শিক্ষাখাত পুরোপুরি ভ্যাটমুক্ত হয়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার হলেও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার্থীদের জন্য ভ্যাট অব্যাহত আছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ইংলিশ মিডিয়ামের মতো বেসরকারি উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট আরোপ করার কথা বলে তা তুলে নিলেও ইংলিশ মিডিয়ামে সেই ভ্যাট রেখে দেওয়া এবং শিক্ষার অন্য কোনো ক্ষেত্রে ভ্যাট না থাকাকে এক দেশে দুই নীতি বলা হচ্ছে।
ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর থেকে ভ্যাটের বোঝা সরানোর দাবিতে শিক্ষার্থীরা ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ বলে আন্দোলন করেছে। তাদের দাবি ছিলো শিক্ষার সবক্ষেত্র থেকেই ভ্যাট প্রত্যাহার। আন্দোলনের মুখে তাদেরটা প্রত্যাহার হলেও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট রয়েই গেছে।
অর্থাৎ শিক্ষা পুরোপুরি ভ্যাটমুক্ত হয়নি উল্লেখ করে তারা বলেন, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ভ্যাট প্রযোজ্য থাকলেও বাংলা মিডিয়াম বা ইংরেজি ভার্সনে কোনো ভ্যাট দিতে হয় না। একই দেশে এমন দুই নীতি অন্যায়।
তবে স্কুলভিত্তিক আন্দোলন করে কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ভ্যাট প্রত্যাহার করাতে পেরেছেন। সেই ভ্যাট স্কুল কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে।
ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া দুই সন্তানের অভিভাবক কাওসার পারভীন বলেন, সন্তানের পড়ার ফির সঙ্গে করের বাড়তি টাকা দিতেই হতো। পরে আমরা অভিভাবকরা মিলে বছর ৩-৪ বছর আগে আন্দোলন করি। অবশেষে আমার সন্তানদের স্কুল মেনে নেয়।
‘কিন্তু অন্যান্য স্কুলগুলোতে এখনো ভ্যাটের টাকা অভিভাবকদেরই দিতে হচ্ছে। টিউশন ফি’ই অনেক, তার সঙ্গে বাড়তি ভ্যাট দিতে হলে অভিভাবকদের ওপর কতোটা চাপ তৈরি হয় সেটা আমরা ভালোমতোই জানি,’ বলে মন্তব্য করেন কাওসান পারভীন।
শিক্ষা মৌলিক অধিকার বলে সেটা সবসময় ভ্যাট-করমুক্ত হওয়া উচিত বলে অভিভাবকরা মনে করেন।
এরকমই বলছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা আতাউর রহমান। সন্তানকে তিনিও ভর্তি করেছেন ইংলিশ মিডিয়ামে। বলেন, বাংলা মাধ্যমে না পড়িয়ে সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছি একটু ভালো জীবনের আশায়। আর আধুনিক যুগে ইংরেজি শিক্ষারতো কোনো বিকল্প নেই।
‘কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামের উপর ভ্যাট বসানো একধরণের বৈষম্যমূলক আচরণ। রাষ্ট্রের সবাইকে শিক্ষার সমান সুযোগ দেওয়া উচিত।’
একমত পোষণ করলেন শিক্ষক ও সাংবাদিক আনিস আলমগীর। বললেন, একই দেশে দুই রকমের নীতি চলাটাও তো মেনে নেওয়া যায় না। বিদেশী পাঠ্যক্রমে যে শিক্ষা সেখানে বাড়তি ভ্যাট প্রদান করতে হবে, কিন্তু বাংলা মাধ্যমে ভ্যাট প্রদান করতে হবে না। আমি করদাতা হয়ে আবারও সন্তানের জন্য আমাকে বাড়তি কর প্রদান করতে হবে।
দেশকে ডিজিটাল করার পথে এটি একটি বড় বাধা হিসেবেই মনে করছেন এই সাংবাদিক। বলেন, দেশকে যদি আমরা ডিজিটাল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যদি দেশকে উন্নত আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই তাহলে প্রথমতঃ আমাদের ইংরেজি ও গণিতে নজর দিতে হবে। উন্নত শিক্ষা দিতে হবে, এবং সেটা নিশ্চিত করার জন্য ভালো শিক্ষক দিতে হবে।
আনিস আলমগীর সরকারকে অনুরোধ করেন, শিক্ষাকে পণ্য না করে, বরং শিক্ষিত মানুষকে পণ্য করুন। তাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিন। এই ১৬ কোটির মানববোঝাকে মানবসম্পদে পরিণত করতে হলে ইংরেজিতে বাড়তি নজর দিতেই হবে।
ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষকরাও বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহারের পক্ষপাতি। কথা বলছিলেন মেরি কুরি স্কুলের প্রিন্সিপাল সাকেবা আলী। তিনি বলেন, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এসব শিশুরাই বড় হয়ে দেশের বাইরে গিয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করে। তাদের কেনো আমরা শুধু শুধু শাস্তি দেবো!। শিক্ষা যে মাধ্যমেই হোক, শিক্ষা তো শিক্ষাই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (ভ্যাট) জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ইংলিশ মিডিয়ামের উপর ভ্যাট আগে থেকেই অাছে। আপাততঃ আমাদের এ নিয়ে অন্য কোনো ভাবনা নেই।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল-কলেজ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সাড়ে চার শতাংশ হারে ভ্যাট প্রস্তাব করেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নামলে সরকার তাদের ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজের ওপর তা শুধু অব্যাহত রাখা নয়, সাড়ে চার শতাংশ থেকে বাড়িয়ে গত বছর সেটা সাড়ে সাত শতাংশ করা হয়।
এ বছর আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের ভ্যাট ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করলেও পরে তা সাড়ে সাত শতাংশ করা হয়। আবারো আন্দোলনের মুখে প্রত্যাহার করা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট।