বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি বৃহৎ কর্মযজ্ঞ ছিল, এ কর্মযজ্ঞে লাখ লাখ মানুষের অবদান রয়েছে। তাছাড়া এ দেশ কোনভাবেই স্বাধীন হতো না, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল মহান মুক্তিযুদ্ধ। কিছু সংখ্যক মানুষ নিরবে-নিভৃতে কাজ করেছেন পর্দার আড়াল থেকে আবার অনেকেই রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীদের সাথে সন্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। কারোরটা প্রকাশিত হয়েছে এবং কারোরটা অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে।
প্রকৃত অর্থে, আমার মতে, মুক্তিযুদ্ধের সে ভয়াবহ সময়ে যে বা যিনি মুক্তিসংগ্রামের স্বপক্ষে কাজ করেছেন তারা প্রত্যেকেই মুক্তিযোদ্ধা। সে সময়টাতে কতিপয় ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটি বাদে সকলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কারণ, মুক্তিকামী জনসাধারণ কোন না কোনভাবে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। কেউ তথ্য দিয়ে, কেউবা চিঠি পৌঁছে দিয়ে, কেউবা গান গেয়ে, কেউবা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে কিংবা খাবারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে মুক্তিসংগ্রামে অবদান রেখেছিলেন।
ফজিলাতুন নেছা মুজিবের মুক্তিসংগ্রামকে ব্যাখ্যা করা যায় বিভিন্নভাবে। প্রথমতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আন্দোলনের প্রত্যেকটির সাথে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। ১৯৬৬ সনের ছয় দফা, ১৯৬৯ সনের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এমনকি ৭ই মার্চের ভাষণের সাথে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পাশাপাশি ১৯৬৬ এর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য দলকে শক্তিশালী করাসহ নেতাকর্মীদের সাথে সহযোগিতা বিভিন্নভাবেই অব্যাহত রাখতেন। দ্বিতীয়তঃ ফজিলাতুন নেছার প্রিয় স্বামী স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করায় কারাবরণ করতে হয়েছিল পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে। স্বামীর ঘোষণা প্রদান করা এবং যুদ্ধের জন্য বাঙালিদের প্রস্তুত করার কাজে বেগম মুজিবের অপরিসীম ভূমিকা সকলকে উদ্বেল করেছিল, দিয়েছিল অনুপ্রেরণা।
তৃতীয়তঃ যুদ্ধের শুরুতেই তিনি তার বড় ছেলেকে দেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য যুদ্ধে পাঠান এবং ১৭ বছরের ছেলেকে যুদ্ধের মাঝপথে যুদ্ধে পাঠান। শেখ জামালকে যুদ্ধে পাঠানোর পর অনেক মহিলারাই তাদের সন্তানদের যুদ্ধে পাঠাতে উৎসাহ বোধ করেন। চতুর্থতঃ সন্তানদের যুদ্ধে পাঠানোর পরেও সুকৌশলে তিনি পাকিস্তানের সৈন্যদের হাতে বন্দি থাকার পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, দিক নির্দেশনা দিতেন। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তিনি কখনো পিছপা হতেন না, পিজি হাসপাতালে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তথ্য আদান প্রদান করতেন। ফজিলাতুন নেছা মুজিবের বহুমুখী অবদান রয়েছে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে। সংক্ষেপে এক নজরে এ বিষয়গুলোকে সমন্বিত করে সহজেই উপলব্ধি করা যায় মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গজননীর অসামান্য অবদান।
রেণুর বাবা-মার আসনে আসীন, শিশুকাল থেকে লালন-পালন করে আসা শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ঘর পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। চরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সেসময় অসহায় বৃদ্ধ শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে অসুস্থ দেখিয়ে ড. নূরুল ইসলামের মাধ্যমে পিজি হাসপাতালে একটি কেবিনের ব্যবস্থা করেছিলেন বেগম মুজিব। যদিও ফজিলাতুন নেছাকে মাসে একবারের জন্য যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো কেবিনটিতে। তবে এ কেবিনটি মুজিব পরিবারের সদস্যদের জন্য মিলনমেলার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান প্রদানের জন্য নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচিত হতো।
মুজিব পরিবারের পাশাপাশি ওখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা গোপনে এসে খবরাখবর দিয়ে যেত, বাসার কাজের ছেলের মাধ্যমে এ খবরগুলো ফজিলাতুন নেছা সহজেই জানতে পারতেন। এ কেবিন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সব খবরাখবের তথ্যভাণ্ডার। তথ্যভাণ্ডারের খবর চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশনা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে পাঠাতেন তিনি। এ বিষয়টি ফজিলাতুন নেছা মুজিবের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক। একমাত্র তার চতুরতা, বুদ্ধিক উজ্জলতা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির প্রতি দায়বদ্ধতা কঠিন সময়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহায়তা করেছিল। এমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়ে প্রবল সাহসিকতার সহিত দেশ মাতৃকার মঙ্গলের জন্য কাজ করেন ফজিলাতুন নেছা।
