চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মধ্যপ্রাচ্যে যৌন নির্যাতন: নারী গৃহশ্রমিকের সম্মানের বিনিময়ে রেমিটেন্স নয়

ঠিক বুঝতে পারছিনা বাংলাদেশ সরকার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী শ্রমিক বিশেষ করে নারী গৃহশ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি কেন গুরুত্বের সাথে ভাবছে না? কেন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না নারী গৃহ শ্রমিকদের হয়রানি ঠেকানোর জন্য? বাংলাদেশী নারীরা বারবার যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে নিপীড়িত হওয়ার পরও তাদের বাঁচানোর জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে কেন কোন প্রতিকার চাওয়া হচ্ছে না?

এতো অভিযোগ, এত অত্যাচার, এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে খবর হয়ে আসছে কিন্তু সরকার নির্বিকার। যে এজেন্সিগুলো মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে মেয়েদের নোংরা কতগুলো মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না কেন? মানুষগুলো দরিদ্র ও অসহায় বলে? নাকি এদের হয়রানির মাধ্যমে পুরুষ শ্রমিকদের অভিবাসনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে? যতবার নারী গৃহশ্রমিকদের হয়রানির খবর দেখছি, ততোবার এই প্রশ্নগুলো আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

বাংলাদেশ সৌদি আরবে তাদের শ্রমবাজার হারাতে চায় না অথবা বলা যায় যেকোন মূল্যে তা ধরে রাখতে চায়। ২০১৫ সাল থেকে সৌদি আরবের সাথে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর চুক্তি হয়েছে এবং এর পর থেকে প্রায় দেড়লাখ নারী গৃহকর্মী পাঠানো হয়েছে। সৌদি সরকারের সাথে যে চুক্তি হয়েছে তাতে নারী গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও আইনী বিষয়গুলোতে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি।

নারী গৃহশ্রমিক পাঠানোর পাশাপাশি সরকার সুযোগ পেয়েছে পুরুষ শ্রমিক পাঠানোর। একজন নারী গৃহশ্রমিকের সাথে দু’জন পুরুষ শ্রমিক যেতে পারে। প্রথমে এসব দেখভালের দায়িত্ব, মানে নারী গৃহকর্মীকে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দিয়ে যথাযথভাবে পাঠানোর দায়িত্ব সরকার নিলেও, পরবর্তীতে এই পাঠানোর দায়িত্ব বিভিন্ন এজেন্সির হাতে চলে যায়। তারাও লোক পাঠানোর সুযোগ পেয়ে ভাল-মন্দ কোনকিছু না ভেবে মেয়েদের সৌদি আরবে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ নারী গৃহকর্মী সৌদি আরব গেছেন। পত্রিকায় দেখলাম সৌদি আরবে আমাদের দূতাবাসও স্বীকার করেছে যে নারী গৃহকর্মীরা ভাল নেই। তাদের উপর চলছে যৌন নিপীড়ণসহ নানাধরণের অত্যাচার। সৌদিরা এতটাই বর্বর ও অত্যাচারি যে ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। আর আমরা যেকোন মূল্যে সেই বাজারে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। মেয়েদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের চাইনা। সবচেয়ে দু:খজনক ব্যাপার হল নারী গৃহকর্মী, যারা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে আসে, তারা কিন্তু একটি টাকাও সাথে আনতে পারেনা। শুধু কষ্টটাই সাথে করে নিয়ে আসে।

তবে এটাও ঠিক যে সব নিয়োগকর্তা এক নয়। কেউ কেউ খুব ভাল আছে। সেদিন কুমিল্লায় একজন নারী অভিবাসী গৃহকর্মীর সাথে কথা হল। সে বলল, তার মালিক খুব ভাল। সে ছুটি নিয়ে এসেছে এবং আবার ঐ মালিকের বাসাতেই ফিরে যাবে। অনেকের অভিজ্ঞতাই ভাল। তবে আমরাতো একজন নারীর অপমানও মেনে নিতে পারিনা। ১০০ জন ভাল থাকলেও ৫ জন খারাপ আছে। এটা কি মেনে নেয়া উচিৎ? কাজেই এদের মঙ্গলের জন্য সরকারকে ব্যবস্থা নিতেই হবে।

