চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ভোটের রাজনীতির হিসাব মেলাতে ভাস্কর্য অপসারণ

সুন্দরের প্রতি অসুন্দরের ক্ষোভ যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। হালাকু খানের বাগদাদ লাইব্রেরির ধ্বংসযজ্ঞ, আফগানিস্তানে তালেবানদের বামিয়ানের মূর্তি উড়িয়ে দেয়া, সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের বিভিন্ন শিল্পকর্ম-মঠ মন্দিরের ধ্বংসলীলা একইসূত্রে গাঁথা।

আর এখানে খড়গ বয়ে নিয়ে এসেছে হেফাজত। ইতিহাস শুধুই ফিরে ফিরে আসে। ধর্মীয় অনুভূতির জুজু তুলে সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাষ্কর্যটি নিয়ে সারা দেশে উন্মত্ততা ছড়িয়ে দিয়েছিল তারা। আর তাদেরকে খুশি রাখতে সেকুলার রাজনীতির ধ্বজাধারী আওয়ামী লীগ সরকার এক প্রকার নতজানু হয়েই রাতের অন্ধকারে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে লেডি জাস্টিসিয়ার ভাষ্কর্য। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হয়নি হেফাজত। এবার দেশের সকল ভাষ্কর্য অপসারণ করার দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

এমনটাই যে হতে যাচ্ছে, তা আগেই আশঙ্কা করেছিলেন অনেকে। শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে এক সমাবেশে হেফাজতের ঢাকা মহানগরের সহসভাপতি মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, ‘বাংলার মাটিতে আর কোনও মূর্তি স্থাপন করা যাবে না। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে তৌহিদী জনতা দাঁতভাঙা জবাব দেবে।’

তার মানে এবার অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাষ্কর্য, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষ্কর্য, জননী ও বর্ণমালাসহ মুক্তিসংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত সকল ভাষ্কর্যই হারিয়ে যাবে লাল সবুজের বাংলাদেশের বুক থেকে। এদেশ পরিচিত হয়ে উঠবে মূর্খদের দেশ হিসেবে। কারণ একমাত্র মূর্খরাই ভাষ্কর্য আর মূর্তিপূজার মধ্যে পার্থক্যটা অনুধাবন করতে পারে না। আর পারে না বলেই শিল্প, সাহিত্য, ভাষ্কর্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা সবকিছুই তাদের কাছে বর্জনীয়।

এদের চোখে ভাষ্কর্য হারাম, সঙ্গীত হারাম, সিনেমা হারাম। হারাম জগতের যাবতীয় সুন্দর সুকোমল বৃত্তি। ২০১৭ সালে এসে সারা পৃথিবীর মানুষ যখন জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের লক্ষ্যে দিবানিশি সাধনা করে চলেছে, তখন এরা আঁকড়ে ধরতে চায় পশ্চাৎপদতাকে।

কচু কাটতে কাটতেই ডাকাতে পরিণত হওয়া যায়। শুধুমাত্র জাস্টিসিয়াকে নিয়ে যে দাবি দাওয়া শেষ হবে না, সেটা বুঝতে শার্লক হোমস হতে হয় না। আর তাই ব্লগে, ফেসবুকে অসংখ্যবার সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন প্রগতিশীল এক্টিভিস্টরা। কিন্তু সুকুমার রায়ের “চক্ষু কর্ণবিহীন সর্প” এর মতে সেই আকুলতা দাগ কাটতে পারেনি কর্তৃপক্ষের মনে। তাই ভোটের রাজনীতির জয়পরাজয়ের হিসাব মেলাতে রাতের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলা হলো জাস্টিসিয়া। অন্ধকারের কাছে হলো আলোর পরাজয়।

মৌলবাদের হুংকারের কাছে মাথা নত করে শুরু হয়েছে পেছন পথে যাত্রা। আর আজ সব ভাষ্কর্য সরিয়ে ফেলার দাবি জানিয়ে হেফাজত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। কারণ ধর্মের দোহাই দিয়েও পাকিস্তান রক্ষা করতে না পারার মর্মজ্বালা তারা ভুলতে পারেনি কখনোই। শুধু ছিলো সুযোগের অপেক্ষায়। তাদের মূল টার্গেট অপরাজেয় বাংলা। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত এই ভাষ্কর্যটি স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের ন্যাক্কারজনক পরাজয়ের ইতিহাস। আর তাই সব ‘মূর্তি’ সরিয়ে ফেলার আহ্বান ভেসে এসেছে তাদের শিবির থেকে।

এখনো যারা প্রতিবাদ না করে নিরপেক্ষতার ভূমিকা বজায় রেখেছেন তাদের উদ্দেশে কবি আহসান হাবীবের ভাষায় বলতে হয়:

“তোমার আমার দিন ফুরায়েছে যুগটাই নাকি বৈপ্লবিক,
গানের পাখিরা নাম সই করে
নীচে লিখে দেয় রাজনীতিক
থাকতে কি চাও নির্বিরোধ?
রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ।
নীড় প্রলোভন নিরাপদ নয় বোমারু বিমান আকস্মিক
আরব্ধ গান এইখানে শেষ আজকে আহত সুরের পিক।”

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)