কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনের বাড়ি বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে এ কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেরোসিন সংগ্রহে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলেন। কিন্তু কেরোসিন নিয়ে যেতে পারেননি। পথেই আটক হন পাকিস্তান বাহিনীর হাতে। ঠাঁই হয় চট্টগ্রামের কারাগারে। পরে জামিন পান কিশোর জসিম। ফের যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ওই বছরের নভেম্বরে ঈদের দিন মামার বাসায় গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জসিম। মামাতো বোন তাকে পোলাও কোর্মা খেতে দেন। খাবার খেয়ে বাসা থেকে বের হতেই আল বদর বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায় চট্টগ্রামের নন্দনকানস্থ মহামায়া ডালিম ভবনে (ডালিম হোটেল)। মীর কাসেম আলীর ‘ডেথ টর্চার’ সেলে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে মারা যান কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন। এরপর তার লাশ ফেলে দেয়া হয় সাগরে। এ তথ্য উঠে আসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ দেয়া জসিমের মামাতো বোন হাসিনা খাতুনের সাক্ষ্যে।
মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিরোধে প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের ও মুক্তিকামী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালাতো, হত্যা করতো এবং মরদেহ গুম করে ফেলতো। মীর কাসেম আলী ও তার আলবদর বাহিনী তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চট্টগ্রামে মুক্তিকামী মানুষের জন্য আবির্ভূত হয়েছিল ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। কাসেম ছিলেন চট্টগ্রামের বিভীষিকা। তার জল্লাদখানার নাম দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ের চামড়ার গুদাম, সালমা মঞ্জিল এবং ডালিম হোটেলসহ ৫টি নির্যাতন কেন্দ্র।
জুন মাসের মধ্যেই আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলী এসব নির্যাতনকেন্দ্র গড়ে চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র ব্যাপকহারে গণহত্যা, হত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠণ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, উচ্ছেদ, বিতাড়ণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর অপরাধী চক্রের মূল ধারায় সম্পৃক্ত হন। নিজেও সরাসরি অপরাধ সংঘটিত করেন তিনি। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে অধ্যয়নরত থাকাবস্থায় ১৯৬৭ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত থাকাকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের কলেজ শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম শহর শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নিযুক্ত হন।১৯৭১ সালে ৬ নভেম্বর ১৯৭১-১৯৭২ সেশনের নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ৭ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন। ইসলামী ছাত্রসংঘ পরে রূপান্তরিত হয় কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীতে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মীর কাসেম আলী জামায়াতসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের সমন্বয়ে সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করেন। সেই আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী স্বাধীনতাবিরোধী মূল ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। ওই সময়কালে ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল জাহের মোঃ আবু নাসের, তৎকালে চট্টগ্রাম জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবু তাহের, তৎকালীন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী বর্তমানে মানারত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক এনামুল হক মঞ্জু, তৎকালীন জামায়াতের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা মোঃ সামসুদ্দিন, তৎকালীন জামায়াতের শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীকালে ইসলামী ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের সাবেক সদস্য বদিউল আলম, তৎকালীন চট্টগ্রাম সোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ও বর্তমানে শিল্পপতী, তৎকালীন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি আফসার উদ্দিন চৌধুরী, শাহজাহান (বর্তমানে মৃত), শাহ আলম(বর্তমানে মৃত), শাহ জালাল, ডা. শামীম, ডা. হাং (বর্তমানে মৃত), জাহাঙ্গীর চৌধুরী, রবিউল হোসেন, কাফি (বর্তমানে মৃত) ও মীর মোঃ শোয়েবদের সমন্ময়ে তাদের অনুসারী ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী-সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহায়ক বাহিনী হিসেবে আলবদর বাহিনী গঠন করেন মীর কাসেম।
