মন্ত্রী-এমপিদের পিএস, এপিএস ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মত করে বাড়ি গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, হাওর নদী ও জলাশয়ের মালিক হয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তির কয়েক বছরের মধ্যেই রাতারাতি ধনিক শ্রেণিতে নিজেদের নাম লিখিয়ে নিচ্ছে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে উঠছে তারা। মন্ত্রী-এমপিদের ঘুম পাড়িয়ে অথবা জাগনা ঘুমে রেখেই তাদের এই উত্থান। নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী নেতাদেরকেও বাধ্য হয়ে এসব পিএস, এপিএস ও পি,ও’দের কাছে ধর্না দিতে হয়। হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দলকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি বানিয়ে দেয় ত্যাগীরা আর ক্ষমতার সকল স্বাদ ভোগ করে এই পিএস, এপিএস ও পিও নামের বসন্তের কোকিলরা। মন্ত্রী, এমপিদের ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠলে সেটাও আজ পুঁজি হয়ে উঠছে। প্রত্যেক মন্ত্রী-এমপিকে ঘিরেই গড়ে উঠছে এইসব ঘনিষ্ঠজনদের সিন্ডিকেট। স্থানীয় দলীয় সম্মেলনগুলোতে জিততে হলেও প্রয়োজন তাদের আশীর্বাদ ও সমর্থন। সেটাকে দৃশ্যমান করতে অনেকেই পোস্টারে লিখে থাকে, ‘অমুক’ মন্ত্রীর/এমপির ঘনিষ্ঠ জন ‘তমুক’।
কারা হয় এসব পিএস, এপিএস ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা? কোন শ্রেণির কর্মকর্তা, কর্মচারী তারা? একজন মন্ত্রীর কতজন এসব কর্মকর্তা থাকতে পারে? একজন সংসদীয় কমিটির সভাপতির কতজন এসব কর্মকর্তা থাকতে পারে? একজন এমপির কতজন এসব কর্মকর্তা থাকতে পারে? এসব নিয়োগের জন্য কি কোন বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়? এসব নিয়োগে কি সংশ্লিষ্ট দলের মতামতের কোন ভূমিকা থাকে? সারাদেশে মোট কতজন এমন কর্মকর্তা, কর্মচারী রয়েছে? এর দৃশ্যমান তত্ত্ব ও তথ্য কি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জাতীয় সংসদ বিভাগে আছে? যদি থেকে থাকে এর দায় তারা এড়াতে পারেন না।
বিভিন্ন সময়ে এই পিএস, এপিএসরা সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পিএস হারিছ চৌধুরী কিছুদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের এপিএস হায়দার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন।শিরোনাম হয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার। আর এখন শিরোনাম হচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন ও ঘনিষ্ঠজন নাসির উদ্দিন। নাসির উদ্দিন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন না হলে এত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতো না। সারাদেশ জুড়েই চলছে এসব ‘ঘনিষ্ঠজনদের সিন্ডিকেট’। বস্তা নিয়ে এপিএস ওমর ফারুক ধরা পড়ায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মন্ত্রিত্ব চলে গেল। দুর্নীতির বস্তা নিয়ে ধরা পড়লেও বহাল তবিয়তে আজ শিক্ষামন্ত্রী!
রোববার শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন ও তার ঘনিষ্ঠজন শিক্ষাবিভাগের কর্মচারী নাসির উদ্দিন গ্রেফতার হল। পরের দিন সচিবালয়ে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বললেন, অপরাধী যেই হোক তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। আমার ব্যক্তিগত সহকারী ও শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কর্মচারী নাসিরকে কেন ডিবি গ্রেফতার করেছে আমি জানি না। এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে এডমিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা যদি অপরাধী হয় পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
মন্ত্রী আরও বলেন, তিনি অতীতে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাননি। মন্ত্রীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে, যদি গ্রেফতারকৃত দুজনের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হয় তাহলে কি বিনাঅপরাধে গ্রেফতারের অভিযোগে ডিবি অভিযুক্ত হয় না? তখন ডিবি সম্পর্কে কী বলবেন মন্ত্রী? ‘যদি অপরাধী হয় ‘কথাটার’ যদি’ শব্দটা কি তাদের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা নয়?
