দেশে ভ্যাকসিন আসার পর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের ভ্যাকসিন গ্রহণ বিষয়ক একটা আলোচনা শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে জনগণকে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে তাদেরকে ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এখানে ‘উচিত’ শব্দটাই উচ্চারিত হচ্ছে জোর দিয়ে। এই ‘উচিত’ শব্দটা বাধ্যতামূলক অর্থের নির্দেশক এখানে। উদ্বুদ্ধ করতে ভ্যাকসিন তাদের কেউ নিতে পারেন কিন্তু অবশ্য-কর্তব্য নির্দেশক যে দাবি এখানে ওঠানোর চেষ্টা হচ্ছে সেটা মূলত অকার্যকর বিষয়ক অপপ্রচারকে উসকে দিচ্ছে। এখানে এই দাবি সরল বিশ্বাসে তোলা হয়নি, তোলা হচ্ছে রাজনৈতিক অভিলাষে।
ভ্যাকসিনের এই পর্যায়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। তবে এই হার উদ্বেগের পর্যায়ে যায়নি বলে দেশে-দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ ও প্রদান বন্ধ হওয়ার মত অবস্থায় নেই। ফলে এটা যে অনিরাপদ কিছু নয় সেটা প্রায় প্রমাণিত, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আরও পরে, এবং সেটা দেবেন বিশেষজ্ঞরাই। এমন পর্যায়ে এসে বিশেষজ্ঞ নন তাদের সিদ্ধান্তসম মন্তব্যগুলো আদতে পুরো প্রক্রিয়াকেই অযথা প্রশ্নের মুখে ফেলছে। ভ্যাকসিনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে দুরভিসন্ধি সেটা জনস্বাস্থ্য-জনস্বার্থ পরিপন্থী। এখানে যাদের বহুল অংশগ্রহণ তাদের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকায়িত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক’দিন আগেও বিএনপি ভ্যাকসিনের তালিকায় সাধারণ জনগণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছিল। ভ্যাকসিন আসার পর তাদের দাবি ভিআইপিদের আগে দিয়ে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে। তাদের অভিযোগ জনগণকে ‘গিনিপিগ’ বানানো হচ্ছে। গিনিপিগ বিষয়ক এমন মন্তব্য বিএনপি করেছে মূলত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটা বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যেখানে মন্ত্রী বলেছেন প্রথম পর্যায়ে ভিআইপিরা ভ্যাকসিন পাবেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য অবশ্য সরকারের অগ্রাধিকার তালিকাকে উপলক্ষ করে, তবে ভাবমূর্তি সঙ্কটে থাকা একজন মন্ত্রীর যেকোনো বক্তব্যই যেখানে অনাস্থা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করে তখন এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও দাঁড়িয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিএনপি মূলত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যক্তি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কারও প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য বিরোধ নেই। তার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানা বিতর্কিত ভূমিকাই তাকে এমন পর্যায়ে উপনীত করেছে। দেশে যখন ডেঙ্গু এসেছিল তখন তিনি মালয়েশিয়ায় চলে গিয়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেই সফরের মাঝপথে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তার সেই ভূমিকার পরেও দায়িত্বচ্যুত হননি তিনি বরং এরচেয়েও বড় দুর্যোগে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়েছে। ‘করোনা এমনিতেই চলে যাবে’, ‘দেশের জন্যে ভ্যাকসিন লাগবে কি না জানি না’-সহ এমন নানা মন্তব্য তিনি করে গেছেন শুরু থেকেই। তিনি মন্ত্রী তবু বিভিন্ন সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাকে ‘কিছু জানানো হয় না’ এমনও অভিযোগ করেছেন তিনি প্রকাশ্যে। তার বিতর্কিত নানা মন্তব্য আদতে করোনা মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগগুলো মানুষের কাছে পৌঁছায়নি।
এই যেমন ভ্যাকসিন আসার পর এনিয়ে হুট করে গজিয়ে ওঠা অবিশ্বাসের যে ডালপালা মেলছে সেখানে তার সরাসরি ভূমিকা না থাকলেও তিনিও যে এর সঙ্গে জড়িত সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ মানুষকে আস্থা জোগানোর মত অবস্থায় তিনি নেই। তার বক্তব্যগুলো সন্দেহ বাতিকগ্রস্তদের আরও বেশি সন্দেহের অনুষঙ্গ যোগায়। হারিয়ে ফেলা ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার তার পক্ষে সম্ভব হয়নি, এটাও অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে অবিশ্বাসের ডালপালা বিস্তারে, গুজবে বিভ্রান্তির পরিবেশে। এ থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজার দরকার ছিল, কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে দেশের চরম দুর্দিনেও তার ওপর আস্থা রেখে চলেছেন সরকারপ্রধান।
করোনার ভ্যাকসিন দেশে নিয়ে আসার মত সরকারের এতবড় এক অর্জনেরও ফল ঘরে তুলতে পারছে না আওয়ামী লীগ। হ্যাঁ, ভ্যাকসিন নিয়ে আসা সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, কিন্তু দল হিসেবে এটাকে আওয়ামী লীগ নিজেদের সাফল্য হিসেবে প্রচার করতে পারছে না। এখানে সরকারের কিছু দায়িত্বশীলের ভাবমূর্তি সঙ্কটজনিত সমস্যা যেমন আছে তেমনই আছে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুরবস্থাও। ফলে বিএনপির নেতারা একবার সাধারণ মানুষেরা ভ্যাকসিন পাবে না বলে অভিযোগের পর আরেকবার ভিআইপিদের দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিলেও সেটার উচিত জবাব দিতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা রুহুল কবীর রিজভিদের বক্তব্যগুলোতে যেখানে গুজব আর অবিশ্বাসের ডালপালা বিস্তারে ভূমিকা রাখছে সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী যে ভাষায় উত্তর দিচ্ছেন সেগুলো পরিস্থিতিকে অনুকূলে নিয়ে আসার চাইতে প্রতিকূলেই ঠেলে দিচ্ছে।
ভ্যাকসিন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকেই প্রথমে নেওয়া উচিত- বিএনপির এমন বক্তব্য জনপ্রিয় ধারার বক্তব্য। এই বক্তব্যগুলো হালে পানি পাচ্ছে মূলত দেশের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা অবিশ্বাসের কারণেই। অথচ ভ্যাকসিন গ্রহণ কারও জন্যেই এখনও বাধ্যতামূলক বিষয় নয়; এটা যেমন জনসাধারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ঠিক তেমনই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও। এই বক্তব্যগুলো যেভাবে গণহারে দেওয়া হচ্ছে তাতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে যাতে করে তারা নিজেরা ভ্যাকসিন গ্রহণ না করলে অবিশ্বাস কাটবে না। অথচ এমন পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত নয়। এটা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপরই থাকা উচিত!
