চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মালয়েশিয়ায় শিরদাঁড়া শীতল করে দেওয়া যে ঘটনা

রাত ৯টা ২০ মিনিটে ফ্লাইট। অন্ততঃ তিন ঘণ্টা আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে হবে। এমনটাই কথা ১১ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের। সময়মতো এয়ারপোর্টে পৌ‍ঁছানো চাই। তাই কুয়ালালামপুরের আমপ্যাং এলাকা থেকে ঠিক ৫টা ৫ মিনিটে রওনা হলাম আমরা।

বিষুবীয় অঞ্চলের দেশ মালয়েশিয়া। যখন তখন এই বৃষ্টি, এই সোনালী রৌদ। বৃষ্টির পানিতে ধুলি-ধোয়া ধুয়ে চারপাশের গাছপালা সব সময় সতেজ আর সবুজ। পিচ ঢালা দারুণ মসৃণ সড়ক ধরে রওনা হবার খানিকটা পরেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। মনে হলে মালয়েশিয়াতে কাটানো এই ক’দিনে আমার ভেতরের জমানো সব কান্না-আবেগ বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে দিচ্ছে। 

প্রিয় লাল-সবুজের দেশ, প্রিয় সন্তানের কাছে ফেরার আনন্দে ভেতরে ভেতরে দারুণ উদ্বেলিত হচ্ছি। একইভাবে ক্ষণে ক্ষণেই দারুণ অনিশ্চয়তায় বিষন্নতা পেয়ে বসছে। কারণ পাসপোর্ট চুরির পর মালেয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন আমাকে দিয়েছে ‘ট্রাভেল পারমিট’। আর ‘পুত্রজায়া ইমিগ্রেশন’ থেকে ইস্যু করা ‘স্পেশাল পাস’ দিয়ে আপাতঃ সেই ‘পুলসিরাত সমান’ কুয়ালালামপুর আন্তজার্তিক এয়ারপের্টের ইমিগ্রেশন সত্যি সত্যি পার হওয়া যাবে তো? কারণ এরইমধ্যে ‘দুর্নীতিবাজ’ মালয়েশিয়ান পুলিশ আর ‘না বুঝদার’ মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশন নিয়ে হাজারটা গল্প শোনা হয়েছে।

এবার তাহলে আমার ভোগান্তির গল্পটা খুলেই বলি!
৩১ অক্টোবর রাতের ফ্লাইটে যাত্রা করে ১ নভেম্বর মালয়েশিয়া এসেছি। উদ্দেশ্য একটি আন্তজার্তিক সম্মেলনে অংশ নেয়া। ২ নভেম্বর শুরু ওই সম্মেলনে এশিয়ার ৩০ দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। মালয়েশিয়ার নতুন শহর পুত্রজায়ায় সেদেশের সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কেন্দ্রে বসবে এশিয়ার ত্রিশ দেশের প্রতিনিধিদের মিলন মেলা। ৫২ তলা বিল্ডিংয়ের মাটির নিচে দ্বিতীয় তলায়, লিফটে বি-২ মানে বেজমেন্ট দুয়ে এক এলাহি অবস্থা। তবে ভুগর্ভস্থ বলে নেটওয়ার্কের অবস্থা শোচনীয়। তারপরও দারুণ উদ্দীপনায় ঢাকায় নিউজ পাঠাতে তৎপর আমি। সময়ের হিসাবে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া থেকে দুই ঘণ্টা পিছিয়ে। তাই লক্ষ্য ছিলো বেলা দুইটা থেকেই নিউজ ‘অন এয়ারে’ দেয়ার।

কিন্তু মাটির নিচে ওই এলাহি বলরুমে নানান নামের ওয়াইফাই কানেকশন পেতে বিস্তর দৌড়ঝাঁপ। কোনটা ইনঅ্যাকটিভ তো অন্যটা পেতে অমুককে বলতে হবে। এভাবে বেলা গড়িয়ে প্রথম দিনের সম্মেলন শেষ হয় হয় অবস্থায় ফুটেজ ও বাইট পাঠালাম। এরপর স্ক্রিপ্টের জন্য অপেক্ষা। বুঝতে পারছি ক্রিপ্ট হাতে আসতে আসতে সেদিনের মতো সম্মেলন শেষ হয়ে যাবে। হোটেলে ফিরে ভয়েস দেয়া ছাড়া উপায় নেই। কাগজে-কলমে ওয়াইফাই থাকলেও বাস্তবে কতটা কার্যকর আর তার গতিশীলতা নিয়েও সংশয়।

তবে উপায় নেই। শাটল বাস হাজির। পর্যটকদের জন্য যুতসই ওই বাসে করে ২০ মিনিটের দূরত্বে ফিরতে হবে পুত্রজায়ার আইওআইসিটির ‘হোটেল পাম গার্ডেনে’। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ যথারীতি হোটেলে ফিরে ভয়েস পাঠানোর ব্যস্ততা। আয়োজক, সফরসঙ্গি আর হোস্ট কান্ট্রির পক্ষে মিসেস নরজিনা বার বার মনে করিয়ে দিলেন ৭টায় ডিনার।

এতে উপস্থিত থাকবেন সেদেশের স্বাস্থ্য ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রীসহ উধ্বর্তনরা। ব্যাপক খানাপিনার সাথে স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। সুতারং মিস করো না। মাথা দুলিয়ে স্মিত হেসে বললাম চেষ্টা করবো। কারণ আমার এখনো ভয়েস পাঠানো বাকি। হোটেলে রুমের ওয়াইফাই গতির সাথে না পেরে লবিতে এসে কাঠের চেয়ারে বসে অপেক্ষায় থাকলাম আইটি ম্যানেজারের। কেননা যে কোনো কারণেই হোক নেট সংযোগ ইনঅ্যাকটিভ।

সুতারং কর্তৃপক্ষের আশ্বাসমতো ১৫ মিনিটের জায়গায় ঘণ্টা খানেক পরে সংযোগ পেলাম। ভয়েসও পাঠালাম। ততক্ষণে রাত ৯টা ছুঁইছুঁই। ঢাকায় তখন সন্ধ্যা সাতটার প্রাইম টাইম নিউজের সময় ঘনিয়ে! সারাদিনের পরিশ্রম! তারপরও সময়মতো নিউজ অনএয়ারে যাবে কিনা সংশয় মনে। এর আগে রুমের ইন্টারকমে বার বার সফর সঙ্গীদের তাগাদা, ডিনারে যেতে হবে সময়মতো তৈরি থেকো। পরে লবিতে যাওয়া-আসার পথে সবারই এক প্রশ্ন, ডিনারে যাচ্ছো না?

এর মধ্যে ঢাকা থেকে সহকর্মী নিশাত জানালো, ভয়েসটা আবার পাঠানো যাবে? এমনিতেই চরম ক্ষুধার্ত! মাথায় যেন বাজ পড়লো! আমিতো লবি থেকে সবে রুমে উঠে এসেছি। আবারো লবিতে নামতে হবে, আচ্ছা অপেক্ষা করো আমি নামছি। এর কিছু সময় পরেই ফোন, না আপা ঠিক আছে। চলবে, তবে ফুটেজ কম। আমি বললাম, না না ফুটেজ কম হবে না! ভালো করে দেখো! ফোন করে নিউজ অন এয়ার হবার খবরে স্বস্তি পেলাম। কিন্তু ততক্ষণে রাজসিক ডিনার মিস করেছি। তাতে কিছুই এসে যায় না। যদিও পেটের অবস্থা সঙ্গীন। কিন্তু, তখনো জানি না আমার সামনে অপেক্ষা করছে আরো বিস্তর দীর্ঘ পথের অনিশ্চিত চরম এক ভোগান্তি!

