দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে দূরত্বের বিষবাষ্প জমতে শুরু করেছিলো ১৯৭৫ সালেই। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও রাজনীতির পথে হাঁটা শুরু করেনি বিএনপি। ওই বছরের ১৫ আগস্ট সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সেই নৃশংসতা এবং পরে হত্যাকারীদের রক্ষায় বিএনপির নানামুখী তৎপরতা দুই রাজনৈতিক শক্তির স্থায়ী দ্বন্দ্বের ভিত্তি দেয়।
তারও প্রায় ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা এবং সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ভূমিকা দুই দলের মধ্যে ন্যূনতম সম্পর্কের পথও চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই দুটি বিয়োগান্ত ও নির্মম ঘটনা এবং তাতে একটি শক্তির জড়িত থাকা দুই দলকে একত্রে কাজ করার ভিত্তি তৈরি হতে দেয়নি। বিশেষ করে ২১ অাগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যাচষ্টার পর তার অার কোনো সম্ভাবনাও নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক বশির আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের সেই নৃশংস ঘটনার হোতাদের সবসময় প্রমোট করেছিলেন জিয়াউর রহমান। আওয়ামী লীগ আর বিএনপির বিরোধিতার জায়গাও সেটা। আর তারপরে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা কিন্তু এক অর্থে সেই সময়ের সরকারেরই ব্যর্থতা। প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে যথাযথ নিরাপত্তা না দিতে পারাটা সরকারের ব্যর্থতা। এবং পরে সেই ঘটনার বিচারেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তৎকালীন এই রাজনৈতিক দলটি। বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এই প্রচেষ্টাই মূলত বেশি দূরত্ব তৈরি করেছে দুটি দলের মধ্যে। আর তাতেই কখনো একসঙ্গে কাজ করার মতো মনোভাবের ভিত্তিই তৈরি হতে পারেনি।’
দল দুটির সম্পর্ক নিয়ে প্রায় একই মন্তব্য করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. অরুণ কুমার গোস্বামী।
ইতিহাসের অনেকটা পথ পেরিয়ে আসার পর এই সময় কি সম্ভব দুটি দলের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হওয়া?’
তার মতে, ‘বিএনপি গঠিত হয়েছে কয়েকটি উপাদানকে ঘিরে। সেগুলো হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যা, কর্নেল তাহের হত্যা, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, যুদ্ধাপরাধীর বিচার থামিয়ে দেওয়া, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া এবং সংবিধান বহির্ভূতভাবে সেনাশাসন। সুতরাং সেই জন্ম থেকেই বিরোধ শুরু হয়েছে এই দুটি দলের মধ্যে। বিএনপির গড়ে উঠার এই সব উপাদানই দুটি দলের মধ্যে সেই কাজের সম্পর্কও কখনো গড়ে উঠতে দেয়নি।’
সেই কথাই অবশ্য আরো একবার বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ডক্টর শান্তনু মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এখন যে বিরোধী সম্পর্ক সেটার শুরু কিন্তু অনেক আগে থেকেই। ২০০৪ এর ২১ আগস্ট নয়। তারও আগে ’৭৫-এর নৃশংসতা এবং তারও আগে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দুই দলের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর পূর্বে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়েই দুই দলের মতাদর্শে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। ছোট ছোট রাজনৈতিক বিরোধের বাইরে বাংলাদেশের ইতিহাসের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাল যেভাবে দুটি দলের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে সেটা সহজে কমার নয়। সেখানে ১৫ আগস্টে খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনও আরো একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
এমন প্রশ্নের উত্তরে শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘দুটি দলের মধ্যে মৌলিক চিন্তার জায়গায় যখন এত ফারাক; তখন আগামী মাত্র দুই-তিন বছরে সেই দূরত্ব কিভাবে কমবে সেটা আমার অন্তত বোধে আসে না। মোটা দাগে যে দুটি সালকে আমরা বিশেষভাবে জানি সেই ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালের মতাদর্শ নিয়েও দুটি দলের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। আর বর্তমানে এই দুটি দলের সম্পর্ক আরো বেশি টক্সিক হয়ে গেছে। তার কারণ আওয়ামী লীগের নানান সময়ে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বক্তব্য এবং আওয়ামী লীগ নিয়ে তারেকের বক্তব্য। সেই সম্পর্ক যে খুব সহজে স্বাভাবিক হবে এমনটা আশা করা যায় না।’
দু’দলের ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরিতে কোনো আশার আলো দেখছেন না মন্তব্য করে অরুণ কুমার গোস্বামী বলেন, ‘বিএনপির জন্ম হয়েছিলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈপরীত্য নিয়ে। আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করেই নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করতে চেয়েছিলো তারা। সুতরাং সেই জায়গায় আপোষ কখনোই সম্ভব না। বিএনপির গড়ে উঠার প্রেক্ষাপট এবং তারপরে তার কিছু পদক্ষেপ দুটি দলকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে আরো বেশি। একজনকে নিশ্চিহ্ন করে আরেকজন দাঁড়াতে চাইলে সমঝোতা কখনোই সম্ভব নয়।’
অবশ্য এতকিছুর পরও একজন রাজনীতি বিশ্লেষক হিসেবে মোটেও নিরাশ নন বশির আহমেদ।
রাজনীতিতেও যেকোনো সময় যেকোনো পরিবর্তন আসতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একথা ঠিক যে অনেক সময় পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে অনেকে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা শুরু করে। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে হলে আর্টিজানের ঘটনার পর অনেকেই বলেছেন এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। তেমন ২১ আগস্টের পরও সেটাকে আওয়ামী লীগেরই কাজ বলে চালিয়ে দিতে চাওয়া হয়েছিলো। সব মিলিয়ে দুই দলের মধ্যে দূরত্ব অনেকটাই সৃষ্টি হয়েছে।’
“কিন্তু এমনও তো হতে পারে কোনো এক জাতীয় ইস্যুতে পারস্পরিক বিরোধ ভুলে দুই দলই ঐক্যমত্যে এসে পৌঁছালো। সেটাই এখন সবচেয়ে বড় কাম্য। মানুষ যেমন দুই প্রধান দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখতে চায় তেমন সমঝোতাও দেখতে চায়। তাই সেটা কখনোই হবে না এমনটা অন্তত একজন রাজনীতি বিশ্লেষক হিসেবে আমি বলতে চাই না।”