চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী অর্থবহ করতে

মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হবে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। একাত্তরে স্ত্রী, সন্তান ও আপনজনদের ফেলে যখন মুজিবনগরে চলে যাই কাউকে, এমনকি পারিবারের কাউকেও না জানিয়ে, এবং তখনকার আরও অসংখ্য তরুণও ছুটে গিয়েছিলন মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে একইভাবে মা-বাবা-স্ত্রীর কাছে অনেক ক্ষেত্রেই গোপন রেখে। আজ তাদের হিসাব মেলানোর পালা। হিসাব মেলানো গৃহাভ্যন্তরে বা ঘরের কোণে জনা কয়েক বসে নয় লাখো মানুষের সমাবেশেই যেমন সমাবেশে বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে লাখো মানুষকে লড়াই এ নামতে উদ্বুদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।

তা আসলে হলো না হতে পারলো না করোনা-ওমিক্রন প্রভৃতির জীবন ধ্বসংকারী রোগের বিস্তৃতি ঘটার আশংকায়। অথচ যে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আজও বেঁচে আছেন বার্ধক্যে পৌঁছানো সত্বেও তারা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ কোটি কোটি মানুষের প্রত্যাশাও ছিল তেমনই। পরে টেলিভিশন চ্যানেলগুলি নয় মাসব্যাপী কবে কোথায় কী ঘটেছিল তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এবং অনলাইন নানা গান আবৃত্তির আসর সাজিয়ে ও ঐ দিন জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদ মিনারগুলিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অতি সন্তর্পনে পুস্পার্ঘ্য প্রদান করে। সুবর্ণ জয়ন্তী এভাবে উদযাপন হোক তা চাইনি, চাননি দেশবাসীও কিন্তু তা হলোই না। অর্থাৎ করাই গেল না।

কিন্তু স্মৃতিগুলি এবং এই ফেলে আসা ৫০ বছরের ঘটনাবলী মনের কোনে ভেসে উঠছেই। সেখানেই হিসেব-নিকেশ হচ্ছে আমাদের এতদিনকার সাফল্য ও ব্যর্থতার।

আমার দৃষ্টিতে যেমন সাফল্যের তালিকাটা কম নয়, তেমনই আবার ব্যর্থতার তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। তাই আত্মতৃপ্তির কোন অবকাশ না রেখে সাফল্যকে প্রত্যন্ত আলোতে পৌঁছে দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রতিগুলিকে উপেক্ষা না করে দ্রুত সেগুলো বাস্তবে কাজে রূপায়ন করা।

সাফল্যের তালিকায় দেখি:
এক. নিজস্ব তহবিল থেকে, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক দাতা সমূহের অর্থায়ন ব্যতিরেকে বিপুল প্রত্যয় নিয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণ। সন্দেহ নেই, এই প্রজেক্টে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর চালু হবে যখন তখন দেশের এক বিরাট অঞ্চলের মানুষ প্রকৃত উপকৃত হবে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর বেকারত্ব নানাভাবে মোচনের পথ খুলে যাবে। আরও বহুবিধ উপকার সাধিত হবে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের অজস্র মানুষের।

দুই. দ্বিতীয় মেগাপ্রকল্প পাবনার রূপপুরে নির্মীয়মান পারমাণবিক প্রকল্প। এই প্রকল্পটি যেদিন কার্যকর হবে সেদিন দেশে বিদ্যুতের অভাব বহুলাংশে মিটে যাবে। নতুন নতুন কলকারখানা স্থপন ও অসংখ্য মানুষের বেকারত্বও ঘুঁচবে।

তিন. দেশে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয়েছে এবং উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

চার. বহু নতুন পাকা রাস্তা, দালান-কোঠা প্রভৃতি নির্মিত হওয়ায় মানুষের চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক সুবিধা হয়েছে।

পাঁচ. ইন্টারনেটের প্রসার ঘটায় দেশে-বিদেশের দূরত্ব কমেছে এবং আরও নানাবিধ কাজের প্রভুত সুবিধা হয়েছে।