এইতো কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম রিয়াদে বাংলাদেশ এ্যাম্বেসিতে নির্যাতিত ৩২৯ জন নারী আশ্রয় নিয়েছিল দেশে ফেরার অপেক্ষায়। এর আগে ৫০০ জন ফিরে এসেছে দেশে। এদের সবার অভিজ্ঞতা খুবই ভয়ংকর। জেদ্দার বাংলাদেশী কনস্যুলে দেশে ফেরার অপেক্ষায় ছিল আরো ৭৪ জন বাংলাদেশী নারী ।

এদের অনেককেই মিথ্যে চাকরির কথা বলে নিয়ে আসা হয়েছে। অর্থাৎ এক চাকরির কথা বলে অন্য কাজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসের আশ্রয় ক্যাম্পে গাদাগাদি করে অপেক্ষা করতে করতে এই মেয়েদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেকেই সৌদি গৃহে অবস্থানকালীন সময়ের যৌন নির্যাতনের ফলে ট্রমাটাইজড হয়ে ছিল ।

সৌদি আরবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মত একটি বিতর্কিত স্পনসরশীপ প্রোগ্রাম চালু আছে। যাকে বলে ’ কাফালা পদ্ধতি’। এই পদ্ধতিটি তৈরি হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদী মনোভাবের উপর ভিত্তি করে। এই কাফালা পদ্ধতির কারণে অভিবাসী শ্রমিকরা হয়ে যায় চাকুরিদাতা বা মালিকের সম্পত্তি। যখনই একজন অভিবাসী শ্রমিক চাকরি নিয়ে এমন কোন দেশে প্রবেশ করে, যেখানে কাফালা পদ্ধতি চালু আছে, তখনই সে হয়ে যায় নিয়োগকর্তার সম্পত্তি। মালিক তাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেয় এবং তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। এই অবস্থার মধ্যে পড়ে অভিবাসী শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার বলতে আর কিছু থাকেনা। সবধরণের বিচার পাওয়ার সুযোগও কমে যায় ।

সরকারের উচিৎ খুব দ্রুত সৌদি সরকারের সাথে নারী গৃহকর্মীদের সুরক্ষা বিষয়ে আলোচনায় বসা । তাদের জানানো যে সেদেশের নাগরিকরা গৃহকর্মীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে। আমাদের দেশের মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে, ভাবতে হবে আমরা সেই দেশে নারী গৃহশ্রমিক পাঠাবো কিনা?

নারী গৃহকর্মীদের জন্য এর চেয়ে অনেক ভাল ও সভ্য শ্রমবাজার হতে পারে হংকং ও সিঙ্গাপুর এবং অষ্ট্রেলিয়া ও ইউরোপ। আমাদের উচিৎ হংকং বাজারকে চাঙ্গা করা। সিঙ্গাপুরের হারানো বাজার উদ্ধার করা। অষ্ট্রেলিয়াতে গৃহশ্রমিকের চাহিদা আছে। তবে এজন্য কিছু শর্ত পূরণের ব্যাপার আছে বাংলাদেশের জন্য। আর অন্যান্য কয়েকটি দেশ ইউরোপে গৃহশ্রমিক পাঠায়। তাহলে আমরা কেন এই বাজার অনুসন্ধান করছি না? ঐসব দেশে আইনের শাসন আছে, নারীবান্ধব পরিবেশ ও আইন আছে।

আমরা আশা করবো সরকার সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর সময় সবচেয়ে আগে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আমরাও চাই আমাদের মেয়েরা কাজ নিয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ুক। রেমিটেন্স আয়ে পুরুষের পাশাপাশি তাদেরও ভূমিকা থাকুক। কিন্তু এর বিনিময়ে কোনভাবেই নারীর অমর্যাদা আমাদের কাম্য নয়। নারী যেখানেই, যেদেশেই কাজ করুক, তাকে অবশ্যই নিরাপত্তা দিতে হবে। সৌদি সরকারের সাথে এই কথা স্পষ্ট করে বলে নিতে হবে, আমাদের দেশের মেয়েরা সেখানে কাজ করতে যায়, যৌনবৃত্তি করতে নয়। কাজেই তাদের দেশের নিয়োগকর্তাকে এই কথা জানাতে হবে যে তাদের অধীনস্থ কর্মী তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। তাদের প্রতি কোন অসদাচারণ আর নয়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)