সৃষ্টিকর্তা সকল সৃষ্টিকূলের মধ্যে মানুষকে অনন্য এক মর্যাদায় সমাসীন করে রেখেছেন। জ্ঞানে, বিদ্যা, বুদ্ধিদীপ্ত আচরণভিত্তিক হওয়ায় মানবকুল অন্য সকল সৃষ্টিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও কর্মপরিধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে। পৃথিবীর বিকাশ ও নতুনত্বের জোয়ারে প্রকৃতিকে নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে উন্নত ও আধুনিক জ্ঞানের অনুসন্ধানে নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় মানবকুল বদ্ধপরিকর। ইতিবাচক আবিষ্কার ও ইতিবাচক পরিবর্তনের নিমিত্তে একদল মানুষ যেমনিভাবে নিরলস, বিরামহীন কাজ করে চলেছেন ঠিক তেমনিভাবে একদল মানুষ মনুষ্যত্বকে বিকিয়ে দিয়ে নির্লজ্জভাবে গর্হিত সকল অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে।
যে সকল মানুষের জন্য পৃথিবী প্রতিনিয়ত অনিরাপদ হয়ে উঠছে, বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে তাদেরকেই বিকৃত মানুষ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে নিবন্ধটি লেখার চেষ্টা করা হয়েছে।
সমাজকে আমরা বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে মূল্যায়ন করার সুযোগ পাই বিশেষ করে সমাজকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিলে ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোন কোন জায়গায় কড়া নাড়া উচিত কিংবা কোন পরিস্থিতিতে কি কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী সেটা জানা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর হবে। মানবিক মূল্যবোধে বলীয়ান হয়ে স্ব স্ব জায়গা থেকে সঠিক এবং সময়পযোগী পদক্ষেপই বিকৃত রুচি এবং বিকৃত মানসিকতার কালিমা থেকে মুক্তি দিতে পারে। পক্ষান্তরে প্রত্যেকটা সমাজকে যদি আপন আলোয় জাগরুক করার কর্মপদ্ধতি বাস্তবে রূপদান করার প্রয়াস সম্ভবপর হয় তাহলে সমগ্র দেশের চিত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাবে অর্থাৎ বিকৃত রুচির মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে আসবে।
পরিবার প্রত্যেক মানুষের জন্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল, পাশাপাশি যে কোন শিশুর মানবিক ও মানসিক বিকাশের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থেকেও পরিবার শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে পরিবারের সঙ্গে যে সকল মানুষের আত্নিক বন্ধন শক্তিশালী ও মজবুত থাকে সে সকল মানুষের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা কম পক্ষান্তরে যারা পরিবার থেকে নানাবিধ কারণে বিচ্ছিন্ন থাকে তাদের বিপথগামী হওয়ার হার অনেকাংশে বেশি এবং এ শ্রেণির মানুষেরাই নানাবিধ অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। কাজেই বিকৃত রুচি এবং বিকৃত মানসিকতার প্রতিকার ও প্রতিরোধকল্পে সমাজের প্রত্যেক মানুষকে পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো ও সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরী।
সমাজে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের সংখ্যা যে হারে বেড়ে চলছে বিবেকবান মানুষ মাত্রই তাড়না অনুভব হবে নিশ্চিতভাবেই। কেননা আমরা কেউই দুশ্চিন্তা এবং সংকটের বাইরে নয়, যে কোন সময় যে কোন পরিস্থিতিতে আমার আপনার আপনজন ধর্ষণের শিকার হতে পারে। কাজেই ভয়ের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তার থেকে পরিত্রাণের জন্য সমাজের আমূল পরিবর্তন জরুরী হয়ে পড়ছে এবং সমাজের পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে তলানির দিকে যাচ্ছে, তার থেকে উত্তরণে গঠনমূলক ও তাৎক্ষণিক সম্মিলিত ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কদিন পূর্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষকদের ধর্ষণ পরবর্তী উল্লাসের সচিত্র দেখেছে দেশবাসী। যদিও তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছে তথাপি মানুষের মধ্যে বিচারের বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
বিজ্ঞজনরা মতামত দিয়ে থাকেন তনু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হলে ধর্ষণের যে ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি তা হয়তো দেখতে হতো না। ধর্ষক শ্রেণির যারা তারা অবশ্যই বিকৃত মানসিকতার, এদের হাত থেকে শিশু, নারী ও বৃদ্ধ মহিলা কেউই নিরাপদ নয়। আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারায় দেখা যায়, ধর্ষিতাকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়ে থাকে এবং ধর্ষিতা বিভিন্ন কারণেই ধর্ষণের পরে বারংবার ধর্ষণের (প্রতীকি অর্থে ব্যবহৃত) শিকার হয়ে থাকে। ধর্ষিতাকে নিয়ে যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হয় তাতে দেখা যায় ধর্ষিতাকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। ধর্ষকের পরিবার এবং ধর্ষককে নিয়ে বিশদভাবে সংবাদের শিরোনাম করা উচিত সেভাবে কিন্তু করা হয় না। উপরন্তু দেখা যায় ধর্ষকের পক্ষে নানাভাবে সাফাই দিতে থাকে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ। তাদের প্রতি ধিক্কার ও তিরস্কার জানাই।
