অ্যাক্টিভিস্ট এবং পরিবারের সদস্যদের বহুদিনের অভিযোগ, ২০১৩ সাল থেকে মুরসিকে টানা নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকা সত্ত্বেও গত ছয় বছর ধরে কোনোরকম চিকিৎসা পাচ্ছেন না তিনি।
গত মাসে পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছিলেন, বহুবার চেষ্টা করার পরও জেল কর্তৃপক্ষ কিছুতেই তাদেরকে মুরসির সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে না। এমনকি তার স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কেও কিছু জানতে পারছিলেন না তারা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, কারাবন্দী থাকা পুরোটা সময়ের মধ্যে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট মাত্র তিনবার স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এছাড়া একবারও তাকে নিজপক্ষের আইনজীবী বা চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে অথবা কথা বলতে দেয়া হয়নি।
এমনকি মুরসি মারা যাওয়ার পরও তার মরদেহ কোথায় রাখা হয়েছে, তা জানেন না বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন তার ছেলে আবদুল্লাহ। তার অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ মুরসিকে নিজ জন্মস্থান শাকরিয়া প্রদেশের নাইল ডেল্টায় দাফন করার অনুমতি দেয়নি।
দায়ী মিশরের ‘অত্যাচারীরা’: এরদোগান
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানও মুরসির এই আকস্মিক মৃত্যুতে দায়ী করেছেন মিশরের সরকারকে। মুরসির ঘনিষ্ঠ মিত্র এই প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইতিহাস কখনো সেই ‘অত্যাচারী শাসক’দের ভুলবে না, যারা মুরসিকে জেলখানায় ফেলে রেখে দফায় দফায় মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
২০১২ সালের ৩০ জুন ক্ষমতায় আসার পর নভেম্বরেই তিনি মিশরের সংবিধানে একটি সাময়িক ঘোষণা যুক্ত করেছিলেন, যা কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অসীম ক্ষমতা দেবে। একই সঙ্গে তিনি চাইলে যে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবেন বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই। তাড়াহুড়ো করে নতুন সংবিধানটি চূড়ান্তও করেন তিনি।
মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত নেতা মোহাম্মদ মুরসি তিনটি মামলার পৃথক বিচারে ৪৫ বছরের বেশি কারাদণ্ড পেয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল আইন বহির্ভূত বাহিনীর নেতৃত্ব দান, সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের আটকে রাখা ও নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস।
মুরসি বরাবরই আদালতের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে আসছিলেন। অন্যদিকে তার সমর্থকরা এই মামলা ও বিচারকাজকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে দাবি করে আসছিল। তাদের অভিযোগ, এই মামলাগুলো ছিল সামরিক অভ্যুত্থানকে আড়াল করার একটি আইনি চেষ্টা।