একশ কোটি লোক, বিশাল আয়তন এবং বিশ্বশক্তি হতে যাওয়া ভারত যখন তার দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়ার ঘোষণা দেয়, যখন পরাক্রমশালী চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিপীড়ক মিয়ানমার সরকারের পাশে দাঁড়ায় এবং যখন ইসরায়েল অস্ত্র দিয়ে মিয়ানমারকে সহায়তা করে; তখন বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ।
রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর গণহত্যার শিকার হয়ে কোনো মতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের অনেককে ফিরিয়ে দিলেও লাখো রোহিঙ্গাকে এরইমধ্যে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ নিজেই নানাবিধ অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তারপরও মানবিকতার প্রশ্নে বাংলাদেশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে, সেটি এশিয়ায় তো বটেই, সারা বিশ্বেই বিরল।
জাতিসংঘের হিসাবে, সাম্প্রতিক সহিংসতায় সোয়া লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে। আগে থেকে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বইছে বাংলাদেশ। এবার আসা নতুন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আছে। ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা কুতুপালং ও নয়াপাড়ায় নিবন্ধিত দুই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যরা বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। অগণিত রোহিঙ্গা এখন সীমান্তে আটকে পড়ে আছে। নতুন করে পালিয়ে আসাদের থাকার ব্যবস্থা করতে টেকনাফে নতুন ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে।
নতুন আশ্রয়কেন্দ্র করতে পাহাড়ী এলাকায় ৫০ একর জায়গা বরাদ্দ চেয়েছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন। পালিয়ে আসাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ও অন্যান্য আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা। আবার আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি উদ্যোগে খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমাদের এক সহকর্মী বললেন, আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য চাঁদা তুলে কিছু জামা-কাপড় পাঠানো যায় কি না। এই যে মানবিকতা, মানুষের জন্য ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ অনুভব করা– এখানে জাত-ধর্মের কোনো বিচার নেই। অথচ রোহিঙ্গাদের এই সংকটের দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশের নয়।
বাংলাদেশের মানুষ এমনই। অন্যের দুঃখে কাতর হয়। কেউ আশ্রয় চাইলে তাকে ফিরিয়ে দেয় না। নিজে বিপদে থাকলেও অতিথিকে সমাদর করতে চায়। ২০০৭ সালের নভেম্বরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর কাভার করতে গিয়ে দেখেছি, উপকূলের ঘরহারা মানুষ নিজেরাই যেখানে দুপুরে কী খাবে তা জানে না, সাংবাদিক দেখে গাছ থেকে ডাব পেড়ে খাওয়ানোর ব্যস্ততা।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে মানবিক সংকটের আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। কেননা তাদের আশ্রয় দেয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই শরণার্থী শিবিরগুলোতে। জাতিসংঘের বাংলাদেশের সমন্বয়ক এক রিপোর্টে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার জন্য হেঁটে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন। এখন তারা খাদ্য, পানি এবং বাসস্থানের অভাবে দিন কাটাচ্ছেন।
বাংলাদেশ যখন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দিচ্ছে, তখন রাখাইনে জাতিসংঘের সব দাতব্য সংস্থার খাদ্য,পানি ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। শুধু জাতিসংঘই নয়, অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলো অভিযোগ করেছে, মিয়ানমার সংঘাতপূর্ণ এলাকায় তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশহীন জাতির এই সংকটকালে এশিয়া তো বটেই, পুরো বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারতের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তারা ভারতে বসবাসরত প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে দেশ ত্যাগ করতে হবে বলে জানিয়েছে। এমনকি এদের মধ্যে যারা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তালিকাভুক্ত তারাও ভারতে থাকতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার এই ঘোষণার কিছুদিন পরই মিয়ানমার সফরে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বোঝাই যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ভারত সহযোগিতা করছে।
ভারতের সাংবাদিক সুবির ভৌমিক মনে করেন, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরিতে উন্মুখ। কারণ, ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহী তৎপরতায় লিপ্ত যোদ্ধাদের অনেকেই মিয়ানমারের জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ফলে তাদের শায়েস্তা করতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ভারতের প্রয়োজন।’ বিপরীতে বছরের পর বছর ধরে ছোট্ট আয়তন আর সীমিত সম্পদ দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহয়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ।
সবচেয়ে বড় পরিহাস, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি যিনি শান্তিতে নোবেলজয়ী তার আমলেই রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন। ফলে তার নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেয়ারও দাবি উঠছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি নিজেকে মানুষ নয়, বরং একজন নিপীড়ক রাষ্ট্রনায়কেরই পরিচয় দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশি ড. ইউনূস সমস্যা সমাধানে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে খোলা চিঠি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, যাতে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের ওপর নির্বিচার সামরিক আক্রমণ বন্ধ হয়, যার কারণে এই অসহায় মানুষগুলোকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হতে না হয় সে ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
একটি বিপন্ন জাতির পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ যে মানবিকতা আর সহমর্মিতার উদাহরণ দিচ্ছে, সেটি কূটনীতির হিসাবে যতো ঝুকিপূর্ণই হোক না কেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ামনারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক যত অবনতি হোক না কেন, মিয়ানমারের বন্ধু হিসেবে ভারত ও চীনের সাথেও বাংলাদেশের বৈরিতা সৃষ্টির যতই আশঙ্কা থাকুক– একটি বিপদগ্রস্ত জাতির দুঃসময়ে বাংলাদেশ যে ধৈর্য্য আর সহমর্মিতার পরিচয় দিচ্ছে, সেটি কূটনীতি আর রাজনীতির খেলার বাইরে একটি অনন্য উদাহরণ যা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে বা হয়েছে প্রতিবেশী অন্য দেশগুলো।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ জানে, শরণার্থী হবার যন্ত্রণা কেমন। সেই অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বকে এই বার্তা দিচ্ছে যে, পকেটে পয়সা কম থাকলেও সে অভূক্তকে খাওয়াতে পারে, নিজের ঘর দুর্বল হলেও বিপদগ্রস্তকে সে আশ্রয় দিতে পারে। এটাই বাংলাদেশের মানুষের শক্তি। সুতরাং শান্তিতে নোবেল পাওয়ার অধিকারী কে, অং সান সুচি নাকি বাংলাদেশের মানুষ?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)