অথচ ধর্ষণকে নিবৃত্ত করার জন্য পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণই পারে বিকৃত মানুষগুলোকে অপরাধ প্রবৃত্তি থেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। প্রথমত: ধর্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান প্রয়োগ করতে হবে যার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে বসবাসরত অন্যদের সতর্কবার্তা দেওয়া যায়, যেমন: সমাজে যে কেউই অপরাধ করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এমন সত্য ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত: অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীকে তড়িৎগতিতে গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগ করে দ্বিতীয়বার অপরাধ করা থেকে নিবৃত্ত করা যেতে পারে।
অপরাধবিজ্ঞানের একাডেমিক আলোচনায় ট্রাভিস হারসি স্যোসাল বন্ডিং তত্ত্বে উল্লেখ করেছেন; পরিবারে বাবা মায়ের সাথে নিবিড় সম্পর্ক, বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়া, সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা, পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটানো, পড়াশোনার পাশপাশি সহ শিক্ষা পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, সমাজ এবং রাষ্ট্রের রীতি নীতি এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের যে কোন ধরনের প্রথা ও নীতি বিরুদ্ধ কাজকর্ম থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করে থাকে। সুতরাং বিকৃত মানসিকতার অধিকারসম্পন্ন যে কোন ছেলেমেয়ের দায় পরিবারের উপর বর্তায়, কেননা একজন ছেলে কিংবা মেয়ে ক্রমান্বয়ে অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। কিশোর কিশোরীদের উপর নজরদারি পরিবারের পক্ষ থেকেই করতে হয় এবং এ বিষয়গুলো একজন উঠতি বয়সীকে সৎ পথে পরিচালনার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
সারাদেশে প্রবলবেগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে সাধারণ মানুষের আশার সঞ্চার হয়েছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে ভাটা পড়ায় সকলের মধ্যে শঙ্কার আবির্ভাব হয়েছে যে ইতিমধ্যে যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আদৌ কি তাদের শাস্তি হবে? যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থেকেই থাকে তাহলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখা উচিত। মাদক এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অবশ্যই দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা উচিত। বাংলাদেশের অগ্রগতির সোপানের অগ্রযাত্রা বহুগুণে বেগবান হতো যদি দুর্নীতির মাত্রাকে শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসা যায়। সুতরাং হলফ করে বলাই যায় দুর্নীতির সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ঐ সকল মানুষ অবশ্যই বিকৃত রুচিসম্পন্ন। কাজেই, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান যে কোন মূল্যে অব্যাহত রাখতে হবে।
অন্যদিকে বলা যায়, যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী কর্মকর্তা স্ব স্ব দায়িত্বে থেকে দায়িত্বে অবহেলা করে সাধারণ জনগণকে নাজেহাল করে থাকে তারাও বিকৃতমনা। পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন সময় দেখা যায়, থানায় অভিযোগ গ্রহণ করছে না পুলিশ। চিকিৎসা কেন্দ্রে ডাক্তার দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত, সরকারি অফিসগুলোতে কর্মচারী কর্মকর্তাদের নিয়মিতভাবে দেরিতে আসা কিংবা অনুপস্থিত থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলোর সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা অবশ্যই বিকৃত মনুষ্যসম্পন্ন। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মনে রাখতে হবে জনগণের টাকায় তাদের বেতন দেওয়া হয়, জনগণকে প্রকৃত সেবা প্রদান করাই তাদের ব্রত হওয়া উচিত। কিন্তু দেখা যায় জনগণের সাথে অনেকেই (কর্মকর্তা-কর্মচারী) খারাপ ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না। এসব বিকৃতমনা বিকৃতরুচির মানুষদের করালগ্রাস থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে এবং তদানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ভবিষ্যৎ সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)