৩ নভেম্বর সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন। আগের রাতেই জানিয়েছিলো শাটল বাস ছাড়বে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে। হোটেল থেকে ২০ মিনিটের পথ। সম্মেলন শুরু হবে ঠিক ঠিক ৯টায়। বিদেশী প্রতিনিধিরা ছাড়াও মালয়েশিয়ান সরকারের হাই অফিসিয়ালরা থাকবেন। সুতারং ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে গোসল সেরে তৈরিই ছিলাম। বাংলাদেশী সফর সাথীদের একে অন্যের সাথে ইন্টারকমের যোগাযোগমত ব্রেকফাস্টের জন্য দু-এক মিনিট আগে-পিছে হোটেল ক্যাফেতে প্রবেশ করলাম। কিন্তু একই লম্বা টেবিলে স্থান সংকুলান না হওয়াতে পাশের টেবিলে ভিডিও ক্যামেরা, ল্যাপটপ ব্যাগ কা‍ঁধ থেকে নামিয়ে কিউতে দাঁড়ালাম। এক হাতে দুধ- কর্নফ্লেক্স, অন্যহাতে অ্যাপল জুসের গ্লাস নিয়ে ত্রিশ সেকেন্ড পরেই নিজের টেবিলে ফিরলাম। গ্লাস-বাটি নামিয়ে রেখে ডিম ওমলেট নিতে টেবিল ছাড়লাম।

যাবার আগে কাঁধের হ্যান্ডব্যাগটা ভিডিও ক্যামেরা ও ল্যাপটপ ব্যাগের মাঝখানে চাপা দিয়ে রেখে গেলাম। ঘূর্ণক্ষরেও ভাবিনি এরপরই শুরু হবে বিদেশ বিভূঁইতে আমার চরম ভোগান্তির অনিশ্চিত এক যাত্রার গল্প। ‘ফোর স্টার হোটেল’। অতিথিরা সবাই যার যার ব্যাগ চেয়ারে রেখে বুফেতে নাস্তা চয়েস করছেন। খাবার প্লেট হাতে নিচ্ছেন, খেয়ে আবারো বুফেতে ফিরে চা-কফি দিয়ে নাস্তার ইতি টানছেন।

আমার স্মরণশক্তি যা বলে, এক বড়জোর দেড় মিনিটের মাথায় নিজ টেবিলে ফিরে দেখলাম যথাস্থানে নেই আমার সেই তিনটি ব্যাগ। ভাবলাম কেউ হয়তো সরিয়ে রেখেছে। ব্যাগের জন্য আওয়াজ দিলাম। কোনো সাড়া নেই। হঠাৎ শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা শীতল এক ব্যথা আমার নিয়মিত ব্যাকপেইনের মাত্রা যেন হাজারো গুণ বাড়িয়ে দিলো। চোখে দেখি তো কানে শুনি না অবস্থা। আয়োজক, উদ্যোক্তা, সফরসাথি সকলেই সচেতন হলেন। তখনও সবারই ধারণা যে ভুল করে কেউ নিজের ব্যাগ ভেবে আমারটা তুলে নিয়েছেন।

ইতোমধ্যে হোটেলের সামনে দাঁড়ানো শাটল বাসের সবাইকে ইনফর্ম করা হলো। হোটেল থেকে মিনিট বিশের দূরত্বে কনফারেন্স সেন্টারেও অবহিত করা হলো বিষয়টি। ক্যাফেটেরিয়া দরজা পেরেলেই হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্ক। এক দৌড়ে সিঁড়ি টপকে ছুটে গিয়ে ডেস্কে বললাম মালিক-ম্যানেজার যে আছে আমাকে ফোনে দাও। কথা বলবো। নো ‘ম্যাম’ ম্যানেজার এখনো আসেনি। আমরাই ফোনে জানাচ্ছি। আপনি অপেক্ষা করেন। ওহ গড! ঘটনার আকস্মিকতায় লম্বা করে শ্বাস নিলাম।