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, কারও ব্যক্তিগত দুর্নীতির দায় নেবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর। দুর্নীতির দায়ে দুই কর্মচারী গ্রেফতার হওয়ার পর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, যারা দুর্নীতি করেছে কলঙ্কের দায় তাদেরকেই নিতে হবে। নিম্ন পদস্থ কর্মচারী হয়েও তাদের অবৈধ সম্পদের পাহাড়ে বিব্রত মন্ত্রণালয়। আটক দুজনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া সনদ সত্যায়িত করা, টাকার বিনিময়ে সরকারি কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের পদোন্নতি ও বদলির ব্যবস্থা, দূর্নীতিগ্রস্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের অনুমতি পাইয়ে দেয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁস, জিপিএ ফাইভ বিক্রি ও জঙ্গি মদতদানকারী ব্যক্তিকে স্কুল চালুর ব্যবস্থা করে দেয়ার মত গুরুতর অভিযোগ। এখন তাদের দায় কেউ নিতে চাচ্ছেনা। কিন্তু তারা যদি মন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা না হত ও বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব করতে না যেত তাহলে কি তারা দুর্নীতি করার সুযোগ পেত? অবশ্যই তাদের দায় নিতে হবে নিয়োগকর্তার।
কিন্তু এই নিয়োগকর্তা কে? কার স্বাক্ষরে তার এই নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে? নিয়োগ ও চাকুরিবিধিসহ তার বেতন ভাতার বিষয় দৃশ্যমান করতে হবে। পত্রিকায় দেখলাম শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বেতন ১৩ হাজার ৫ শত টাকা ও তিনি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। অথচ বাস্তবে কী দেখা যায় এসব তৃতীয় শ্রেণিদের কর্মচারীদের তোয়াজ করে চলে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা! মন্ত্রী-এমপিদের পিএস, এপিএস, পিওরা এলাকায় গেলে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দলীয় নেতা সকলেই তাকে তোয়াজ করতে আসে! এমনই বেহাল মানসিক অবক্ষয় চলছে গোটা দেশে!
নিয়োগ, জলমহাল, নেতৃত্ব সবই ঠিক করে দেয় এইসব ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা। তাদের বেতন-ভাতা কি মন্ত্রী-এমপির ব্যক্তিগত খাত হতে আসে নাকি সরকারের রাজস্ব খাত হতে? তাদের নিয়োগ চূড়ান্তের আগে কি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়? নাকি মন্ত্রী-এমপিদের ইচ্ছা অনুযায়ী এসব নিয়োগ হয়? মোতালেব হোসেন দুর্নীতিতে জড়িত এর কোন তত্ত্ব মন্ত্রীর কাছে নেই। যে মানুষটা সবসময় মন্ত্রীর সাথে সাথে থাকে তার খবরই মন্ত্রী রাখতে পারেন না। সারাদেশের শিক্ষাবিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের খবর কিভাবে রাখবেন? শিক্ষামন্ত্রী কি নিজ জবানিতেই নিজের অযোগ্যতাকে প্রকাশ করলেন ? নাকি তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন ? তিনিতো এখনও তাকে বরখাস্ত করেননি?
মোতালেব হোসেন গ্রেফতার হয়েছে বলেই তা আলোচিত হচ্ছে । এরকম আরও শত শত মোতালেব হোসেন রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের উচিত তাদের তালিকা নিয়ে প্রত্যেকের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো। এতে হয়তো আরও অনেক কিছু বেরুবে। অতীতে দেখেছি কেউ মুদী দোকানদার হতে এপিএস হয়েছে। কেউ হয়েছে ক্যান্টিন বয় হতে। বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তদের অতীত ও বর্তমান মিলিয়ে দেখলেই তাদের রাতারাতি বদলের চিত্র দৃশ্যমান হবে। কেউ মন্ত্রী-এমপিদের অগোচরে দুর্নীতি করছে কেউ গোচরে। গোচরে অগোচরে যেভাবেই হোক মন্ত্রী-এমপিরা এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ তাদেরকে তারাই নিয়োগ দিয়েছেন। এরা কেউ দলের দুর্দিনে পাশে ছিল না। অথচ দুর্দিনের ত্যাগী নেতারাও আজ বাধ্য হচ্ছে এদেরকে ধর্না দিয়ে চলতে। কেন? যদি বলি মন্ত্রী-এমপিরাই এদের দিয়ে এসব করাচ্ছে, তা কি অযৌক্তিক হবে ? নইলে তারা এত স্পর্ধা পায় কি করে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)