বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে রোববার যে দুটি সাবমেরিন আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ হয়েছে চীন থেকে সেগুলোর সরবরাহ পৌঁছার দু’ সপ্তাহের মাথায় ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, সামরিক সরঞ্জাম এবং সমরাস্ত্রে ভারত চীনের ধারেকাছে না থাকলেও দু’ দেশই বাংলাদেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রির ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নেমে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাজারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে। এর মধ্যেই এসেছে বাংলাদেশের কাছে যুদ্ধবিমান বিক্রিতে রাশিয়ার আগ্রহের খবর।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে প্রথমবারের মতো সংযোজিত সাবমেরিন দুটির কমিশনিং অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন: আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবো না। কিন্তু কেউ যদি আক্রমণ করতে আসে তা প্রতিহত করা এবং যাতে সমুচিত জবাব দিতে পারি সেটা নিশ্চিত করছি।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশের এরকম সক্ষমতা অর্জন কতটা জরুরি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়্যারম্যান মো. তৌহিদুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাকে সবারই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আছে- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। কিন্তু অন্য দেশওতো নিজেদের সার্বভোমত্ব রক্ষার জন্য কোন পদক্ষেপ নিতে পারে। সেরকম পরিস্থিতিতে দেশকে রক্ষার জন্যই সামরিক প্রস্তুতির দরকার আছে।
শুধু আমাদের দেশই নয়, নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তিত সব দেশেরই এমন সামরিক প্রস্তুতি থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্র অবশ্যই সেসব জায়গা চিন্তা করে সাবমেরিন কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। ‘নিজেদের সমুদ্র এলাকা নিরাপদ রাখার জন্যও নিশ্চয়ই রাষ্ট্র এভাবে নিজেদের সমৃদ্ধ করছে।’
এর অংশ হিসেবেই আটটি বহুমাত্রিক যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এজন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত দরপত্র বিক্রি করে পরদিন তা খোলা হবে। ধারণা করা হচ্ছে যুদ্ধবিমানগুলোর সম্ভাব্য বিক্রেতা রাশিয়া। সেখানকার গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এসইউ-৩৫, মিগ-৩৫ এবং এসইউ-৩০ এসএম যুদ্ধবিমান তৈরি করা ইউনাইটেড এয়ারক্রাফট করপোরেশন বাংলাদেশে যুদ্ধবিমান সরবরাহে আগ্রহী। সম্ভাব্য তালিকার শীর্ষে রয়েছে চতুর্থ ++ জেনারেশনের সর্বাধুনিক মিগ-৩৫।
রাশিয়া এর আগে ১৬টি কমব্যাট ট্রেইনার ইয়াকোলেভ ইয়াক-১৩০ সরবরাহ করেছে। তারও আগে সরবরাহ করেছে আটটি মিগ-২৯।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য নতুন আটটি যুদ্ধবিমান কেনার আগে নৌ বাহিনীতে যে দুটি সাবমেরিন যোগ হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশে এসে পৌঁছে গত ১৪ নভেম্বর। দু’ সপ্তাহ পরই ঢাকায় আসেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার। ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভারত তাদের কাছ থেকে সমরাস্ত্র কেনার শর্তে বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চায়।
ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না হলেও এ নিয়ে দু’ দেশেই নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের কথা আলোচনা হচ্ছে তাই জোরেশোরে।
চীন এমনকি রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র কেনার বিষয়ে বিএনপি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ভারতের বিষয়ে তাদের প্রবল আপত্তি। দলের যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যেকোন সামরিক চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতার সামিল’। আর যেকোন সম্ভাব্য চুক্তির খসড়া প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কার্যক্রম চলছে ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর অংশ হিসেবে। এটি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য সরকারের একটি সমন্বিত কর্মসূচি। ২০১২ সালে প্রথম এ কর্মসূচির রূপরেখা প্রকাশিত হয় যার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে আধুনিক করা হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে প্রভাব রাখার পাশাপাশি একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে চায়। এর অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে সেনাবাহিনীর জন্য আধুনিক ট্যাংক ও কামান; বিমান বাহিনীর জন্য চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এবং নৌবাহিনীর জন্য সাবমেরিন ও ফ্রিগেট কেনা হচ্ছে।
ফোর্সেস গোল ২০৩০ অর্জনে নৌবাহিনীতে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছে টাইপ ০৩৫জি ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’। এগুলো টর্পেডো্ ও মাইনে সজ্জিত এবং শত্রুর যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনে আক্রমণে সক্ষম। সাবমেরিন দুটি যে ঘাঁটি থেকে পরিচালিত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারও ভিত্তি দিয়েছেন। ঘাঁটিটির নাম হবে ‘বিএনএস শেখ হাসিনা’।
শুধু যুদ্ধবিমান বা সাবমেরিন কেনা নয়, ফোর্সেস গোল ২০৩০’র অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর নতুন ইউনিট গড়ে তোলাসহ বাহিনীকে আধুনিকভাবে সজ্জিতও করা হচ্ছে।
‘বেটার সেফ দ্যান স্যরি’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘যুদ্ধ নয়, আক্রমণের শিকার হলে প্রতিহত করার সক্ষমতা’ নীতিকে সমর্থন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মন। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, একটা প্রচলিত কথা রয়েছে: বেটার সেফ দ্যান স্যরি। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এসব কেনা দরকার।
‘আজ হয়তো এসবের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু যেকোন সময় প্রয়োজনতো আসতে পারে। সেই সময়গুলোতেই কাজে আসবে এসব।’
ডালেম চন্দ্র বর্মন বলেন, আমরা নিশ্চয়ই কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাব না, কিন্তু কখনো যদি কারো আক্রমণের শিকার হই তাহলে নিজেদের যেন রক্ষা করতে পারি সেজন্য এসব অবশ্যই দরকার আছে। যখন যে রকম পরিস্থিতি, সেরকম পরিস্থিতিতে সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। আর সেটাই এখন হচ্ছে।
তিনি বলেন: যখন যেভাবে সম্ভব, নিজেদের ভবিষ্যত নিরাপত্তার কথা ভেবে সামরিকভাবে নিজেদের আরো বেশি সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে।