চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মন্ত্রী-এমপিদের স্বজন সিন্ডিকেটই কি অনিয়মের মূলে নয়?

রাজনীতিতে স্বজনপ্রীতির দৌরাত্ম চরম আকার ধারণ করেছে। মন্ত্রী-এমপিদের ঘিরে আখের গোছানো লোকেদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে খোদ মন্ত্রী-এমপিরাই। একটি ভারতীয় বাংলা ছবির কাহিনী বাস্তব হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। ছবিটির নাম মুখ্যমন্ত্রী। প্রতিপক্ষকে হারাতে রাজ্যের তথ্যমন্ত্রী ভোটে দাঁড় করিয়ে দিলেন একজন সাদামাটা, সৎ ও জনপ্রিয় স্কুল মাষ্টারকে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বসলেন, এই স্কুল মাষ্টার যদি ভোটে জিততে পারে তাহলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার তাকে তিনি দিয়ে দেবেন। মুখ্যমন্ত্রী তার শালার ক্ষমতার দাদাগিরিতে অতিষ্ট ছিলেন। হেডমাষ্টার ভোটে দাঁড়াল।

ভোটের খবর পেয়ে হেডমাষ্টারের ভাই চাকরি ছেড়ে চলে এলো। হেডমাষ্টার ভাইকে জিজ্ঞেস করল, চাকরি ছাড়লি এখন চলবি কি করে? ভাই বলল, তুমি এমপি হয়ে পরে মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছো। আমার চাকরির কি প্রয়োজন? তখনতো খালি টাকা আর টাকা। হেডমাষ্টারের বখাটে পুত্র, কন্যা, স্ত্রী, বোন, বোনের জামাই সবাই আনন্দে আত্মহারা হেড মাষ্টার এমপি হলেই মুখ্যমন্ত্রী হবে।

তারা কে কোথায় কোন ফ্ল্যাটের মালিক হবে, কে কত গয়না কিনবে তার অংক কষতে শুরু করে। নির্বাচন শুরু হয়ে গেল হেডমাষ্টারের পক্ষে চলে গেল সকল জনমত। এবার ভাবনায় পড়ে গেল মুখ্যমন্ত্রী। চেয়ারটা বুঝি সত্যিই ছেড়ে দিতে হচ্ছে। তখন মুখ্যমন্ত্রী হেডমাষ্টারের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বুদ্ধি দেয় হেডমাষ্টারকে গুন্ডা দিয়ে মেরে ফেলতে। কিন্তু হেডমাষ্টারকে একটা বাচ্চা ছেলে বাঁচিয়ে দিল। হেডমাষ্টার জিতে যাবে সেটা যখন নিশ্চিত হয়ে গেল, তখন পরিস্থিতি পাল্টে গেল থানা পুলিশ যে এমপির কথায় ওঠবস করতো সে এমপির গায়ে হাত তুলে লক আপে পুরলো। যে মুখ্যমন্ত্রী হেডমাষ্টারকে খুন করতে গুন্ডা পাঠিয়েছিল তিনিই হেডমাষ্টারের নির্বাচনী জনসভায় হাজির হয়ে তার জন্য ভোট চাইলেন।

পত্রিকায় হেডলাইন হলো, হেডমাষ্টার জিতছেন ও মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারে পড়ে গেল শোকের মাতম। স্ত্রী বলল, তুমি এমন ঘোষণা কেন দিতে গেলে? মুখ্যমন্ত্রীর মন্ত্রীত্ব যাওয়াতে মন্ত্রীর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হলো তার পরিবার ও স্বজনরা। আর যে মন্ত্রীত্ব পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি উৎফুল্ল তার স্বজনরা।

এই স্বজনদের দৌরাত্মেই বাংলাদেশের রাজনীতি হারাচ্ছে আদর্শ। তারই একটি দৃষ্টান্ত দৃশ্যমান হলো বগুড়ায়। বগুড়ার মহাস্থানে এক অনুষ্ঠানে লোকজনের উপস্থিতি কম হওয়ায় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও স্থানীয় এক সাংবাদিককে পেটালেন জাতীয় পার্টির সাংসদ ও তার ছেলে। অভিযুক্ত শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনের জাতীয় পার্টির মনোনীত এমপি এবং তার ছেলে শিবগঞ্জ উপজেলা জাতীয় যুবসংহতির আহবায়ক হুসাইন শরিফ সঞ্চয়।

তারা সাংবাদিককে মারধর করে ও জোরপূর্বক তার ক্যামেরা ও মোবাইল ফোনও কেড়ে নেয়। ১ নভেম্বর, ২০১৮ বিকালে শিবগঞ্জের মহাস্থান উচ্চবিদ্যালয়ের চতুর্থ তলা একাডেমিক ভবনের নাম ফলক উম্মোচন অনুষ্ঠানে এ ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে রাত ৮টায় সাংবাদিকের মোবাইল ফোন ও ক্যামেরা ফেরত দেওয়া হয়। মারধরের শিকার সাইদুর রহমান সাজু মহাস্থান প্রেসক্লাবের সভাপতি।