ছয়. কৃষিপণ্য, মৎস্য, সবজী প্রভৃতির উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কোন কোন পণ্য এখন রফতানি করাও সম্ভব হচ্ছে।

মোটাদাগে এগুলিই এ যাবত আমাদের সাফল্য। একাত্তরের আগে যে নানামুখী পশ্চাৎপদতা দেশকে গ্রাস করেছিল বহুলাংশে তা দূর হয়েছে এবং আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে।

এছাড়ও বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু আজ প্রায় আড়াই দশক আগে নির্মাণ শেষ করে চলচলের জন্য খুলে দেওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন হয়েছে। এই যোগাযোগ যমুনা সেতুর পূর্বে যে করুণ অবস্থায় ছিল আজ তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। ২৪ থেকে ৩০ ঘণ্টা লেগে যেত উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলি থেকে ঢাকা গিয়ে পৌঁছাতে।

এ তালিকায় বাইরে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। তবে অনেকদিন যাবত তা অত্যন্ত কম আলেচিত।

ব্যর্থতা সমূহ:
পূর্বেই বলেছি, বিগত ৫০ বছরে আমাদের সাফল্য যেমন বিপুল-ব্যর্থতা তার চাইতে কোন অংশ কম নয়। ব্যর্থতা গুলিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মুক্তিযুদ্ধের সুমহান আদর্শগুলি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক। যেমন:-

এক. গণতন্ত্রকে আজও প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং গ্রহণযোগ্য কোন নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমরা মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছি।

দুই. দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের চার মৌলনীতি কার্য্যত: পরিত্যক্ত। সে ব্যর্থতাগুলি পরিদৃষ্ট হয় যখন আমরা দেখি জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত-“বিসমিল্লাহ্” ঐ সংবিধানের শুরুতে সংযোজিত, জামায়াতে ইসলামী সহ ধর্মান্ধ দলগুলির সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান ও স্বৈরাচারী এরশাদ কর্তৃক প্রবর্তিত “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” সংযোজন করে ধর্ম নিরপেক্ষতার সাথে সাংঘর্ষিক রূপ দান।

এগুলির ফলে প্রকৃতই সংবিধান ও রাজনীতিতে পরাজিত পাকিস্থানী আদর্শ ও রাজনৈতিক ধারার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। তদুপরি হেফাজতে ইসলাম নামক এক সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে সরকারি সখ্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাদের আকাংখা পূরণে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে সৌন্দর্য্যমণ্ডিত ভাস্কর্য্যটিকে অপসারিত করা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করে কিশোর-কিশোরীদেরকে বাল্যকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আক্রান্ত হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে অস্বাভাবিক প্রাধান্য দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ প্রদত্ত সর্বোচ্চ ডিগ্রীর সমতুল্য করা হয়েছে, কুষ্টিয়া শহরে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য্য প্রকাশ্য দিবালোকে মাদ্রাসা ছাত্ররা ভেঙ্গে দেওয়ার সাহস পেয়েছে, বিমানবন্দরের সন্নিকটে সহ আরও কতিপয় স্থানে হেফাজতীরা ‘বলাকা’ ও নানা দৃষ্টি নন্দন এবং শৈল্পিক ভাস্কর্য্য ভেঙ্গে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, বছর কয়েক আগে লাখো তরুণ-তরুণী শাহবাগে জামায়েত হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদন্ড দাবীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য দিবারাত্র অবস্থান কর্মসূচী পালনকালে হেফাজতিরা ‘নাস্তিক’ বলে তাদেরকে আখ্যায়িত করে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনে দাঁড়ালে অবস্থানরত তরুণ-তরুণীরা তেড়ে গেলে হেফাজতীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

দুই. হেফাজতি এক প্রধান আলেম সুনামগঞ্জের এক বিরাট জালছায় প্রকাশ্যে সাম্প্রদয়িক বক্তব্য দিয়ে ওয়াজ করলে হাজার হাজার মানুষ তাতে বিভ্রান্ত হয়ে একটি হিন্দু প্রধান গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় ব্যাপক লুটপাট ও সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটায়। হেফাজতেরঐ আলেম পরবর্তীতে নারী-ঘটিত এক ব্যাপারে ধরা পড়ে আজও কারারুদ্ধ আছে।

