আমি উননব্বই সাল থেকে কম্পিউটার ব্যাবহার করছি। প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল বই কম্পোজ করা। অ্যাপল ম্যাকিনটশে বিজয় কীবোর্ডে সুতন্বী ফন্টে বাংলা টাইপ করতাম। তখন বোধ হয় এই ফন্টের অন্য নাম ছিল। ঠিক মনে নেই। তখন শহিদলিপি নামে আর একটা ফন্ট ছিল, তবে সেটার কীবোর্ড সম্ভবত ভিন্ন ছিল, ফন্টও ভিন্ন ছিল। আর সবাই সেটা চালাতে পারত না। তখন বাংলা ফন্ট যেটা বই ছাপায় ভালো লাগত সেটাই আমাদের বিবেচ্য ছিল। সেটাছিল বিজয়। ক্রমে ক্রমে পিসি কম্পিউটার ইংরেজি ও বাংলা টাইপরাইটারের স্থলাভিসিক্ত হলো। টাইপরাইটার ব্যবহার প্রায় উঠে গেল।
তারপর এলো ইন্টারনেট, ইমেল চালু হয়ে গেল। তখনও কম্পিউটারের ক্ষমতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। প্রায় বিশ বছর ধরে ইংরেজিতে
ইমেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম, এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। এমন করেই এক প্রকার অজ্ঞতার মাঝ দিয়ে কেটে গেল বিশটা বছর। ইতিমধ্যে দেখলাম ওয়েবপেজ ও অনলাইনে খবরের কাগজ। সম্প্রতি বিদেশে এসে দেখলাম কম্পিউটারের ব্যাপক ও বিচিত্র ব্যবহার। শুনলাম প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা। তার আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ঠিকমতো পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। কেউ বলেন পারছেন, কেউ বলেন পারছেন না।
স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সকলকে কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে। তাদের ইমেল ঠিকানা আছে। কিন্তু তাদের ৯০% ভাগ ইমেল দেখতে পারেন না। ইমেল করতে পারেন না। তাদের ছেলে মেয়েরা হয়ত চালাতে পারত কিন্তু তাদেরকে ধরতে দেওয়া হয় না। সরকারি জিনিষ নষ্ট হলে অডিট জান খারাপ করে ফেলবে। তার চেয়ে মোবাইলে এসএমএস তারা ভালো করতে পারেন। সরকারিভাবে বরাদ্দ না করে কম মূল্যে বিক্রি করলে জিনিষগুলো কাজে লাগত। আমি ১০০টা ইমেল করে একটারও উত্তর পাইনি। কোনটা? ইংরেজি K যেখানে সেখানে ‘ক’ অথবা L যেখানে সেখানে ‘ল’ বসালেই কি বৈজ্ঞানিক কীবোর্ড হলো? কীবোর্ড আইন করে চালু করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন হলে অপর সকল কীবোর্ড বেআইনি ঘোষণা করতে হবে। যারা ফন্ট তৈরি করে ব্যবসা করতে চান তারা ফন্টের নকশা করে কপিরাইট বিক্রি করে আয় করুক। বুঝতে হবে ফন্ট আর কীবোর্ড এক নয়। বাংলা কীবোর্ড বাংলা ভাষার জাতীয় কীবোর্ড। এর কোনো কপিরাইট থাকতে পারে না। সেজন্য আইন করতে হবে। এটা আইন করে চালু করা প্রয়োজন। বাংলা ভাষা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। আমি যতদূর জানি, আরবি, ফারসি, উর্দু, ফরাসি, ইটালি, জর্মানী ভাষার কীবোর্ড একটা, অনেক নয়। সেখানে ব্যক্তিগত ভাবে সেই ভাষার কীবোর্ডের কেউ মালিক হতে পারেনি। বাংলাদেশে এমন একটি বাংলা প্রমিত কীবোর্ড থাকা প্রয়োজন। দেশকে ডিজিটাল করার এটাই মূল বিষয়। একই কারণে সম্ভবত ওসিআর বা ভয়েস রিকগনাইজার তৈরি করা যাচ্ছে না। সে কারণে অনুবাদ যন্ত্র তৈরি করা যাচ্ছে না। কিন্তু যারা বিদেশে থাকে তাদের নিকট এর গুরুত্ব বেশি নয়। আবার যারা দেশে থাকেন তাদের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ তারা তো কবি ও সাহিত্যিক। তাদের বই ২০০ কপি ছাপা হলেই তারা খুশি। একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হলেই যথেষ্ট।