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার বিকালে মহাস্থান উচ্চ বিদ্যালয় ভবনের ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সাংসদ শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। বিশেষ অতিথি ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ ছেলে হুসাইন শরিফ সঞ্চয়, অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও সাংসদের ভগ্নীপতি রফিকুল ইসলাম দুলাল। অনুষ্ঠানে আশানুরূপ উপস্থিতি না থাকায় প্রধান অতিথি বিদ্যালয়ের সভাপতি ও কমিটির অন্যান্য সদস্যদের উপর ক্ষুব্ধ হন। এক পর্যায়ে তিনি অফিস থেকে বের হয়ে উপস্থিতি কম হওয়ার কারণে সাজুর কাছে কৈফিয়ত চান। এ সময় তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই সাংসদ নিজেই তাকে কিল ঘুষি মারতে থাকেন। এক পর্যায়ে হুসাইন শরিফ সঞ্চয় ও তার সাথে থাকা শেখ ফজলুল বারী সাজুকে স্কুলের কমন রুমে নিয়ে গিয়ে মারধর ও লাঞ্চিত করেন এবং তার ক্যামেরা ও দুইটি মোবাইল ফোন কেড়ে নেন। এ সময় দৈনিক বগুড়ার মহাস্থান প্রতিনিধি সুমন ও নুরন্নবী রহমান ঐ ঘটনার ছবি তুলতে চেষ্টা করলে তাদের ব্যবহৃত ক্যামেরা ও মোবাইল ফোনও ছিনিয়ে নেয়া হয়৷রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

সাংসদ প্রধান অতিথি, সাংসদের ছেলে বিশেষ অতিথি ও সাংসদের ভগ্নিপতি সভাপতি কি চমৎকার পারিবারিকীকরণ ও সিন্ডিকেট! কেন এই এলাকায় কি অন্য কোন লোক ছিলোনা? বাংলাদেশের বেশির ভাগ এমপিই এমন পারিবারিকীকরণ ও স্বজন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে৷ মহাস্থানের এমপিরটা দৃশ্যমান হলো অন্যদেরটা দৃশ্যমান হয়নি এই যা৷ সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেছেন, রাজনীতি এখন গরীবের ভাউজ হয়ে গেছে৷ তিনি সাংসদ থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে তার আসনে উপনির্বাচনে সাংসদ হন তারই ছেলে রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক৷ এখন আবার শোনা যাচ্ছে তার আরেক ছেলে রাসেল আহমদ তুহিন কিশোরগঞ্জের আরেকটা আসন হতে মনোনয়ন প্রত্যাশী৷ রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তার ব্যক্তিগত সহকারীও বানিয়েছেন তার ভাইকে৷ এটাও রাজনৈতিক নেতাদের পারিবারিকীকরণ নয় কি?

মহাস্থানের এমপি শরীফুল ইসলাম জিন্নাহ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি হয়তো ভেবেছেন এমপি হলে তো ভোট লাগেনা তাই জনগণ কি ভাবলো ভাবার দরকার কী? বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার প্রবণতা সংসদ হতে ইউনিয়নেও সংক্রমিত হয়। বিগত ইউপি নির্বাচনে ২ শতাধিক ইউপিতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ৫৫৪ ইউপিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির কোন প্রার্থী ছিল না। ১৫৪ জন সংসদ সদস্যের বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে এটির ব্যাপকতা শুরু হলো। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান এগুলো কোন পারিবারিক পদ নয়। তা দলের মধ্য দিয়ে একদিন দেশের ও জনগণের হয়ে ওঠে। কিন্তু কতিপয় জনপ্রতিনিধিকে ঘিরে গড়ে ওঠে পরিবার, গোষ্ঠী তথা স্বজন সিন্ডিকেট৷ অনেক ক্ষেত্রে মন্ত্রীর কথাকেও উড়িয়ে দেয় এসব সিন্ডিকেট৷মন্ত্রীর ঘনিষ্টজন হলে হয় ক্ষমতাধর আর বিরাগভাজন হলে হয় অসহায়। মন্ত্রীর দোহাই দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করতে মন্ত্রীকেও ছাড়িয়ে যান এসব ঘনিষ্টজনেরা৷ কারণ মন্ত্রী জেগে ঘুমায় আর তারা কেবলই জেগে থাকে৷সম্প্রতি পোষ্টারেও তাই অমুক মন্ত্রীর/অমুক এমপির ঘনিষ্টজন ও বন্ধু, ভাই ভাতিজা, পুত্র লেখা চালু হয়ে গেছে৷ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘বন্ধু’ পরিচয়ে নির্বাচনী পোস্টার সাঁটা হয়েছে ময়মনসিংহের নান্দাইলে। যা নিয়ে সেখানকার স্থানীয় বিএনপিতে চলছে বিতর্কের ঝড়। ময়মনসিংহ-৯ নান্দাইল আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী ইয়াসের খানের রঙিন ছবি সম্বলিত ওই পোষ্টারে লিখা হয়, নান্দাইলের উন্নয়নে তারেক রহমানের বন্ধু তথ্য প্রযুক্তি বিজ্ঞানী ইয়াসের খান চৌধুরীকে এমপি হিসেবে দেখতে চাই। প্রচারে-নান্দাইল উপজেলা, পৌর যুবদল ও ছাত্রদল।

ক্ষমতার উত্তাপে বাড়ে স্বজনপ্রীতি ও বাড়ে স্বজনের সংখ্যাও। আ স ম আব্দুর রব যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন নাকি ১৪ জন তার সন্তান পরিচয়ে যুক্তরাজ্য সফরে গিয়েছিল। এ নিয়ে হিথ্রো বিমানবন্দরে নাকি ঝামেলাও হয়েছিল। এই ১৪ জন কি কেবলই ক্ষমতার স্বজন ছিলনা? ক্ষমতাধররা নিজেদের ক্ষমতাপ্রদর্শন করতে লিপ্ত হয় বিবেকবর্জিত কর্মকাণ্ডে। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও যশোর-২ (চৌগাছা-ঝিকরগাছা) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মনিরের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে যশোরের চৌগাছা উপজেলার এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখা যায়।

এতে এমপি মনির ও আওয়ামী লীগের নেতারা একটি কক্ষে বসে আছেন। সেখানে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও আছেন। এরই মধ্যে একদল ছাত্রী ফুলের মালা হাতে অতিথিদের সামনে দাঁড়িয়ে ধন, ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা…’ গান গাইছে, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফুল হাতে মাথা নত করে ছাত্রীরা অতিথিদের সামনে উঠছে আর বসছে। পাশ থেকে এক শিক্ষককে ছাত্রীদের এমন কিছু করার বিষয় শিখিয়েও দিতে দেখা যায়। তবে ছাত্রীদের সবার মুখ মলিন দেখা যায়। ভিডিওতেই স্পষ্ট, জোর করে তাদের দিয়ে এই কাজ করানো হচ্ছে। সম্মান জানানো দোষের কিছু না। কিন্তু, অতিথির সামনে দাঁড় করিয়ে, কোমলমতী ছাত্রীদের এভাবে ওঠবস করানোকে ভালোভাবে নেননি এলাকাবাসী।শিক্ষকরাও সাংসদের ঘনিষ্টজন হতে ছাত্রীদের দিয়ে এমন করাল৷

সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা শিরোনাম করেছে, পৃথিবীতে আইন অমান্যে শীর্ষে বাংলাদেশ৷ /অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছেন, ‘পৃথিবীতে আইন অমান্যকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে৷ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘ই-সোসাইটি শিখন কার্যক্রম ও নিরাপদ সড়ক সচেতনতা’ কোর্সের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমাদের দেশে আইন আছে কিন্তু আইন মানার প্রবণতা নেই। এখানে যারা আইন প্রয়োগ করবেন তাদের মধ্যেও দেখা যায় আইন অমান্য করার প্রবণতা কাজ করে। এ ছাড়া বড় রাজনৈতিক নেতা-আমলারাও আইন মানতে অনীহা প্রকাশ করেন। অনেক সময় দেখা যায় সঠিক লেনে গাড়ি না চালিয়ে উল্টো লেনে ভিআইপিরা চলছেন। এতে ট্রাফিক পুলিশেরও সায় রয়েছে।’ ক্ষমতাধররা স্বজন সিন্ডিকেট ও প্রশাসনকে বশীভূত করেই এসব আইন অমান্যের অপকর্ম করে যাচ্ছে। ক্ষমতা বদলের সাথে সাথে আইনশৃংখলা বাহিনীর লাঠিও ঘুরে যায়৷ মুখ্যমন্ত্রী ছবিটির শেষ দৃশ্য দিযেই লেখাটি শেষ করছি৷ যে পুলিশ এমএলএ বিভাসের কথায় ওঠবস করত ও তার নির্দেশে যাকে তাকে ধরে লকআপে পুরতো। সেই পুলিশ যখন বুঝে গেল বিভাস নির্বাচনে হেরে যাচ্ছে আর মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাচ্ছে হেডমাষ্টার। তখন পুলিশ বিভাসকেই লক আপে পুরলো৷ তখন স্বজনদের কাউকেই বিভাসের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেলনা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)