ছেলে বা মেয়ে পূর্ণ বয়স্ক হওয়ার পূর্বে যে বিয়ে সম্পন্ন হয় তাকে বাল্য বিবাহ বলে। যখন থেকে সভ্য সমাজে বিবাহ রীতি শুরু হয় তখন নির্দিষ্ট তেমন কোন বয়সের সীমারেখা ছিল না। কিন্তু দেশ, জাতি, সমাজের উন্নয়নের সাথে সাথে নারী পুরুষের উন্নয়ন জড়িত। তাই অল্প বয়সে বিয়ে হলে শিশু, বালিকা বা কিশোরী সংসার নিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যায়। দেখা যায় ক্রমাগত সে পিছাতে থাকে। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনে আইন তৈরী হতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ সময়ে বাল্য বিবাহ আইন ১৯২৯ প্রণয়ন হয়। এই আইন বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘বাল্যবিবাহ’ ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সহযোগিতায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যেগে কিছু এলাকা বাল্য বিবাহ মুক্ত হিসেবে ঘোষিত হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ১৪ বছরের মেয়ের কোলে ১ বছরের বাচ্চা, বয়স জিজ্ঞাসা করলে বলে ১৮। এ দৃশ্য বড় সাধারণ। পাশাপাশি এ দৃশ্যও দেখি যে শত শত মেয়ে সূর্যোদয়ের সাথে তাল মিলিয়ে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে চলেছে গার্মেন্টসের উদ্দেশে। বাংলাদেশের আজকের অর্থনৈতিক সাফল্যের বড় একটি নিয়ামক শক্তি পোষাকশিল্প। এখানে নারীর অবদান অসামান্য, অনন্য। ৩৫ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের মধ্যে ২৫ লাখই নারী।
আমরা যখন স্কুল কলেজের মেয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সাফল্য নিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাসে ফেটে পড়তে দেখি তখন মনটা ভরে ওঠে। নারী কর্মজীবনে, ক্ষমতায়নে সর্বত্র নিজস্ব শক্তিতে এগিয়ে চলেছে। নারীর এই অগ্রগতিকে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ সহজভাবে দেখে না। সমাজের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বহু কৌশল বিদ্যমান। নতুন নতুন কৌশলে নারী নির্যাতন হচ্ছে। পত্রিকায় পাতা খুললে প্রতিদিনই নারী নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। কখনো কখনো এই হার মহামারি আকার নেয়।
সমাজের মধ্যে বা সরকারের মধ্যেই ঘাপটি মেরে আছে নারীকে পিছে টানার অভিনব কৌশল। নারীকে পিছিয়ে দিলেই সমাজকে দেশকে পিছিয়ে দেয়া সম্ভব।
তার অংশ হিসেবে নারীকে প্রাপ্তবয়স্কা বানিয়ে বিয়ে দেয়ার প্রচলন।
বাংলাদেশের সংবিধান এদেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার দিয়েছে। অর্থাৎ নারী পুরুষের অধিকার সমান। তাছাড়াও আমরা জানি যে কোন দেশে নারী-পুরুষ সমান ভাবে অগ্রসর না হলে, সে জাতি দেশ অগ্রসর হয় না। বহু বছর আগে নেপোলিয়ান বেনাপোট বলেছেন- “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও। আমি একটা শিক্ষিত জাতি দেব”। কিন্তু আমরা একটা কিশোরী মেয়ের কাঁধে জোয়াল চাপানোর মত করেই সংসারের দায় দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চাই। আমাদের দেশে নারী শিক্ষায়, পেশায়, ক্ষমতায় উন্নয়নে এগিয়ে চলেছে। তারপরও নানা রকম পারিবারিক ও সামাজিক কষাখাতে আক্রান্ত ও জর্জরিত সে। এক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা না থাকলে সমাজ, দেশ, জাতি ক্রমে উন্নয়নের পথে না হেঁটে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। যার পেছনে বড় দায় থাকবে বাল্য-বিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপের।
বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ে। তার সীমিত জ্ঞানে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা হয়ে ওঠে এবং শারীরীকভাবে নানা সমস্যায় আক্রান্ত হয়। শুধু তাই নয়, তাকে পারিবারিক বিভিন্ন জটিলতা ও কুট কৌশলের স্বীকার হতে হয়। এক পর্যায়ে নিজের মধ্যেও বিভিন্ন কুসংস্কার ও কূট কৌশল দানা বাঁধতে থাকে। মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। একজন অসুস্থ মায়ের সন্তান তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বয়ে আনতে পারে শুধু হতাশা। উদারতা, ত্যাগ ও বুদ্ধিমত্তা এসব পরিচয় খুব কমই মেলে। ফলে পরিবারকে নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। যা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিকভাবে।