বিশ্বের সকল উন্নত দেশে তাদের ভাষার একটি মাত্র কীবোর্ড বা কীবোর্ড লেআউট কিন্তু আমাদের ভাষায় অনেকগুলো কীবোর্ড। তবে ফন্ট অনেক হতে পারে। রোমান বা ইংরেজি ফন্ট কত যে তার হিসেব নেই। এত কাল বাংলা বিজয় চিনতাম যা দিয়ে ফেসবুকে কিছু লেখা যায় না, ইমেলে লেখা যায় না। এবার পেলাম অভ্রকে। অভ্র দিয়ে লেখা যায়। তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? সেদিন শুনলাম বাংলা ওসিআর তৈরি হচ্ছে। তা দিয়ে একটি পুরাতন বই স্ক্যান করলে সেই স্ক্যানকৃত বাংলা কোন হরফে দেখতে পাবো? সে প্রশ্নের জবাব পেলাম না। বিজয়ে, না অভ্রে? পুরাতন বইতো অভ্র বা বিজয়– কোনটাতেই ছিল না। সেই ওসিআরসহ কোনো স্ক্যানার পেলাম না। অন্যদিকে বিজ্ঞানসম্মত কীবোর্ড
প্রকৃতপক্ষে মুনীর অপটিমার বাংলা কীবোর্ড অনেকবেশি বিজ্ঞানসম্মত ছিল। কারণ মুনীর চৌধুরী বাংলাভাষায় বাংলা অক্ষর ও চিহ্ন’র ব্যাবহারের পৌনপুনিকতা হিসাব করে সেগুলোকে সেসব আঙ্গুলের নিচে বসিয়েছিলেন যেখানে যেটা প্রযোজ্য। তার বিবরণ সম্বলিত পুস্তিকা বাংলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। টেক্সট মুদ্রণের জন্য দুটি ধারার ফন্টকে অনুসরণ বা অনুকরণ করে আজকের দিনের কম্পিউটারের সুতন্বী, সোলায়মান ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। অভ্র অবশ্য কয়েকটি কীবোর্ড ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে; তার মধ্যে মুনীর অপটিমা, ফোনেটিক ও জাতীয় কীবোর্ড নামে কীবোর্ড রয়েছে।
জাতীয় কীবোর্ড বলে যে কীবোর্ড তৈরি হয়েছে সেটিও বিজ্ঞানসম্মত নয়। অভ্রকে প্রশংসা করতে হয় যে তারা বাংলা ফন্ট ও কীবোর্ড নিয়ে ব্যবসা করতে নামেনি। তারা সুযোগ দিয়েছে যার যেটা পছন্দ সে সেটা ব্যবহার করতে পারবে। সরকারের উচিত ছিল মুনির কীবোর্ডকে কম্পিউটারের উপযোগি করে চালু করা। যে কাজ বাংলাদেশ সরকার তথা বাংলা একাডেমির করার কথা ছিল সেই কাজ করেছে বাংলাদেশী কয়েকজন তরুণ। আমরা তাদেরকে সম্মানিত করিনি, পুরস্কৃত করিনি। যেহেতু অধিকাংশ অপারেটর বিজয় কীবোর্ডে প্রশিক্ষণ নিয়েছে সেকারণে আমরা বিজয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি।
কম্পিউটারকে অবলম্বন করে সারা দুনিয়া যখন এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা নিছক ফন্ট ও প্রমিত কীবোর্ডের অভাবে যেখান থেকে আরম্ভ করেছিলাম সেখানেই বই ছাপার কাজে থেমে আছি। আমরা ব্যক্তিস্বার্থ রাখতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থের কথা ভুলে গিয়েছি। আমরা দীর্ঘকাল সরকারকে ও দেশবাসীকে কপিরাইটের ভয় দেখিয়ে ভুল বুঝিয়েছি।