তিন. হেফাজত নারীর অমর্যাদা করে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করে নারী শিক্ষার বিরোধিতা এবং নারী বাইরে বেরুলে পুরুষদের কাছে তেঁতুলের মত জল আসে বলে নারী ও পুরুষ উভয়ের চরম অবমাননা করে।

চার. হেফজতিয়দের হুমকীতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সরকারিভাবে গৃহীত তার একটি বিশাল ভাস্কর্য্য নির্মাণ প্রকল্প অপ্রকাশ্যভাবে বাতিল করা হয়।

পাঁচ. বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি বিশেষ দিন পহেলা বৈশাখের বৈচিত্যপূর্ণ ও শৈল্পিক নানামুখী অনুষ্ঠান কয়েক বছর যাবত হেফাজতী হুমকিতে ব্যাহত হয়ে ক্ষুদ্রাকারে করতে বাধ্য করা হয়েছে।

ছয়. দেশে যাত্রা, লালনের অসম্প্রদায়িক জনপ্রিয় গানের অনুষ্ঠানগুলি অলিখিতভাবে বাতিল করে দিয়ে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতিকেও আঘাত করা হয়েছে।

সামাজিক
এক. সামাজিক ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের যে ভয়াবহ বৃদ্ধি ঘটেছে, নারী-নিরাপত্তা যেভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে, নারী নির্যাতন সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সভ্যতা বিধ্বংসী। এই নারী সংক্রান্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও নারী জীবনের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতা সীমাহীন।

দুই. ব্যাংক লুট, টাকা-আত্মসাতকারী ও দুনীতিবাজরা দেশে অত্যন্ত নিরাপদে বাস করছে অথচ আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল দুর্নীতিমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা।

তিন. সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। একদিকে দেখা যায় প্রতি বছর শত শত নতুন নতুন কোটিপতি জন্ম নিচ্ছে অপরদিকে তেমনই দেশের একভাগ লোক মধ্যবিত্ত, স্বল্পত্তি ও বিত্তহীনে পরিণত হচ্ছে। এই ব্যবধান পাকিস্তানী আমলের উৎকট সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যকেও হার মানিয়েছে।

চার. বঙ্গবন্ধু তার অধিকাংশ ভাষণে পুঁজিবাদ নয়-সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকেই তার প্রধান লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছেন-বাহাত্তরের সংবিধানেও রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে সমাজতন্ত্রকে একটি বিশেষ মূলনীতি হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছেন। শব্দটি সংবিধানে আজও আছে কিন্তু কাজে পুঁজিবাদকে অত্যন্ত শীক্তশারী করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুত্ব কল-কারখানাকে ওই লক্ষ্যে জাতীয় করণ-করেছিলেন আজ আমরা সেগুলি ব্যক্তিমালিকার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ গড়ে উঠতে সহায়তা করছি।

নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে তোলা হচ্ছেই না প্রায়। যেগুলি নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হলো গার্মেন্টস্ ও ওষুধ শিল্প। এগুলি বিস্তার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হচ্ছে। কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিবারাত্র খেটে যে লক্ষ লক্ষ নারীও পুরুষ শ্রমিক নিম্নতম মজুরী, বাসস্থান, চিকিৎসা প্রকৃতির ন্যায্য সুযোগ থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন।

কৃষিক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদন যেমন আরও বৃদ্ধির জন্য বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক পন্থা অবলম্বন করায় মারাত্মক ঘাটতি রয়ে গিয়েছে তেমনই আবার কৃষি শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরী পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা বিধান করতে আমরা আজও ব্যর্থ হয়েছি।

এই দুর্বলতা কাটাঘার জন্য অবিলম্বে একটি পরিকল্পিত অর্থনীতি, সমাজনীতি শিক্ষানীতি, নারী নীতি, শিল্প ও কৃষি নীতি গ্রহণ করা এই সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রতিষ্ঠা হোক।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)