চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মিসির আলির বাখরখানি

মিসির আলির চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সেঁকছেন বাখর খানি। পাশেই একজন তৈরি করছে ময়দার খামি এবং আরজন বেলে দিচ্ছেন বাখর খানির। ছোট্ট রুটির মতো কাঁচা বাখর খানি চলে আসছে মিসির আলির কাছে। মিসির আলি সেঁকার জন্য যত্নে বসিয়ে দিচ্ছেন তা বিশেষ চুলায়। চুলাটা মাটির নিচে পোঁতা এক বিশেষ হাড়ি। হাড়ির একপাশে সাঁর বেঁধে বসানো হচ্ছে কাঁচা বাখর খানি। আর অন্যপাশ থেকে খুব সাবধানে তুলে আনছেন বাদামী আর সোনালি রঙ লাগা চমৎকার সব বাখরখানি। এর মাঝেই লোকজন কিনতে আসছে বাখরখানি। চলছে বেচাবিক্রি।  লালবাগ রোডের মিসির আলির বাখরখানির কারখানায় গিয়ে এমন চিত্রই পাওয়া গেলো।

লালবাগ রোডের ছোট্ট দোকানটিতে বাখরখানি বানাতে ব্যস্ত মিসির আলি ও তার সহকর্মীরা
লালবাগ রোডের ছোট্ট দোকানটিতে বাখরখানি বানাতে ব্যস্ত মিসির আলি ও তার সহকর্মীরা

ছোট্ট একটা দোকান। পুরাতন। বহু আগের যুগের ছোট্ট একটা বৈদ্যুতিক পাখাও স্থির ঝুলে আছে তার দোকানে। কে জানে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘মিসির আলি’ চরিত্রটি এই মিসির আলি থেকে পেয়েছিলেন কিনা। মিসির আলির স্থির চোখ, ভাঙ্গা স্বাস্থ্য, গম্ভীর অথচ সাবলিল কথা বলার ধরন মনে করিয়ে দেয় হুমায়ূন আহমেদের কিংবদন্তী চরিত্র মিসির আলিকে।

দোকানে পুরনো আমলের বৈদ্যুতিক পাখা
দোকানে পুরনো আমলের বৈদ্যুতিক পাখা

হুমায়ূন আহমেদের  চরিত্র মিসির আলি নয়, কথা হচ্ছিলো বাখরখানির কারিগর লালবাগের মোহাম্মদ মিসির আলির সঙ্গে। তিনি জানালেন, গত পঞ্চাশ বছর ধরেই তিনি বানিয়ে আসছেন বাখরখানি। শুধু তিনিই নন, তার বাবা-দাদাও সম্পৃক্ত ছিলেন এই পেশাতেই। হুমায়ূন আহমেদকে চেনেন কিনা জানতে চায়লে মিসির আলি জানান, খুব চেনেন। তার ছেলে মেয়েরা হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে। তবে তিনি নাটক দেখেছেন। বাকের ভাইয়ের নাটক।

বাখরখানির সাথে বাকের বা বাকিরের একটা সম্পর্ক রয়েছে।

তৈরি হচ্ছে বাখরখানির জন্য খামি
তৈরি হচ্ছে বাখরখানির জন্য খামি

মিসির আলিকে শোনানো হলো বাখরখানির প্রচলিত সেই করুণ গল্পটি।

নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ একটা ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলো। ছেলেটির নাম ছিলো আগা বাকির খাঁ। আগা বাকির ছিলো যেমন  মেধাবী, বুদ্ধিমান তেমন যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শী। একদিন হলো কি, আগা বাকির খাঁ মুর্শিদাবাদের এক নর্তকীর নাচ দেখে তার রূপে মজে প্রেমে পড়ে গেলো। নর্তকীর নাম খনি বেগম। না, প্রেমে শুধু আগা বাকির খাঁ-ই খনি বেগমের পড়েনি। খনি বেগমও আগা বাকিরের প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু  দুইজনের প্রেমের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় উজির পুত্র কতোয়াল জয়নাল খাঁ।  তারপর কতোয়াল জয়নালের ষড়যন্ত্রে প্রাণ হারায় খনি বেগম। আগা বাকির খনিকে হারিয়ে হয় শোকে মূহ্যমান।

এই শোকাবহ প্রেমের স্মৃতিকে ধারণ করেই কারিগররা আবিষ্কার করে বিশেষ এক রুটি। তার নাম দেয় বাকির খনি। কালক্রমে অপভ্রংশে সেটাই রূপ নেয় ‘বাখরখানি’ নামে।

বিশেষ চুলায় সেঁকা হচ্ছে বাখরখানি
বিশেষ চুলায় সেঁকা হচ্ছে বাখরখানি

এই গল্প শোনালে মিসির আলি মুখ টিপে হাসেন। যেন মা’র সাথে বলা হচ্ছে মামার বাড়ির গল্প।

ইতিহাস মাড়িয়ে ফিরে আসা হয় বর্তমানে। মিসির আলি জানান, সত্তর বছর জীবনের পঞ্চাশ বছরই কেটেছে বাখরখানি তৈরি করে। যতদিন পারেন থাকবেন এই পেশাতেই আমৃত্যু। তিনি পেয়েছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। তার বাবা তার দাদার কাছ থেকে। তিন মেয়ে দুই ছেলের সকলেই লেখাপড়া শিখেছেন। তবে তার বিশ্বাস তার ছেলেদের কেউ না কেউ ঠিকই ধরে রাখবে তার এই ঐতিহ্যবাহী পেশা।

মিসির আলি বলছেন তার জীবনের গল্প
মিসির আলি বলছেন তার জীবনের গল্প

মিসির আলি বলেন, ‘দিনে মণ দুয়েক বাখরখানি তৈয়ার করি, সারা মহল্লার মানুষ আমার দোকানের বাখরখানি খায় পঞ্চাশ বছর ধইরা। সকাল বিকাল এই মিসির আলির বাখরখানি দিয়াই বেবাকতে নাস্তা করে।‘

বেচা-বিক্রি হচ্ছে মিসির আলির দোকানে
বেচা-বিক্রি হচ্ছে মিসির আলির দোকানে

মিসির আলির বাখরখানি ১০০ টাকা কেজি। মিষ্টি বাখরখানির কেজি ১১০ টাকা। স্প্যাশাল বাখরখানিও তৈরি করেন মিসির আলি।