এবার আমাদের মতো তথাকথিত কপিরাইটের মালিকদেরকে বাদ দিয়ে প্রকৃত কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। ইউনিকোড ভিত্তিক বিজ্ঞানসম্মত একটিমাত্র কপিরাইট অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতীয় প্রয়োজনে সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়ে যদি জমি দখল করে বনানী গুলশান করতে পারে, রাস্তা তৈরি করতে পারে, তাহলে জাতীয় প্রয়োজনে কোনো এক বা একাধিক বাংলা কীবোর্ড ক্ষতিপূরণ দিয়ে দখল করতে পারেনা কী? একটি মাত্র প্রমিত কীবোর্ড না থাকার কারণে বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল করা সম্ভব হচ্ছে না বলে আমি মনে করি। আমি কম্পিউটার ব্যবহার করতে চাই বাংলাভাষা দিয়ে, কারণ আমার দেশের অধিকাংশ মানুষ ইংরেজি জানেনা।
আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান কে করবেন বা কিসে হবে আমি জানিনা। তবে দিনে দিনে সমস্যা আরও জটিল হবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে সমাধান করছে। কোনো সমন্বয় নেই বলে মনে হচ্ছে।
অতি সম্প্রতি কম্পিউটার ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবার আগেই শিক্ষিত ও অশিক্ষিত নির্বিশেষে সেল ফোনে ইংরেজি হরফে বাংলা এসএমএস লিখতে বা পড়তে পারেন। তাদের জন্য ইংরেজি হরফে বাংলা সাহিত্য আকর্ষণীয় হতে পারে। অন্যদিকে গুগল বাংলা থেকে ইংরেজি ও ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদের চেষ্টা করছে। লেখক হিসেবে ই-বুকের বাজারে প্রবেশ করতে পারলে আমার লাভ। যারযার মতো চেষ্টা করে সমস্যার ভিন্নভিন্ন সমাধান সমস্যাকে অধিকতর জটিল করতে পারে।
মোস্তফা জব্বারের বিজয় বই কম্পোজের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনে ফেলল। বিশ বছরের অধিককাল ধরে কম্পিউটারকে বাংলাদেশে পুস্তক মুদ্রণের প্রধান হাতিয়ার হয়ে অসংখ্য অপারেটর তৈরি করেছে। তারাই বড় সাহেবের কম্পিউটারের চালক। তারা ভালো টাইপিস্ট। ইংরেজি ও বাংলা দুটোই তারা টাইপ করতে পারেন। এত দিন তারা এক সঙ্গে বড় সাহেবের ইংরেজিই মেল টাইপ করতেন আর বাংলা বই বিজয় দিয়ে কম্পোজ করতেন। এত দিনে নতুন এক ঝাক বড় সাহেব এসেছেন তারা নিজেরাই ইমেল টাইপ করেন। টাইপিস্ট বা অপারেটরের ওপর নির্ভর করেন না। তারা প্রয়োজনে ইংরেজি হরফে বাংলা লিখতে আরম্ভ করলেন। তাদের চাহিদা পূরন করতে এগিয়ে এলো অভ্র। ইংরেজি টাইপ করলে বাংলা হয়। তারা ইমেল ও ফেসবুকে সহজে ইংরেজি হরফে টাইপ করে বাংলা লেখেন। এঁরা একদল। বইয়ের কাজ যারা করেন তারা ভিন্ন দল। অন্যদিকে আর এক দল যারা ছিল অশিক্ষিত, তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে গিয়ে প্রথমে ইংরেজি সংখ্যা চিনে নিয়েছে। তারপর চিনেছে ইংরেজি অক্ষর। এখন তারা এসএমএস করে ইংরেজি হরফে।
বাঙালি ভাষাভিত্তিক জাতি। যারা বিদেশে বসবাস করছে তারা তাদের জাতীয়তা ত্যাগ করে না। তারা দেশের ভালো মন্দের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও দেশের ভালোতে খুশি ও মন্দে কষ্ট পায়। যেখানেই থাকুক দেশের কথা চিন্তা করে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)