একান্ত স্মৃতিপটে সুলতান শরিফ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ ছিল, সাড়ে ৭ কোটির মধ্যে সাড়ে ৬ কোটি মানুষ নানাভাবে নিগৃহীত, লাঞ্ছনা এবং বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, বিপদের সন্মুখীন হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছেন, ১ কোটি লোক দেশান্তরিত হয়েছেন। প্রবাসী বাঙালি যারা জানত বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে তারা বাবা-মা, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজনদের হারাবে, তাদেরকে মাথায় রেখে স্বান্তনার ক্ষেত্র হিসেবে বেগম মুজিবকে পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে। এবং সে সময়ে প্রায় ৫০,০০০ এর মতো মানুষ দেশের বাইরে ছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘যুদ্ধের সময়, সান্তনার বাণী হিসেবে পেয়েছি বেগম মুজিবের বাণীগুলোকে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় শেখ জামালকে ১৭ বছর বয়সে যুদ্ধে পাঠান একজন তেজস্বী মা হিসেবে। যে মা ১৭ বছরের সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন, সে মা উদাহরণের জন্য অনন্য, অতুলনীয়। যে মা এই বয়সের ছেলেকে যুদ্ধে পাঠাতে পারেন, সে মা সমস্ত বাঙালির জাতির জীবনে অনন্য হয়ে থাকবে। অন্যদের সাথে তুলনা করিনি। তারা অন্যান্যদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ ছিলো যাদের সন্তানরা সেসময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।’
ফজিলাতুন নেছা নিজে পত্র মারফত রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করতেন এবং আত্মীয়স্বজনদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতেন। তিনি নারীবাদী ও সমাজ সেবকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং সারাদেশের ধ্বংসযজ্ঞের খোঁজখবর নিতেন। সেই মোতাবেক পরিচিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চিঠি ও লোক মারফত পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিতেন। বেগম মুজিবের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলার শত শত নারী তাদের ছেলেদের যুদ্ধে পাঠানোর তাগিদ অনুভব করেন।
সুলতান শরিফ উল্লেখ করেন ‘বেগম জাহানারা ইমামরা যারা তাদের সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন তাদের কাছে বেগম মুজিব অনন্য। তারা কিন্তু সকলেই উনার কাছে ঋণী, খুব দূরবস্থার মধ্যে এই পরিবার অন্যদের প্রতি সদয় হয় নাই এমন নজির নাই। সকল দয়ার অধিকারী, একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে সকলকে গ্রহণ করেছিলেন। সকলের দোষত্রুটিকে মার্জনার ন্যায় গ্রহণ করেছিলেন। তাইতো বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহধর্মিণী হিসেবে তিনি আজীবন সাহচর্য দিয়ে গিয়েছিলেন একজন মমতাময়ী বাঙালি নারীর ঐতিহ্যকে লালন করে।’ মুক্তিযুদ্ধে একজন অনুপ্রেরণাদায়ী নারী হিসেবে তিনি আজীবন সম্মানিত থাকবেন বাঙালি জাতির ইতিহাসে।
নতুন করে ইতিহাসের পাতায় বিশেষিত বিশেষায়ণে বেগম মুজিবের ভূমিকাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়ে যোগ করতে হবে।
ফজিলাতুন নেছা মুজিব তখনকার লক্ষ লক্ষ পরিবারের কাছে অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরিবারের সামর্থবান দু’জন ছেলেকে যুদ্ধে পাঠানোর পাশাপাশি স্বামী পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি এমন অবস্থায়ও তিনি মনোবল হারাননি। প্রকৃত নেতার যোগ্য সহধর্মিণী হিসেবে শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছেন। নিজ থেকেই দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের সাথে যোগাযোগ করে করণীয় ঠিক করতেন, অবস্থার প্রেক্ষাপটে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরামর্শে ভিন্নতা আনতেন।
বিদেশে অবস্থানরত দেশপ্রেমিক বাঙালিদের সাথে সুযোগ মত যোগাযোগ রক্ষা করে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান বঙ্গমাতা। মা, স্ত্রী, পুত্রবধূ, ভাবী, বোন এবং সর্বোপরী একজন মহিয়সী নারী হিসেবে ফজিলাতুন নেছার বহুমুখী অবদান আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে বেগবান করেছে, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ প্রদান করেছে, কলম সৈনিকদের কলমের শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, কণ্ঠশিল্পীর গানের মাধুর্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
চলবে…