ডাকসু ভিপি নুরের ওপর হামলা যৌথ হামলা করলো ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ৷ খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাও তাকে দেখতে গিয়ে এই হামলাকে বর্বর ও পৈশাচিক বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ এই ইস্যুতে দেশব্যাপী সাধারণ শিক্ষার্থী পরিষদ কর্মসূচী দিয়েছে৷ বিএনপি নেতারাও ভিপি নুরের ওপর হামলার নিন্দা করেছেন৷ হয়তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচীকেও তারা সমর্থন করবে৷ এখন প্রশ্ন হচ্ছে: কেন বারবার এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে বিএনপি ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির হাতে নতুন নতুন ইস্যু তুলে দেয়া হচ্ছে?
এর আড়ে আরও একটি ইস্যু তুলে দিয়েছে রাজাকারের তালিকায় আওয়ামী লীগের ৮ হাজার ৬০ জনের নাম যুক্ত করে। তাই বিএনপি বেশ জোর গলায় বলছেন, ‘আজকে রাজাকারের দল ক্ষমতা দখল করে আছে। অনতিবিলম্বে রাজাকারদের দলকে পদত্যাগ করতে হবে। রাজাকারদের হাতে ক্ষমতা দেশের মানুষ দেখতে চায় না।’ তারা আরো বলছেন, ‘রাজাকারদের বলতে চাই – অনতিবিলম্বে স্বাধীনতার ঘোষকের স্ত্রীকে মুক্তি দিন। যদি না দেন জাতি কিন্তু আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের প্রসব যন্ত্রণায় আছে। এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত হচ্ছে। রাজাকারদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে দিয়ে দেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
আন্দোলনে ব্যর্থ, জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের সাথে জোট বাঁধা দলটির কথিত এই নতুন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবে কি মতিউর রহমান নিজামী,কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী ও দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো রাজাকারের সন্তানেরা? অনেক রাজাকারই এই আলোচিত রাজাকারের তালিকায় নেই৷ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মন্ত্রী কর্তৃক জামায়াতি প্রভাবের এমন একটি উদ্ভট রাজাকারের তালিকা কী করে হতে পারলো? ক্ষমতায় তো বিএনপি-জামায়াত নয়, আওয়ামী লীগ সরকার৷
মন্ত্রীরা ভুল করলেই দায় চাপাবে বিএনপি জামাতকে৷ এটা কী ধরনের ট্র্যাডিশন হতে চলছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে? পেঁয়াজের দাম বাড়লে দুর্ভোগ বাড়ে জনগণের আর বলা হয় বিএনপি-জামায়াত সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে৷ এমনটি করে থাকলেও কি ব্যর্থতার দায় সরকার ও মন্ত্রীর নয়? তারা কেন এই সিন্ডিকেটটি সময় থাকতে ভাঙতে পারলো না? ক্যাসিনো কাণ্ড, বালিশ কাণ্ড, হাসপাতালের পর্দা কাণ্ড সবই কি বিএনপি জামায়াতের ইন্ধনে? উন্নয়নের নামে শতশত কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে৷ দেশের টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে৷ এসবও কি বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধনে?
প্রিয়া সাহা কর্তৃক ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ, রোহিঙ্গা সমস্যায় হুমকির মুখে জাতীয় নিরাপত্তা, বিজেপি শাসিত ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি, ভারত থেকে সাবেক বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও দমনপীড়নে টালমাটাল দেশের অবস্থায় সবকিছুতে দায় এড়ানোর অপচেষ্টাই সবচেয়ে ক্ষতিকর৷ নুরকে পিটাতে পিটাতে ডাকসু ভিপি বানিয়েও তারা থেমে নেই৷ তিনি বারবার হামলার শিকার হয়েই চলেছেন৷ অথচ এই হামলাকে হামলার ঘটনা না বলে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সংগত কারনেই প্রশ্ন জাগে হামলা কাকে বলে? নুর ও তার সহযোগীদের মেরে রক্তাক্ত করে হাসপাতালে পাঠালো যা সারাদেশের মানুষ দেখেছে তবু যদি সেটা হামলা না হয় তাহলে হামলা কোনটা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, ‘আমরা ঘটনা শুনেছিলাম। তবে ঘটনাটা এত বর্বর ও পৈশাচিক; সেটা বুঝতে পারিনি।’ তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও এটাকে নিন্দনীয় হামলা বলেছেন৷
ডাকসু ভবনে ভিপি নুরুল হক নুর ও তার সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনার পর পুরো ডাকসু ভবনে নয়টা সিসি ক্যামেরা থাকলেও ফুটেজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নুরকে কক্ষে আটকে মারধরের পরপরই সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ হার্ডডিস্ক, মনিটর ও সিপিইউ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কে বা কারা এই ফুটেজ নিয়ে গেছে তা কেউ জানে না! মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কিংবা আওয়ামী লীগের অনুমোদিত সংগঠন? হঠাৎ করে কার ইন্ধনে তারা এমন লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ন হলো? তারা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মান বাড়ালো না নষ্ট করলো? এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই ছাত্রসমাজের রয়েছে উজ্জ্বল ভূমিকা৷ এসব ভূমিকায় কোনো একক সংগঠন ছিল না। ছিল বহু সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরাই৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু ভবন ও মধুর ক্যান্টিন এলাকায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন মত-পথের ভিন্নতা নিয়েই দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে একত্রে দাঁড়ায় ছাত্রসমাজ৷ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থান, সর্বত্রই ছিল বিভিন্ন মতের ছাত্রছাত্রীদের সক্রিয় ভূমিকা৷ ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্রসমাজে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একটা অংশ৷ আদর্শের ভিন্নতা নিয়েই ১১ দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে এনেছিল তারা৷ বাংলাদেশের সমস্ত ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেদিন৷ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও রেখেছিল উজ্জ্বল ভূমিকা৷
সেই মুক্তিযুদ্ধের নাম নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ এর নামে এমন হামলায় কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গর্বিত অবয়ব নষ্ট হলো না? এটা হামলা না হলে হামলার ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন এবং ইয়াসির আরাফাতকে আটক করা হলো কেন? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন লেজুড়বৃত্তির কারণে এ ঘটনাকে হামলা বলতে নারাজ হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি ঠিকই বুঝতে পেরেছে। এজন্য তাদের ধন্যবাদ। কারণ, বিএনপি-জামায়াতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেই গড়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল৷ আর ক্ষমতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এভাবে বারবার বিতর্কিত করার বিষয়টি তারা মেনে নেবে না বলেই আমরা ধরে নিতে পারি। কেননা এই বিতর্কিত হওয়ার সুফলটা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির গোলায় উঠবে। এছাড়া এটাও সত্য যে, শত ফুল ফুটতে না দিয়ে কেবলমাত্র একটি মাত্র ফুল দিয়ে কখনো কোনো বাগান হয় না।
বহু মত ও পথের লোকদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল মুক্তির চেতনা৷ এখন তাকে রুদ্ধ করে দিলে এ চেতনা বিকশিত হতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের আমলেই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা গ্রেপ্তার হচ্ছে, বা তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। ব্যাপারটা খুব লজ্জার। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কাউকে যেন বিতর্কিত কোনো কাণ্ডে গ্রেপ্তার হতে না হয়, সেটা তাদের নিজেদেরই ভাবতে হবে। মানুষ আর দায় এড়িয়ে গতানুগতিক দায় চাপানো দেখতে চায় না৷ চায় এসব ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)