আমরা বাঙালি সহজাত ভাবেই সমাজবদ্ধ। নিজেকে কখনো সমাজের বাইরে রাখা যায় না।
বাল্যবিবাহ আইন- ১৯২৯ এ সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে: “কোন ব্যক্তি কোন শিশুকে বাল্য বিবাহ করতে বা করাতে বাধ্য করতে পারবে না”। যে কেউ বাল্য বিবাহের চুক্তি করলে, তার একমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে। শিশু শব্দের ব্যাখ্যায় ১৮ বছরের নীচের বয়সী মেয়েকে এবং ২১ বছরের নীচের বয়সী ছেলেকে বোঝানো হয়েছে।
২০১৫ সালে সরকার এ নীতিমালা সংশোধন করে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর রাখলেও ইচ্ছা করলে পরিবারের পক্ষ থেকে ১৬ বছরেও বিয়ে দিতে পারবে বলে ঠিক করা হয়। এই নীতিমালায় ছেলের বয়স ২১ বছর ও মেয়ের বয়স ১৬ বছরের কম হলে তা বাল্যবিবাহ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে, বিবাহকারী, বিবাহ পরিচালনাকারী ও অভিভাবক আইনে দণ্ডনীয় হবে। ১৯২৯ সালে দণ্ডের বদলে নতুন আইন একমাসের কারাদণ্ড ও এক হাজারের পরিবর্তে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও দশ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। এছাড়া এ বিয়ে বন্ধ করলে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের দায়িত্বে শাস্তির ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। বিবাহ বাতিলের বিষয় থাকলে সে দায়িত্ব পারিবারিক আদালতে অভিযোগ করতে হবে। এছাড়া এই আইনে যা রয়েছে,
# বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে মিথ্যা অভিযোগ করলে ছয় মাসের কারাদনণ্ড বা ৩০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
# দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়ে বাল্য বিবাহ করলে তাদের ১৫ দিনের আটকাদেশ ও অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।
# কোন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্ক কাউকে বিয়ে করলে দুই বছর কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
# মা-বাবা আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড করা যাবে।
# বিয়ে পড়ানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আইন না মানলে দুই বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে।
# বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, জন্ম নিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট বিয়ের বয়স নির্ধারনের ক্ষেত্রে বিবেচ্য হবে।
# এ সংক্রান্ত মামলার বিচার অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধের মতোই হবে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতেও বিচার করা যাবে।
বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের যে খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে, তাতে বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্র যেমন বাড়ানো হয়েছে, তেমনি সাজার মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে, এ তথ্য দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মাদ শফিউল আলম।
২০১৫ সালে সরকারের পক্ষ থেকে মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬তে নামিয়ে দেয়ার বিষয়ে ঘোষণা আসে। এ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে বিভিন্ন সংগঠন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, কলাম লেখকের সচেতন প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের ফসল হিসেবে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ই বাস্তবায়ন হয়। “তবে, কিন্তু” এসব কথার মধ্যে ফাঁক লুকিয়ে থাকে। সরকারের একটা ঘোষণার পেছনে কেন এই লেজ ঝুলানো থাকবে?
এ বিষয় নিয়েও শিক্ষিত সচেতন নাগরিকরা চিন্তিত। সরকারের প্রতি আহবান, নারীর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালা আরো স্পষ্ট আরো সহজ ও আরো মানবিক হওয়া প্রয়োজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)