আমাদের আগে উপমহাদেশের ভারতে গণভ্যাকসিনেশন শুরু হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতিও আশানুরূপ নয়। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে ভ্যাকসিন গ্রহণে সেখানকার মানুষের অনাগ্রহ প্রবল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন বলে প্রচার চালাতে হচ্ছে। তিনি শুরুতে কেন ভ্যাকসিন নিলেন না- এ নিয়েও সমালোচনা চলছে। আশঙ্কা আমাদের দেশেও না এমন পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়! যদি হয়ে যায় তবে সুখবর নয় নিঃসন্দেহে।
বিশ্বের দেশে-দেশে সরকারপ্রধান ও প্রভাবশালীরা ভ্যাকসিন গ্রহণ করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৭৮ বছর বয়েসি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস-চেয়ারম্যান কমালা হ্যারিস নিয়েছেন ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন। বাইডেনই কেবল নন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ভ্যাকসিন নিয়েছেন ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ এবং ডিউক অব অ্যাডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপ। বাইডেন, রানি এলিজাবেথের বাইরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু, পোপ ফ্রান্সিসও নিয়েছেন করোনার ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন নিয়েছেন সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ। ভ্যাকসিন নিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস বিশ্ববাসীকে ভ্যাকসিন গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে এটাকে নৈতিক দায়িত্ব বলেও মন্তব্য করে জনগণকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছেন।
দেশে করোনার ভ্যাকসিন আসার দিন গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল সরকারের আমদানি করা এই ভ্যাকসিন নেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তার এই আগ্রহ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তার এই আগ্রহ জনগণকে ভ্যাকসিন গ্রহণে উৎসাহ জোগাবে। এর বাইরে আরও কোন মন্ত্রী কিংবা এমপির আগ্রহের তথ্য চোখে পড়েনি। বলছি না তাদেরকে নিতেই হবে, কিন্তু তারা অর্থমন্ত্রীর মত এমন ঘোষণা দিলে এর প্রভাব প্রান্তিক পর্যায়েও পড়ত ব্যাপকভাবে। তবে এও বলি ভ্যাকসিন গ্রহণ যখন মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয় তখন কাউকে বাধ্য করার মত অবস্থার সৃষ্টি করে ঘোষণা আদায় সঠিক কাজ নয়। এটা ব্যক্তিপর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত, এটাকে বাধ্য করার মত অবস্থায় ঠেলে দেওয়া অনুচিত এবং ব্যক্তি স্বাধীনতায় অযাচিত হস্তক্ষেপ, একই সঙ্গে ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং’।
মন্ত্রী, এমপি, আমলা, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণসহ সমাজ ও দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে সেটা মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে ঠিক কিন্তু অনুপ্রেরণার জন্যে তাদেরকে সেটা গ্রহণে বাধ্য করার মত পরিবেশের তৈরি করা ঠিক হবে না। উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির আড়ালে যে কারও ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তি সিদ্ধান্তের ওপর অপ্রত্যক্ষ হলেও চাপ প্রয়োগের অবস্থা যাতে না হয় সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি রাখা উচিত।
চিকিৎসা মৌলিক অধিকার। ভ্যাকসিন দেশে এনে মৌলিক এই অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা দিচ্ছে সরকার। নাগরিক হিসেবে আপনি চাইলে সে অধিকার গ্রহণ করতে পারেন, আবার না চাইলে সেটা অগ্রাহ্য করতেও পারেন। তবে আপনার অধিকার গ্রহণের বিষয়টি অন্যকে গ্রহণে বাধ্য করার মত শর্তসাপেক্ষ হয়ে পড়লে সেটা হবে অবিবেচনাপ্রসূত ও গণবিরোধী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)