আলবদর বাহিনীর প্রথমে চট্টগ্রাম শহর শাখার কমান্ডার ও পরবর্তীকালে অন্যতম কেন্দ্রীয় কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন ইত্যাদি সীমাহীন বর্বরতম অপরাধ সংঘটিত করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার, আলবদর ও আল শামস্ বাহিনীর প্রধান ও কেন্দ্রীয় কমান্ডার হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে মীর কাসেম আলী ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের হাইকমান্ডের তৃতীয় স্থানে অধিষ্ঠিত হন।
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৬৬ সালে চন্দ্র মোহন নাথ চট্টগ্রাম শহরের পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডে ৬ শতক জমির ওপর তিন তলা ‘মহামায়া ভবন’ নির্মাণ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাসখানেক পরই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন চন্দ্র মোহন নাথ। দেশ স্বাধীন হওয়ার ফিরে আসেন। তার অনুপস্থিতিতে যুদ্ধের সময় এটি নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে আল বদর বাহিনী। জুলাই-আগস্টে মহামায়া ভবনটি দখল করে আলবদর নেতা মীর কাসেম ও তার অনুসারীরা। তখনই ‘মহামায়া ভবনের’ নাম পাল্টে রাখা হয় ‘ডালিম হোটেল’।
একাত্তরে চট্টগ্রামে এই ডালিম হোটেলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন আলবদর নেতা মীর কাসেম আলী। এতে ডালিম হোটেল মানুষের কাছে পরিচিতি পায় হত্যাপুরী হিসেবে। আর নৃশংসতার জন্য মীর কাসেমের পরিচয় হয় ‘বাঙালি খান’। ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান বলেন, মীর কাসেম ও তার সহযোগীরা একাত্তরে খোলা জিপ ও অস্ত্র নিয়ে পুরো শহর দাপিয়ে বেড়াত। মীর কাসেমের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সহযোগী ও স্থানীয় হিন্দুদের ধরে সেখানে নিয়ে চালানো হত অমানুষিক নির্যাতন। ওই হোটেলে মীর কাসেম আলী এলে বদর সদস্যরা ‘ডা. খান আ গ্যায়া…, কাসেম সাব আ গ্যায়া’ বলে হাঁক পাড়ত। ওই ভবনের প্রতিটি কক্ষ থেকে ভেসে আসত নির্যাতিতদের গোঙানি, যন্ত্রণার আর্তচিৎকার।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের রায়ে আদালত বলেছেন, ‘এটাও প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আলবদরের সদস্যদের পরিচালনা এবং নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজেই। ডালিম হোটেল সত্যিকার অর্থেই একটি ডেথ ফ্যাক্টরি ছিল।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ১০৪৬ প্যারাগ্রাফ সম্বলিত মোট ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের প্রত্যেকটি অংশে ছড়িয়ে আছে মীর কাসেম আলীর নৃশংসতার বিভিন্ন বিবরণ।মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়া ২৪ সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন তার হাতে নির্যাতিত এবং আরও ৫ জন ছিলেন শহীদ বা নির্যাতিতের পরিবারের সদস্য। তারা সরাসরি বর্ণনা দিয়েছেন তাদের বা তাদের স্বজনদের ওপর সংঘটিত ভয়াবহতম মধ্যযুগীয় সে নির্যাতনের।
প্রধানত চট্টগ্রামের মহামায়া ভবন দখল করে গড়া ডালিম হোটেল নির্যাতন কেন্দ্রে এসব নির্যাতন ও নির্যাতন শেষে হত্যার ঘটনা ঘটে। তাই রায়েও বারে বারে এসেছে ডালিম হোটেলে সংঘটিত নৃশংসতার বর্ণনা। সেলিম মনসুর খালেদ অনুদিত আলবদর (উর্দু গ্রন্থ) বইয়ের ১৩৩ নম্বর পৃষ্ঠা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৯৭১ সালের ১০ মে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আযম ও অপারেশন চিফ ফাতেমী চট্টগ্রামের ছাত্রসংঘের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে পরামর্শ করেন, নিউল (নেভাল) হেডকোয়ার্টার্সে সেনাযাত্রী ছাউনিতে সভা করেন এবং জুনের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম শহরে আলবদরের একটি কোম্পানি গঠন করেন। এর কমান্ডার মীর কাসেম এসব সভায় উপস্থিত থেকে সমগ্র জেলায় আলবদরের ৩৭টি প্লাটুন গঠন করে দেন। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার উষালগ্নে যে তালিকা তৈরি করা হয়, সেটি তৈরিতেও ভূমিকা রাখেন তিনি।