চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মীর কাসেমের চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় জাতি

অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের তুলনায় মীর কাসেম আলী কিছুটা ব্যতিক্রম। ক্ষেত্রবিশেষে সাকা চৌধুরীর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তার বিচার ঘিরে জল্পনা কল্পনাও ছিলো অনেক বেশি। মীর কাসেমের শাস্তির ব্যাপারে তাই আশা নিরাশার দোলাচলে দুলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষেরা। কারণ ছিলো একটাই, টাকার পাহাড়। অপরিমিত অর্থ সম্পদের মালিক এই মীর কাসেম। জামায়াতের মূল আর্থিক পৃষ্ঠপোষক এই ব্যক্তিটি। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিদেশী লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ, অনলাইন অফলাইনে ব্যাপক প্রপাগান্ডা ছড়ানো, দেশের অভ্যন্তরে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই ঘুরে ফিরে আসতে থাকে এই যুদ্ধাপরাধী ধনকুবেরের নাম।

একাত্তরের ঘাতক বাহিনী ইসলামী ছাত্রসংঘ এর বিবর্তিত রূপ ছাত্রশিবির এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এই মীর কাসেম। সভপতির পদ ছেড়ে যোগ দেন সৌদি আরবভিত্তিক এনজিও রাবেতা আলম নামক সংস্থায়। যে সংস্থাটি বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সাহায্য-সহযোগিতার কাজে নিয়োজিত থাকার আড়ালে জামায়াত-শিবির প্রতিষ্ঠার কাজ করতে থাকে। তাদের মাধ্যমে আর্থিক যোগানও আসতে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে মসজিদ-মাদ্রাসা ধ্বংস করা হয়েছে, বহু মুসলমান নির্যাতিত ইত্যাদি বানোয়াট তথ্য দিয়ে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু করেন মীর কাসেম।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি পদ ছাড়ার ৪ বছরের মাথায় মীর কাসেম আলী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে জামায়াতিদের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন সৌদি রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিব। গোলাম আযমের ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি রাষ্ট্রদূত থাকা অবস্থায় ব্যাংকটির পরিচালক মনোনীত হন। মীর কাসেম ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান হন। শুরুতে পরিচালকমণ্ডলী ও শরিয়া কাউন্সিলের সব সদস্যই ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে শূরার সদস্য। এরা হলো কামালউদ্দিন জাফরী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মুহম্মদ আলী, আবদুল জব্বার, শামসুদ্দিন আহমদ, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। ব্যাংকের একটি জাকাত তহবিল রয়েছে। ব্যাংকের আয়ের শতকরা আড়াই ভাগ যায় জাকাত তহবিলে। এর প্রায় পুরোটাই জামায়াত তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। এই ব্যাংকের ঋণের সুযোগ-সুবিধা জামায়াতিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি জামায়াতের বাইরের কোনো লোককে কর্মচারীও বড় একটা নিয়োগ করা হয় না।

মীর কাসেম আলী ব্যাংকটি গঠনের পর অন্যান্য খাতেও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ইবনে সিনা ট্রাস্ট, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, সংবাদপত্র, টেলিভিশন কেন্দ্র, শিক্ষা সব খাতেই বিনিয়োগ করেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তথা সিআইপি মর্যাদা নিয়েও বিদেশে সফর করেছেন। ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মীর কাসেম ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা মীর কাসেমের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠেছে ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল, ইবনে সিনা ডায়াগনিস্টিক সেন্টার, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল ইত্যাদি। মীর কাসেমের অর্থ দিন দিন এতই বেড়েছে যে, নানা খাতে অর্থলগ্নি করেছে। কেয়ারী নামে ১০টি কোম্পানির পরিচালক মীর কাসেম আলী। যাতে তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানা রয়েছে। এর প্রধান কার্যালয় ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে কেয়ারী প্লাজায়। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য রয়েছে মীর কাসেমের একক মালিকানাধীন বিলাসবহুল পাঁচটি প্রমোদতরী। এছাড়া মীর কাসেম মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার দেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ চট্টগ্রাম শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলী ১৯৭৭ সালে নবগঠিত ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর মীর কাসেম আলী এক বিবৃতিতে ‘সৈনিক হিসেবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার জন্য’ সংগঠনের সদস্যদের প্রতি আহবান জানান। এই সময়কালে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল, ‘শত্রু আশপাশেই রয়েছে। তাই সতর্কতার সঙ্গে কাজ চালাতে হবে। মনে রাখবেন, আপনারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কেবল যুদ্ধ করছেন না, এ যুদ্ধ ইসলামের। নমরুদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য আমাদের আমিরের (গোলাম আযম) নির্দেশ পালন করুন।’ আলবদরের নৃশংসতার বিবরণ স্বাধীনতার পর পর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। যে সব চিত্র বিধৃত হয়েছে, তা হিটলারের গোস্টাপো, ভিয়েতনামের মাইলাই কিংবা লেবাননে প্যালেস্টাইনিদের সাবরা শাতিল শিবিরের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও হাজার গুণ ভয়াবহ। বদর বাহিনীর হাতে শুধু ঢাকার শত শত বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অধ্যাপক ও শিল্পীই প্রাণ হারাননি, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত বিশিষ্ট নাগরিকও রেহাই পাননি। ভিন্নমতাবলম্বীর অনেক আলেমও তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এসব মর্মন্তুদ ঘটনার অনেক বিবরণ আজো অপ্রকাশিত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি আলবদর বাহিনীও পরাজিত হয়। তবে হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি তারা আত্মসমর্পণ করেনি। মীর কাশেমসহ অন্যরা আত্মগোপন করে। কেউ পালিয়ে পাকিস্তানসহ অন্য দেশে চলে যায়। ১৯৮০ সালে তিনি রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী নামের একটি বিদেশি বেসরকারি সংস্থার এদেশীয় পরিচালক হন। এ ছাড়া তিনি দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য। ধীরে ধীরে তিনি জামায়াতের অর্থের অন্যতম জোগানদাতায় পরিণত হন।

আর একথা অলিখিত সত্য যে এদেশে টাকার বিনিময়ে করা সম্ভব নয়, এমন কাজ খুব কমই আছে। আর বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থের মালিক ঘাতক পশুটিকে নিয়ে তাই জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই। অর্থের জোরে তার রয়েছে মার্কিন ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক শক্ত লবি। আগামী মঙ্গলবার এহেন এক অপরাধীর রিভিউর রায়, যার অর্থানুকূল্যে দিনে দিনে এদেশে বিস্তার লাভ করেছে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ আর একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মারা।

সারা জাতি তাই উদগ্রীব হয়ে রইলো সেদিনের প্রতীক্ষায়…।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)