মনে মনে তিনটি ব্যাগের ছবিটা মানসপটে দেখতে পেলাম। অফিসের ম‍ূল্যবান জিসিন গেছে। কিন্ত আমার হ্যান্ডব্যাগে যে আমার পাসপোর্ট-টিকেট আর হাতখরচের সব ডলার? দেশে ফেরার অনিশ্চয়তায় প্রিয় দুই সন্তানের কান্না ভেজা মুখ ভেসে উঠলো।

৩১ অক্টোবর রাতে ঢাকায় বিমান বন্দরে ফ্লাইটে উঠার যাত্রা পথে টার্মিনাল অবধি এবার যেতেই দেয়নি। এয়ারপোর্টে এখন দারুণ কড়াকড়ি। দ্বিতীয় তলায় টার্মিনালে ঢোকার অনেক পথ আগেই শুধু যাত্রীসমেত গাড়ি অ্যালাও করেছে। অনেক কষ্টে কান্না চেপে মনের স্বচ্ছ পর্দায় দেখতে পেলাম নিরাপত্তা প্রহরীরা আমার কাঁদো কাঁদো দুই বাচ্চাসহ আমার প্রিয়জনদের নামিয়ে দিলো সেই আইল্যান্ডে।

আমি কাঁধ ঘুরিয়ে চেষ্টা করেও বাচ্চাদের মুখটা দেখতে পেলাম না। এতসব আবেগের জোরারে মন ভেঙ্গে আসতে চাইছে। হঠাৎ মনে হলো যা গেছে যাক। আমার দেশে ফেরার ব্যবস্থাটাই আগে করতে হবে। সুতরাং আমার আগে পাসপোর্ট উদ্ধার জরুরী।

কুয়ালালামপুরের সুউচ্চ সব দালান ‘টুইন টাওয়ার’ বা ‘পেট্রোনাস টাওয়ার’ আর অথনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে থাকা মাহাথির মোহাম্মদের দেশের উন্নয়নের বহু গালগল্প শুনেছি। কিন্তু ওই দেশে যাবার পর প্রায় প্রতিটি স্থানে বাঙ্গালীদের মুখে যা শুনেছি তাতে আমার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার আগেই উপলদ্ধি হয়েছে সুচ্চ দালান-কোঠার প্রতিটি আনাচে-কানাচে গুমরে কাঁদছে মানবতা।

মালয়েশিয়ান পুলিশ দুনীর্তিতে দারুণ চ্যাম্পিয়ন। তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে তামিলদের উৎপাত। যদিও এদেশের রক্তচোষাদের অনেকেই মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করে গাড়ী হাকিয়ে-বাড়ি করে সেদেশে দ্বিতীয় আবাস গড়ে আয়েশি পরবাসের মজা লুটছে, কিন্তু শান্তিন্তে নেই সাধারণ শ্রমজীবী বাঙ্গালীরা।

দারুণ চাপে মানুষের বুদ্ধি খোলে। আমারও সেই অবস্থা। হোটেল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করলাম। ফোর স্টার হোটেল অথচ কোনো নিরাপত্তা প্রহরী নেই। ম্যানেজারকে জানানো হয়েছে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে। উনি আসি আসি করে হোটেলে আমাদের দেখা দিলেন প্রায় সাড়ে ১০টারও পরে। চুরি যাওয়ার একটি ফর্ম পূরণ করে নিকটস্থ থানায় যাবার পরামর্শ দিলেন। আমার তখন অসহায় অবস্থা। তবে পরিস্থিতির কারণেই ভেতরের জেদ, রাগই যেন আমাকে শক্তি যোগাচ্ছে। এর আগে হোস্ট দেশের আয়োজকরা বার বার সরি বলেছেন। দেরিতে হলেও সম্মেলন শুরুর গুরুত্ব তুলে ধরে ফোনে যোগাযোগ রাখবেন এই অঙ্গীকারে স্টেলা নামে এক মহিলাকে রেখে হোটেলও ছেড়েছেন তারা। ম্যানেজারকে আমার তখন এক কথা। তোমার স্টাফরাই জড়িত। সুতারং তোমরা আমার জন্য যা যা দরকার তার সবই করবে।