১৯৭১ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় এক সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এতে লিপিবদ্ধ আছে, চট্টগ্রামের মুসলিম ইন্সটিটিউটের সুধী সমাবেশে ‘পাকিস্তানের বর্তমান জাতীয় সংকট ও নাগরিকদের দায়িত্ব’ শীর্ষক আলোচনায় পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তান রক্ষায় সময়োচিত হস্তক্ষেপ ও সাফল্যের জন্য সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেন। এ সুধী সমাবেশের অনুষ্ঠানে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি মীর কাসেম আলী সভাপতিত্ব করেন।১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত আরেক সংবাদে বলা হয়, ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবু নাসের, শহর শাখার সভাপতি মীর কাশেম আলী ও জেলা শাখার সভাপতি আবু তাহের আসন্ন প্রতিরক্ষা দিবস পালনের জন্য দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আহবান জানান।
বিবৃতিতে তারা আরও জানান যে, ইসলামী ছাত্রসংঘ প্রতিরক্ষা দিবস পালনের জন্য যথাযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ৮ নভেম্বর অপরাহ্ন ২ ঘটিকায় চট্টগ্রামের স্থানীয় মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বদর দিবস উপলক্ষে আলবদর বাহিনী আয়োজিত এক সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। চট্টগ্রাম সেক্টরের উপ সামরিক আইন প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার আতা মোহাম্মদ খান মালিক এস কে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করতে সম্মত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।
পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ তাহের, শহর সভাপতি মোহাম্মদ আবু তাহের এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবু নাসের বদর দিবস উপলক্ষে গৃহীত চট্টগ্রাম বদর বাহিনীর কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বদর দিবস পালন উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে এক গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। গণজমায়েতের অন্যান্যদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলী বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন যে, আজকের বদর দিবসের শপথ হল- ক. ভারতের আক্রমণ রুখে দাঁড়াবো, খ. দুস্কৃতকারীদের খতম করবো, গ. ইসলামী সমাজ কায়েম করবো।১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর দৈনিক আজাদ ও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলী পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি ভুমি রক্ষার খাতিরে সৈনিক হিসেবে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য দেশের দেশপ্রেমিক যুবকদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
ভারতের ওপর মরণাঘাত হানার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যে ছাত্রসংঘ নেতাদ্বয় দলীয় কর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেন’।১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদ ‘হিন্দুস্তানী হামলার বিরুদ্ধে গণসমাবেশ’ শীর্ষক এক সংবাদ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ‘শুক্রবার বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে আয়োজিত এক গণসমাবেশে যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানের উপর হিন্দুস্তানের হামলাকে প্রতিহত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানানো হয়। আলবদর বাহিনী এই গণসমাবেশের আয়োজন করে। উক্ত গণসমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলী হিন্দুস্তানের যুদ্ধবাজ ও আকাশবাণীর মিথ্যা প্রচার ও গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য জনসাধারনের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন যে, আমরা সত্য ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করছি। খোদার রহমতে জয় আমাদের অবধারিত’।
‘একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইয়ের লেখক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মীর কাসেম আলী তৎকালীন ডালিম হোটেলে (বর্তমানে মহামায়া ভবন) শত শত বাঙালিকে ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করেন। স্বাধীনতার পর ডালিম হোটেল থেকে অনেক বাঙালিকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়’।
ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক সাক্ষী নাছিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যুদ্ধ চলাকালে ডালিম হোটেলকে নরকে পরিণত করেন মীর কাসেম আলী। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকজনকে ধরে এনে পা ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চলানো হতো, প্রস্রাব করে তা পানে বাধ্য করা হতো, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। নির্যাতনের কারণে অনেক বাঙালির মৃত্যু হয়েছে’।
ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ন্যাপ নেতা সাইফুদ্দিন খান, তৎকালীন জেলা ন্যাপের সভাপতি এ এন নুরুন্নবী, ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের দুই কর্মকর্তা অরুণ কুমার চৌধুরী ও শফিউল আলম চৌধুরী, ড. ইরশাদ কামাল খান, ড. মোসলেহ উদ্দিন খান, জেলা ন্যাপের নেতা অ্যাডভোকেট শফিউল আলম (বেবী শফি), জাহাঙ্গীর চৌধুরী, চীনপন্থি ন্যাপ নেতা মো. সেলিম এবং মেজবাহ খান প্রমুখ।
তারা তাদের সাক্ষ্যে বলেন, অমানবিক নির্যাতনে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধা জসীম, টুন্টু সেন ও রঞ্জিত দাসসহ ৮ শহীদের মরদেহ গুম করে ফেলেন কাসেমের বাহিনী। পরে তারা জানতে পেরেছেন, হত্যা করে তাদের মরদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। তাই তাদের মরদেহ গত ৪৩ বছরেও খুঁজে পাননি স্বজনেরা।
ডালিম হোটেলে একাত্তরে নির্যাতনের শিকার জয় বাংলা বাহিনীর উপ-প্রধান মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর মাদারবাড়ির বাসা থেকে আমি এবং আমার ছোট ভাই প্রয়াত দস্তগীর চৌধুরীসহ কয়েকজনকে চোখ বেঁধে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় বদর বাহিনী। যখন ডালিম হোটেলে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আমার মা কাঁদছিলেন। মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে তাকে চোখ বেঁধে ডালিম হোটেলে ২৩ দিন নির্যাতন করা হয়।
সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ডালিম ভবনের ক্যাম্পে তাকে নিয়ে গিয়ে শরীরের স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল স্থানে আঘাত করা হয়েছিল। পেটানো হয়েছে পা ওপরে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে। জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছিল ইলেকট্রিক শক।
সৈয়দ এমরান বলেছেন, মীর কাসেম আলী নির্যাতনের মাধ্যমে আলবদর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য জানার চেষ্টা করত। তাকেও ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় মীর কাসেম আলীর বাহিনী। সেখানে লাঠি দিয়ে এবং ইলেকট্রিক শক দিয়ে জানালার সঙ্গে পিছমোড়া করে বেঁধে পেটানো হয়। নির্যাতন চলত অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত। জ্ঞান ফিরে আসলে আবারো পেটানো হতো। পানি চাইলে প্রস্রাব করে দিত।
মীর কাসেম আলীর নির্যাতনের শিকার সানাল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ‘ডালিম হোটেলে মীর কাসেম আলীর নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজনদের ধরে এনে নির্যাতন করত। তাকেও সেখানে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। তার সামনে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। লাশ হয়েও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন রক্ষা করে গেছেন ধরা পড়া মুক্তিযোদ্ধারা। সে কথা মনে হলে এখনো ভয়ে শিহরিত হন সানাল্লাহ চৌধুরী।
মীর কাসেম আলীর স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা ও নৃশংসতা একাত্তরেই শেষ হয়ে যায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নিধন পর্ব শেষে স্বাধীনতার পর ঢাকায় পালিয়ে গিয়ে নিজেকে মিন্টু নামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু আসল মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেলে আরেক যুদ্ধাপরাধী মাঈনুদ্দিনের সঙ্গে পালিয়ে যান লন্ডনে। সেখান থেকে সৌদি আরবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মীর কাসেম আলী আবার দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্রসংঘকে ইসলামী ছাত্রশিবিরে পরিণত করেন তিনি। মীর কাসেম আলী শিবিরের সভাপতি পদে নিযুক্ত হয়ে এদেশে রগকাটা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি শুরু করেন।
আজ এই বাঙালী খানের ফাঁসির মধ্য দিয়ে ডালিম হোটেলের বীর শহীদদের আত্মাদের ৪৫ বছরের প্রতীক্ষার হলো অবসান।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)