মাঠের উজ্জ্বল পারফরম্যান্স বিপণনের বাজারে কোনো ক্রিকেট দলের কদর কতোটা বাড়াতে পারে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে ‘টিম-টাইগার্সের’ দূর্দান্ত পারফরম্যান্সের জেরে দারুণ ফুরফুরে সময় পার করছে বিসিবির বিপণন বিভাগ। স্পন্সরদের টাকায় কোষাগার আরো ফুলে-ফেঁপে ওঠার স্বপ্নে বিভোর তারা।
অথচ ২০১৪’র বছর জুড়ে বাজে পারফরম্যান্সের জন্য সেসময়ের টিম-স্পন্সর সাহারা-ইন্ডিয়ার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান অ্যাম্বি-ভ্যালি বিসিবিকে স্পন্সরশিপের কিস্তি পরিশোধ করাই ছেড়ে দিয়েছিলো। বিসিবি’র সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার কথায় সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণটা এরকম: ‘হংকং-আফগানিস্তানের মতো দলের কাছে হারে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স সাহারা-ইন্ডিয়াকে এতোটাই হতাশ করেছিলো যে তারা আমাদের বলেছিলো, টাইগারদের পেছনে না ঢেলে দিল্লীর কোনো স্কুল ক্রিকেট দলের পেছনে টাকা ঢাললে প্রচার-কভারেজ তারা ভালো পেতো।’
দুঃসময় পার হয়েছে। পাওনা নিয়মিত পরিশোধ না করায় নির্ধারিত সময়ের ১৫ মাস আগে সাহারা-ইন্ডিয়ার সঙ্গে চার বছর মেয়াদি ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১১২ কোটি টাকা) টিম-স্পন্সর চুক্তি বাতিল করেছে বিসিবি। এরপর পাকিস্তানের সঙ্গে এক সিরিজের জন্যই টিম-স্পন্সরশিপ থেকে বিসিবি আয় করেছে তিন কোটি ১৬ লাখ টাকা। এখন ২০১৫’র ১ জুন থেকে ২০১৭’র ৩০ জুন পর্যন্ত দুই বছর সময়সীমায় বাংলাদেশ দলের টিম-স্পন্সরশিপ বিক্রির তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
এ দু’বছরে ‘টিম-টাইগার্স’ এশিয়া কাপ ছাড়াও হোম এন্ড অ্যাওয়ে মিলিয়ে আটটি সিরিজ খেলবে। ২০ মে অনুষ্ঠেয় টেন্ডারের জন্য ন্যুনতম ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। বিসিবির দাবি, দেশি-বিদেশি মিলিয়ে বেশক’টি নামী প্রতিষ্ঠান টাইগারদের টিম-স্পন্সরশিপ স্বত্ব পেতে এর চেয়েও বেশি দর প্রস্তাব করবে। তবে অতীতে বিসিবির এ ধরণের ব্যবসায়িক লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিজ্ঞ একজনের বিশ্লেষণ, মাঠে টাইগারদের যা পারফরম্যান্স তাতে ভিত্তিমূল্যের অংকটা আরেকটু লোভনীয় হতে পারতো।’
অর্থনীতিবিদরাও একইরকম কথা বলছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন, আগের স্পন্সরশিপ চুক্তি চার বছরের জন্য ১১২ কোটি টাকা হলে বছরে তা ২৮ কোটি। এখন দু’ বছরের জন্য ৩০ কোটি টাকা ভিত্তিমূল্য ধরলে বছর হিসাবে তা ১৫ কোটি টাকা হয়। অন্ততঃ আগে পাওয়া টাকার পরিমাণকে ভিত্তিমূল্য ধরলে সেটাই যৌক্তিক হতো।
কারণ ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, আগে যে টাকাটা পাওয়া গেছে সেটা এক ধরণের ভিত্তিমূল্য হয়ে গেছে। এখন ওপেন টেন্ডারে তার চেয়ে বেশি টাকা পাওয়ার আশা করাটাই স্বাভাবিক। তবে ভিত্তিমূল্য এখন যেটাই ধরা হোক, সেখানে যেনো সিন্ডিকেট ঢুকে না পড়ে সে বিষয়ে বিসিবিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ।
ক্রিকেট সংগঠকরাও এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। তাদের কারো কারো আশংকা, আগের টেন্ডারগুলোর মতো এবারো কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে ভিত্তিমূল্যের চেয়ে অনেক কম দর দেবে। প্রত্যাশিত দর না পেয়ে হয়তো নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করতে বাধ্য হবে বিসিবি।
তারপরও এখন পর্যন্ত বিসিবির যে আয়, টাকার অংকে তা খুব কম নয়। বিসিবি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর গত দেড় দশকে হোম সিরিজে টিভি সম্প্রচার স্বত্ব ও টিম-স্পন্সর থেকে বিসিবির আয় সাড়ে পাঁচশো কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে অংকের পরিমাণে কিছু জটিলতাও অবশ্য আছে।
২০০১ থেকে পরের পাঁচ বছর হোম সিরিজের টিভি সম্প্রচার স্বত্ব ওয়ার্ল্ডটেল এবং এর কর্ণধার মার্ক মাসকারেনহাসের কাছে বিক্রি করে বিসিবির আয় ছিলো ১১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৯৪ কোটি টাকা)। এই উপার্জনের বেশিরভাগটাই বিসিবির অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে, যদিও চুক্তির বাইরে ভারতের বিপক্ষে একটি সিরিজ আয়োজন করে তার সম্প্রচার আয়ের পুরোটা নিজেরাই নিয়ে গেছে ওয়ার্ল্ডটেল।
এরপরও ওয়ার্ল্ডটেলের সঙ্গে চুক্তিকে বিসিবি সংশ্লিষ্টরা এগিয়েই রাখছেন। কারণ বিসিবির জন্য গলার কাঁটা হয়েছে ২০০৬ থেকে পরের ছয় বছরের জন্য সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভারতীয় কোম্পানি নিম্বাসের (নিও স্পোর্টস) সঙ্গে সম্প্রচার চুক্তি। ৫৬ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪৫৫ কোটি টাকা) থেকে প্রডাকশন খরচ বাবদ ২৪ মিলিয়ন ডলার (১৯২ কোটি টাকা) যে নিম্বাস কেটে রাখবে, তা চুক্তির সময় দু’ পক্ষের কেউই প্রকাশ্যে জানায়নি। ওয়ান ইলেভেনের পর বিসিবির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠিত হলে প্রকাশ্য হয় শুভংকরের ফাঁকি।
এ নিয়ে পরে বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব নেওয়া আ. হ. ম. মুস্তফা কামাল আইনি লড়াইয়ের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফল মেলেনি। বিসিবির আক্ষেপ যে এখনও নিম্বাসের কাছে তাদের ১৪ থেকে ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা আছে।
সর্বশেষ ২০১৪ থেকে ২০২০ এপ্রিল মেয়াদে দু’ কোটি দু’ লাখ ডলার (১৬১ কোটি টাকা) মূল্যে গাজী টিভি’র কাছে টিভি সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করেছে বিসিবি। এই চুক্তির আগে দুবাইভিত্তিক একটি বহুজাতিক ফিনান্সিয়াল এসেসমেন্ট কোম্পানিকে দিয়ে সম্প্রচার স্বত্বের সম্ভাব্য মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো।
সাইদুর রহমান শামীম: স্পোর্টস ইন-চার্জ, চ্যানেল আই