অনেকটা অনিচ্ছায় ম্যানেজার নিজে ড্রাইভ করে আমাদের থানায় নিয়ে গেলেন জিডি করা হলো। পাসপোর্ট পেতে এর পরপরই কুয়ালালামপুরে যাবার ইচ্ছা থাকলেও হোটেল ম্যানেজার জানালেন হোটেলেই থাকুন। মিনিট পনের মধ্যেই তদন্তের জন্য পুলিশ হোটেলে আসছে। সেই পনের মিনিট পার হলো ঘণ্টা দুয়েকে। ততক্ষণে লাঞ্চ টাইম পেরিয়েছে। ইতোমধ্যে আমার প্রবল ইচ্ছা হোটেলের সিসি ক্যামেরা আমাকে দেখানো হোক। কিন্তু গড়িমসি করছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। সুতারং আয়োজক-উদ্যোক্তো-সফর সঙ্গীদের দিয়ে চাপের মুখে ওইদিনই হোটেলের ক্যাফেটেরিয়ার প্রবেশ মুখের সিসি ক্যামেরায় রক্ষিত ভিডিও ফুটেজ দেখলাম। কিন্তু ছবি দেখে বুঝলাম ততক্ষণে ভিডিও ফুটেজ এডিট হয়ে গেছে। ওই সিসি ক্যামেরার রের্কড বলছে, আমি সাতটা ৫৬ মিনিট ৬ সেকেন্ডে ক্যাফেতে প্রবেশ করেছি। আর আটাটা চার মিনিটে আবার বেরিয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে চুরির বিষয়টি ইনফর্ম করেছি। ত্রিশ দেশের প্রতিনিধিদের প্রায় অর্ধেক এই হোটেলে। সকালের নাস্তার পর পরই বাসে উঠার তাড়া। অথচ আমরা দেখলাম মাত্র দুই-তিন জন ওই পথে বেরিয়েছেন।

ইন্ডিয়ান মালিকানায় পুরানো কিন্তু বিশাল হোটেল। মজার বিষয় হলো ক্যাফেতে প্রবেশের মুখে একটি মাত্র সিসি ক্যামেরা, আরেকটি রয়েছে বুফে খাবারের লাইনে। যদিও ওই সিসি ক্যামেরা খাবার টেবিল এমনকি ক্যাফের পেছনের দরজাও কাভার করে না। জানলাম, ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। একটি ফোর স্টার হোটেলের একি হরিবল অবস্থা! দাঁতে দাঁত ঘষে কান্না ঠেকালাম। আর মনে মনে প্রায়োরিটি ঠিক করলাম কোনটি আমার জরুরী ! পরদিন আবারো পুলিশ তদন্তে হোটেলে আসবে এমন তথ্য জানালেন ম্যানেজার। মনে মনে বললাম, গুলি মারি তোমার পুলিশী তদন্তে। আমার এখন জরুরী পাসপোর্টের ব্যবস্থা। সুতারং আজ আমার গন্তব্য কুয়ালামলামপুর।

হোস্ট কান্ট্রির আয়োজকদের অনুরোধ করলাম, আমাকে কুয়ালালামপুরে যেতে হোটেল থেকে ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা করে দাও। আর তোমাদের ইমিগ্রেশনে যেন কাজ সহজ হয় এর জন্য তোমাদের বিশ্বস্ত একজনকে দাও আমার সাথে। সেই মতো হোটেল থেকে প্রথমে কনফারেন্স হয়ে সেখান থেকে ‘স্টেলাকে’ পিক করে কুয়ালালামপুরে যাত্রা। গন্তব্য ১১৪/৬ জালান উ থ্যান্ট ‘বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিস।’ গেইট থেকেই লক্ষণীয় বাঙ্গালী শ্রমজীবীদের দীর্ঘ লাইন।

