২২ আগস্ট, ২০১৭ ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কিত সংজ্ঞা বাতিল, সকল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তি ও ভুয়াদের বাতিল এবং যাচাই-বাছাইয়ের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানির প্রতিবাদে অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সংবাদ সম্মেলন করেছে। এতে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী(বীর বিক্রম),বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ হেফজুল বারী খান,বীর মুক্তিযোদ্ধা আরশুজ্জামান খান প্রমুখ।
এ সংবাদ সম্মেলনের ব্যানারে লেখা ছিল: সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ে সীমাহীন দীর্ঘ সূত্রিতা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে। এ সংবাদ সম্মেলনটি আয়োজন করেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। এমনই একটি প্রতিবাদ মুখর সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের আসন্ন ঈদের বোনাস ও ভাতা স্থগিতের ঘটনা ঘটেছে।মুক্তিযোদ্ধারা ভাতার সাথে ঈদ বোনাস দেয়ার খবরে উল্লসিত হয়ে ব্যাংকে গিয়ে চরম কষ্ট নিয়ে ফিরে আসে। ভাতা ও ঈদের বোনাস না পাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা এখন জেলা, উপজেলা কমান্ডার,উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে।
নেত্রকোণা জেলা কমান্ডার ও মদন উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্বাক্ষরিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল, কাকরাইল,ঢাকা-১০০০ বরাবরে প্রতিবেদনের শিরোনাম:মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির প্রতিবেদন প্রেরণ’। যার স্মারক নং ০৫.৪৫.৭২৫৬.০০.০০০.১৭-১০৫। এ প্রতিবেদনে লেখা রয়েছে: উপযুক্ত বিষয় ও সূত্রের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে নেত্রকোণা জেলার মদন উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটিতে অনলাইনে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্তির জন্য ১১৭ জনের আবেদন পাওয়া যায়।
তৎপ্রেক্ষিতে উপস্থিত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠভোট ও দাখিলকৃত তথ্যাদি যাচাই-বাছাই অন্তে ১১৬ জনের আবেদন না মঞ্জুর হয়েছে। (একজন) ভাতাভোগী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ভুলক্রমে পুনর্বার অনলাইনে আবেদন করায় তার আবেদন সঠিক মর্মে গৃহিত হয়েছে।ভাতাভোগী অভিযুক্ত (২৬) জন ও ভাতাভোগী ব্যাতিত (দুই)জন মোট আটাশ জনের মধ্যে ০৬ (ছয়) জন ভাতাভোগী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে সঠিক বলে সিদ্ধান গৃহিত হয়েছে। অবশিষ্ট (২২) জনের আবেদন কন্ঠভোটের ভিত্তিতে ও যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে না পারায় সভাপতিসহ সকল সদস্যগণ নাকচ করেছেন।
উল্লেখ্য যে ২২ জনের মধ্যে সুবেদার মো: বদিউজ্জামান ও নজরুল ইসলাম এই (দুই) জন ভাতাভোগী নন। এতে প্রশ্ন জাগে কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন এটা যাচাই-বাছাই কমিটি কিভাবে জানল? আরও প্রশ্ন জাগে মানুষ জজকোর্ট হয়ে হাই কোর্টে যায় ও হাই কোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়। কিন্তু এখানে উল্টো মানে সুপ্রিম কোর্টের বিচার করবে কি জজকোর্ট?
ভারতীয় তালিকা, মুক্তিবার্তা ও লাল বইয়ে যারা তালিকাভূক্ত করেছে তারা কি ভুল করেছে? তাদের ভুলের বিচার করবে উপজেলা প্রশাসন? আরও প্রশ্ন জাগে এ ভুলের দায় যারা ভুল করেছে তাদের না হয়ে কেবলই মুক্তিযোদ্ধাদের কেন? যাচাই-বাছাইয়ের চূড়ান্ত রায়ের আগেইবা কেন কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে ঈদের আনন্দ হতে বঞ্চিত করা হলো?
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যাচাই বাছাই কমিটির দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর এসেছে। উদাহরণ হিসেবে ২৬/৭/২০১৭ ইং তারিখে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বরাবরে প্রেরিত একটি অভিযোগ পত্রে লেখা রয়েছে: প্রকাশ থাকে যে, উক্ত অবৈধ কমিটি পরিকল্পিত ভাবে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি করত: খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের বাতিল করিয়াছেন,অপরদিকে অবৈধভাবে লাভবান হইয়া, দুর্নীতির আশ্রয়ে ভুয়াদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করিয়াছেন। আরও একটি অভিযোগ পত্র পাওয়া যেটি ২৬/৪/২০১৭ ইং তারিখে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বরাবরে প্রেরিত হয়। এতে বিষয় হিসেবে লেখা হয়, যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদন স্মারক নং ০৫-৪৫.৭২৫৬.০০.০০০.১৭-১০৫ তারিখ:০৫/০২/২০১৭ এর বিরুদ্ধে আপিল প্রসঙ্গে।
আপিলের কারণ হিসেবে এখানে লেখা হয়, যাচাই-বাছাই কমিটিতে কন্ঠভোটে গৃহীত হওয়ার পরও দাখিলকৃত তথ্যাদি বিবেচনা না করিয়া সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ষড়যন্ত্র মূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অভিযোগকারী কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার উক্ত যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য হওয়ায় ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হওয়ার কারণে।
আরও একটি অভিযোগ পত্র পাওয়া যায় যা ১৮/০৪/২০১৭ ইং তারিখে মদন উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে প্রেরিত হয়। এতে লেখা রয়েছে: আমার নিকট দুই লক্ষ টাকা দাবি করিলে আমি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করিলে গত ১৯/০৪/২০১৭ ইং তারিখে আমাকে সম্মানী ভাতা না দেয়ার জন্য আপনার বরাবরে অভিযোগ দাখিল করে।”এরকম শতশত অভিযোগ পত্র মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে প্রেরণ করেছে হয়রানির শিকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা এগুলো আমলে না নিয়ে ও নিষ্পত্তি না করে আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে তাদের মাসিক ভাতা ও ঈদ বোনাস স্থগিত করা কি যৌক্তিক হল?
২রা সেপ্টেম্বর ঈদুল আজহা আর ২২/২৩/২৪ আগস্টে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে কারন দর্শানোর নোটিশ। জবাব দিতে হবে সাত দিনের মধ্যে!এমনই একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ পাওয়া গেল যার স্মারক নং:০৫.৪৫.৭২৬.০০০.০০১.২০১৭-৬৭০।
এর সূত্র হিসেবে লেখা রয়েছে(১) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১০ আগস্ট ৪৮.০০.০০০০.০০৬.০২০.০৩১.০১৯.২০১৭- ৪০৭ নং স্মারক ও (২) জেলা প্রশাসক নেত্রকোণা মহোদয়ের কার্যালয়ের ২০ আগস্ট ০৫.৪৫.৭২০০.০১০.২০.০০১.১৭-১২৭৮ নং স্মারক।এরপর এতে লেখা রয়েছে উপযুক্ত বিষয় ও সূত্রের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১০/০৮/ তারিখের ৪০৭ নং স্মারকে জারীকৃত মঞ্জুরি পত্রের ১৭ নং অনুচ্ছেদে উপজেলা যাচাই বাছাই কমিটি কর্তৃক যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা নন বলে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে, তাদের ভাতা আপাতত প্রদান না করে।
কেন ভাতা বন্ধ করা হবে না তার কারন দর্শানোর নোটিশ প্রদান করার নির্দেশনা রয়েছে।এমতাবস্থায় ১০/০৮/২০১৭ ৪০৭ নং স্মারকে জারীকৃত মঞ্জুরি পত্রের ১৭ নং অনুচ্ছেদে নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার কর্তৃক দাখিলকৃত আবেদন উপজেলা যাচাই বাছাই কমিটি কর্তৃক কন্ঠভোটে নাকচ হওয়ায় কেন আপনার ভাতা বন্ধ করা হবে না তার কারন পত্র প্রাপ্তির ০৭ কার্যদিবসের মধ্যে দাখিল করার জন্য অনুরোধ করা হল।
৩০ আগস্ট বিভিন্ন জেলায় ভাতা ও ঈদের বোনাস বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধারা চরম বেদনা নিয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের বেতন, বোনাস ফিরে পেতে। কারণ আগামী কাল পর্যন্তই শুধু অফিস আদালত খোলা থাকবে।এরপর ঈদের ছুটি। এমন সময়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বঞ্চিত করার পরিকল্পিত দূরভিসন্ধি নয় কি? আসন্ন ঈদের আরও আগে কেন এই নোটিশ দেয়া হলো না এ প্রশ্ন ভুক্তভোগীদের?
তবে কি আর্থিক সুবিধা না পাওয়ায় এই নোটিশ? সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগের জুজু দেখিয়ে একশ্রেণীর অসাধু চক্র তৎপর বলে জানা যায়। কেন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এসব মুক্তিযোদ্ধার আপিল আবেদন নিষ্পত্তি করল না? খবর বেরিয়েছে, যারা ভারতীয় তালিকা ও লাল বইয়ে তালিকাভূক্ত ও মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রাপ্ত তাদের যাচাই-বাছাই স্থগিত।
তবু কেন তাদের ভাতা ও বোনাস স্থগিত করা হল। কেড়ে নেয়া হলো তাদের ঈদের আনন্দ। এর কি জবাব দেবেন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা ও ঈদের বোনাস বঞ্চিত হলে এর দায় কার?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)