চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের ‘লজ্জা থেরাপি’

‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’- প্রবাদের এ তথ্য নিয়ে সন্দেহ থাকলেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বব্যাপী লকডাউন অবস্থায়ও বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন তখন জনসমাগম করে নির্বাচন করছিলেন। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু নির্বাচন কমিশন কেন, মন্ত্রী পরিষদের একাধিক সদস্যের কথা এবং কাজেও করোনা ভাইরাসের লজ্জা পাওয়ার কথা। অবশ্য দেশের দায়িত্বশীলদের কাজ ও কথাবার্তায় বুঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাকযুদ্ধ আর কী, এ যেন তার চেয়েও বড় বাকযুদ্ধ।

করোনা ভাইরাসের সঙ্গে আসলে যুদ্ধই হওয়ার কথা ছিল। বিশ্বজুড়ে তাই চলছে। মানুষ আর ভাইরাসের যুদ্ধ। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। নতুন করে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার বহু মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরছেন। এ যেন বিশ্বযুদ্ধের মতো অবস্থা। সবাইকে যার যার বাসায় থাকতে বলা হচ্ছে। চীন, ইটালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশের দেশে দেশে লকডাউন, জরুরি অবস্থা চলছে। বাঘা বাঘা অর্থনীতির দেশগুলো এ যুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছে! আর আমাদের এখানে যেন চলছে উল্টো পথে যাত্রা।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কথাই ধরা যাক। তার স্ত্রী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। একথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, জানিয়েছেন। এছাড়া স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনেও ছিলেন, আছেন তিনি। দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে তিনি বাসা থেকেই রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতির উদ্দেশে তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন, সেটাও ছিল জনসমাগমমুক্ত। আর আমাদের এখানে এখনও সচেতনতার অভাব প্রকট।

এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথাই ধরা যাক। তিনি শনিবারও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তাকে প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যে দেখা গেল। করোনা ভাইরাসের এ জরুরি অবস্থায় প্রত্যেক প্রাণের মূল্য আমাদের কাছে অপরিসীম। বিশ্বের আর কোথাও একটা মৃত্যুর খবরও না আসুক, এটাই চাই। তবে সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের কাছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সুস্থতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কৌশলের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবেন এটাই কাম্য। এর বদলে তার এমন অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকিযুক্ত সংবাদ সম্মেলন মানুষের কাছে ভুল বার্তা দেবে। এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন রোল মডেল হতে পারে।করোনা

একই অবস্থা সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর বেলায়ও। তারা সবসময় নিয়মকানুন মানার কথা বললেও নিজেরা তেমন একটা মেনে চলেন না। এমনটাই দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানটির এখনও পর্যন্ত হওয়া সংবাদ সম্মেলনগুলোতে। প্রত্যেক দিন সাংবাদিকদের ডেকে তাদের সংবাদ সম্মেলন করতে হচ্ছে! তথ্য দেয়া ও পরিস্থিস্থিতি বিবেচনায় এটা যদিও জরুরি, তবুও এ কাজটি তারা ভার্চুয়ালভাবে করতে পারে। তারা নিজেদের বক্তব্য ধারণ করে ভিডিও আকারে আইইডিসিআর এর ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইটে দিতে পারে। সঙ্গে টেক্সটও। এতে তাদের ‍নিজেদেরও যেমন করোনার ঝুঁকি কমে, একইভাবে সাংবাদিকদেরও। কিন্তু কে শোনে কার কথা? এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ সংস্থাটির পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা’র অসুস্থতার খবর আসলে প্রথমে স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। পরে যদিও জানা গেছে, তিনি উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে অসুস্থ।

অন্যদিকে করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা যখন লকডাউন হচ্ছে, তখন নির্বাচন কমিশনের একরোখা মনোভাব দেখা গেল ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে। ইভিএম ব্যবহারে করোনা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কার কথা আইইডিসিআর জানালেও তারা এমন পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। ভোট দিতে গেলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও! সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভোট বন্ধ করার দায়িত্ব তো নির্বাচন কমিশনের, প্রধানমন্ত্রীর নয়। নির্বাচন কমিশন ভোট বন্ধ না করলে প্রধানমন্ত্রীর ভোট দিতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তিনি ভোট দিতে না গেলে ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রশ্ন আরও জোরালো হবে। এজন্য হয়তো তিনি গিয়েছেন। তবে এই কালিমা শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের গায়েই থাকবে। দেশে যদিও সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের আসায় বসে থাকে, তবুও তিনি এক্ষেত্রে অনধিকার চর্চা করতে যাবেন কেন?

এছাড়া কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর দিনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকির ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা কামরান বিদেশ থেকে এসে কোনো ধরনের কোয়ারেন্টাইন না মেনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে এসেছেন। এটাও কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বব্যাপী যেখানে হাজার হাজার মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছেন, আক্রান্ত হচ্ছে লাখ লাখ, সেখানে এমন ঘটনাগুলো খুবই কষ্টদায়ক।

এমনকি এখানে সাধারণ মানুষও যেন অসচেতনতার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন। কে কার চেয়ে বেশি অসচেতন হতে পারেন এই প্রতিযোগিতা। বিদেশ থেকে এসে বিমানবন্দরে এলাকায় কোয়ারেন্টাইনে না থাকাসহ হোম কোয়ারেন্টাইন না মানা, প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো, বিয়েশাদী করাসহ যতভাবে নিয়ম ভাঙা যায়, তার সবকিছু করছেন তারা। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত আসছে এসব খবর। আর দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অন্য কোনো দেশে মোবাইল কোর্ট বসানোর খবর তেমন একটা না আসলেও এখানে তা করতে হচ্ছে।

এসব বিষয় বাদ দিলেও দেশের মন্ত্রিসভার সদস্যদের করোনা সংক্রান্ত বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমত ট্রলের পাত্র হিসেবে উপস্থাপন হচ্ছে। করোনার মতো এমন দুর্যোগের সময়ও যদি তারা ঠিকভাবে নিজেদের মুখ নিয়ন্ত্রণ না করেন, তাহলে হাসির পাত্র হওয়া ছাড়া উপায় নেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে তারা এতদিন যেভাবে লাগামহীন ও হাস্যকর কথাবার্তা বলে আসছেন, এখন অন্তত এসব থামানো জরুরি। করোনা নিশ্চয়ই তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়। এটা জাতীয় এবং বৈশ্বিক দুর্যোগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন কীভাবে করোনা মোকাবেলা করছে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্রুত নিজেদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হবে। এখন কাদা ছোঁড়াছুড়ির সময় নয়, সময় এখন ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানবতার যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)