খুঁজে পেলাম এক টুকরো বাংলাদেশ। লেবার উইংয়ের ফার্স্ট সেক্রেটারি মুশাররাত জেবিন। দারুণ স্মার্ট আর কাটা কাটা কথার কাজে কর্মে দারুণ চটপটে। আমাকে দেখে চমকে গেলেন। বললেন, বাকেয়া আপনি? আপনাকে তো টিভিতে দেখি! ঘটনা জেনে সম্প্রতি উনার মেয়ের স্কুলে তিনি কিভাবে মোবাইল হারিয়েছিলেন তার গল্প বললেন। ততক্ষণে আমার ভেতরের আবেগের বরফ যেন গলছে! কিন্তু আমার আমিকে আরো কঠিন অবয়বে রাখতে নিজেকে নিজেই কষে ধমক দিলাম। উনি বললেন, পাশের ব্লকেই ‘মে ব্যাংকে’ ৪৫ রিঙ্গিত জমা দিয়ে আসুন। ছবিও লাগবে। হায়রে কপাল ! ছবিতো ছিলো আমার হ্যান্ডব্যাগে।

আপা আশ্বস্ত করলেন, হাইকমিশন অফিসের মধ্যেই ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে। সুতারং ৬ (এক রিঙ্গিত এদেশের আঠারো টাকা।) রিঙ্গিত দিয়ে পাশেই ছবি তুললাম। ফিরে ব্যাংক রিসিপ্ট আর ছবি দিয়ে ফর্ম পূরণ করে ফার্স্ট সেক্রেটারি মুশাররাত জেবিনের কক্ষে অপেক্ষায় থাকলাম। ৪০ মিনিটের মধ্যে হাতে হাতে পেলাম বহু কাঙ্খিত ‘ট্রাভেল পারমিট’। এমনিতে তিন মাসের ভিসা ছিলো আমার। ফার্স্ট সেক্রেটারি বললেন, কেকা’ মাত্র চার দিন গেছে আপনার। আপনি অন্ততঃ ২৬ দিনের ভিসা চাইবেন। চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ঢাকায় মোহম্মদরে বাসা। ঢাকায় ফিরলে যোগাযোগ হবে।

তাড়া আছে, যেতে হবে সেই পুত্রজায়ার ইমিগ্রেশন অফিসে। হাতে ওয়ার্কিং হাওয়ার প্রায় দুই ঘন্টা।

হঠাই দেখলাম ‘জেবিন আপা’ কেকা কেকা’ বলে ডাকতে ডাকতে সিঁড়ির মাঝ অবধি নেমে এসেছেন। আমিও চমকে বললাম কি হয়েছে আপা? না না কিছু না। জাস্ট আপনি আরেক বার চেক করে নেন আপনার পাসপোর্ট নম্বরটা ঠিক আছে কি না? ভীষণ কৃতজ্ঞাবোধে নিজের বুকে হাত রেখে স্মিত হেসে উনাকে সম্মান জানালাম। আর চোখের পানি লুকাতে খুব দ্রুতই দৃষ্টি ফেরালাম অন্যদিকে!

মালয়েশিয়ার নতুন শহর ‘পুত্রজায়া’। ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। সাথে থাকা স্থানীয় উন্নয়নকর্মী ‘স্টেলা’ও বার দুয়েক ভুল করে অবশেষে ইমিগ্রেশন অফিস খুঁজে পেলেন।

নতুন সুউচ্চ বিল্ডিং’এর ছয় তলায় ইমিগ্রেশনের একটি অংশ কেবল স্থানান্তর হয়েছে। লম্বা লাইন। তবে পাশের বুথেই এক’শ রিঙ্গিত জমা দেওয়ার ব্যবস্থা। তার রিসিপ্ট আর হাইকমিশন থেকে পাওয়া ‘ট্রাভেল পারমিট’ দেখিয়ে ঘণ্টা খানেকের অপেক্ষা। উৎকণ্ঠার অপেক্ষার শেষ হলো প্রায় অফিস টাইমের শেষ সময়ে। অবশেষে ‘পুত্রজায়া ইমিগ্রেশন’ থেকে মিললো সাত দিনের ভিসা। যদিও পরিকল্পনা ছিলো ‘ট্রাভেল পারমিট’ আর ‘ভিসা’ পেলেই দেশে ফিরবো। কিন্তু আয়োজক-উদ্যোক্তা ও আমার সফরসঙ্গীরা পরামর্শ দিলেন, গ্রুপে আমাদের সাথেই তোমার ফেরা উচিত হবে।

রাতে আমার স্বামীও সেই পরামর্শই দিলেন। সাত দিনের ভিসা ইস্যুর খবরে আপাততঃ খুশি হলেও আয়োজকরা বললেন, হোটেলের লম্বা হাত। ঝামেলা এড়াতে তোমাদের তাড়াতাড়ি এদেশ থেকে বের করতে চাই। শুধু কি তাই! দেশে ফিরে নতুন পাসপোর্ট পেতে নিয়মমতো এদেশের স্থানীয় থানায় জিডি করলাম। সেখানে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সুবাদে উদ্ধার করলাম ‘পুত্রজায়ার’ স্থানীয় পুলিশ স্টেশন আমার জিডির উপরে ৩ নভেম্বরের স্থলে ৩০-১১-২০১৫ লিখেছে। তিনের আগের শূন্যটা পরে বসিয়ে কার্যত অকার্যকর করে দিয়েছে আমার জিডিটি।

অথচ আমার খুব মনে আছে জিডির কপি প্রিন্ট করার আগে একাধিকবার চেক করে দিয়েছিলাম। সরকারী চাকরির সুবাদে দুই-তিন বছর বাদে বাদেই বাবা পোস্টিং হতো এদেশের আনাচে-কানাচে। নাওয়া খাওয়া ভুলা, রাজনীতি, সমাজনীতি আর আড্ডা প্রিয় বাহিরমুখী আমার বাবা, মাকে নিয়েই চষে বেড়াতেন তার সব যাত্রাপথ। অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সী আর মায়ের ছোট্ট সন্তান বিধায় প্রতিবার ওই যাত্রা শুরুর মাস খানেক আগে থেকেই শুরু হতো আম্মার কান্না।

সরকারী চাকুরে রাশভারি দাদু ঠিকই বুঝতেন ঘোরাঘুরির মহাত্ম্য, তাই ছেলের সাথে বৌমাকে যেতেই হবে-দাদুর ছিলো এই মত। আর মজাদার খাবার রান্নায় পটু দাদী অবশ্য প্রতিবার আম্মাকে বুঝ দিতেন ‘যাও বৌমা যাও’, নতুন দেশ দেখবে, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হবে। একেক স্থানের একেক খাবার খাবে, সংস্কৃতি চিনবে, কত কিছু দেখবে-জানবে এমনকি রান্নাও শিখবে।

সত্যি দাদুর সেই কথামত পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে নিজের দেশের সৌন্দর্য বার বার দেখেছি। ভালোবাসতে শিখেছি এই বাংলার মাটি-মানুষ আর সবুজকে। সেই ছোট্ট বেলাতে ঘুরফিরি জীবনের কারণে বহু বার স্কুল বদল হয়েছে। এতে করে নতুন বন্ধু পেয়েছি আবার হারিয়েছিও। তবে সব সময় সমৃদ্ধই হয়েছি। তবে এবারের ভ্রমনে অনিশ্চিয়তায় এক যাত্রায় দারুণ শিক্ষা তো হয়েছেই। সাথে নতুন উপলদ্ধি হয়েছে, চাকচিক্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে মানুষের কান্না।

নিরবে কাঁদছে মানবতা। সুউচ্চ দালানের গায়ে গায়ে কান্না প্রতিধ্বনিত হলেও তা ইথারেই ভেসে যায়। আর শুধু মাত্র সৌভাগ্যবানের কান্নাই মাটির এই পৃথিবীতে ফেরার সুযোগ পায়। পরম করুণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞতা আমি সেই সৌভাগ্যবানদেরই একজন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)