কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস – সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সংক্রমিত হবার আগেই আমাদের মনস্তত্বে সংক্রমণ ছাড়িয়েছে বহুগুণ। আমাদের গণমাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য বিস্তার করেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও গ্রাস করেছে। বাংলাদেশে একটা বড় সমস্যা হচ্ছে আপদকালীন সময়ে প্রচুর তথ্য ও সংবাদের ছড়াছড়ি, যার মধ্যে প্রকৃত তথ্য ও নির্দেশনা খুঁজে পাওয়াটা দুরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যেন একটা তালগোল পাকানো অবস্থা। সংস্কৃতিক ভাবে আমারদের প্রিয় খাবার খিচুড়ি, আমাদের খাদ্যাভ্যাসের মতো যে কোনো বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে খিচুড়ি পাকানো চিন্তা ভাবনা পরিলক্ষিত হয়, করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সরকার যে পক্রিয়ায় তথ্য বা নির্দেশনা দিচ্ছে সেখানেও পদ্বতিগত ভাবে বিচ্ছিন্নতা দেখা যাচ্ছে। যদিও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) নিয়মিত ব্রিফিং করেছে, কিন্তু সেখানে রোগীর সংখ্যাটাই প্রাধান্য পাচ্ছে, সার্বিক ভাবে তা মানুষের উৎকণ্ঠা নিরসনে যথেষ্ঠ নয়।
যেকোন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকার দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে যে যোগযোগ করেন বা বার্তা তৈরী করেন তাকে বলা হয় বা আপদকালীন যোগাযোগ বা ক্রাইসিস কমিউনিকেশন। বিশ্ব জুড়ে ক্রাইসিস কমিউনিকেশন এর জন্য কিছু নিয়ম কানুন শক্ত ভাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশ বরাবরই ব্যতিক্রম, এখানে সরকারের প্রায় সব মন্ত্রী নির্ধিদ্বায় নিজেদের মতামত দিয়ে থাকেন, একমনকি তার বক্তব্য তার সরকারকে কতটা বিব্রত করবে তা নিয়েও ভাবেন বলে মনে হয় না।
করোনা ভাইরাস নিয়ে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী, বিশিষ্ট জন, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতা সকলে নিজস্ব মতামত দিয়ে যাচ্ছেন, আর আমাদের মিডিয়ার বন্ধুরা সবার মতামত তুলে ধরছেন, যেটা আপদকালীন সময়ে মোটেও কাম্য নয়।
বিশ্বের খ্যাতিমান যোগাযোগ বিশেষজ্ঞগণ আপদকালীন সময়ে যে ধরনের যোগাযোগ পদ্বতি অনুরসরণ এর উপর জোর দিয়ে থাকেন তার আলোকে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যা করা যেতে পারে তা হলো:
১. একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে সরাসরি প্রভাবিত ব্যক্তিদের সাথে স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করা, এবং একটি শক্তিশালী বাহ্যিক যোগাযোগের কাঠামো তৈরী করা, যাতে করে একই বিষয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন রকমের তথ্য সরবারহ বন্ধ করা যায়। যারা যোগাযোগ করবেন তাদের মধ্যে জবাবদিহীতা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিবর্গকে এই স্থানে নিয়োগ দিতে হবে।
২. সমস্যাগুলি বুঝতে হবে, সব সমস্যা বা সংকট এক নয়, তাই প্রতিটি নির্দেশনা সু-স্পষ্ট এবং প্রতিটি বার্তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সরবরাহ করা, যা প্রভাবিত জনগোষ্ঠীর উদ্বেগকে সরাসরি সম্বোধন করে সমাধান নির্দেশনা দেয়া যায়। মনে রাখতে হবে তথ্য যেন আপনার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে।
৩. সর্বদা প্রস্তুতি থাকা, দুর্যোগকালীন সময়ে পরিস্থিতির চেহারা দ্রুত পরিবর্তন হয়। তাই যখন যখন কোনও সংকট দেখা দেয়, কী ঘটেছে তার তথ্য সম্পর্কে তথ্য নেয়া ও বিতর্ক কম করা, এবং সংস্থাটি বা সরকার কীভাবে এগিয়ে যেতে চলেছে বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে সে সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য দেয়া।
৪. যে সংস্থা বা যারা যোগাযোগ করবেন তাদের দ্রুততার সাথে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানোর স্বক্ষমতা থাকতে হবে, কারণ তথ্য প্রদানে তারা যদি দীর্ঘ সময় নেয় তবে সংকট ঘনীভূত হবে।
৫. সরকার বা সংস্থাগুলির উচিত অন্যান্য সংস্থাগুলি, স্টকহোল্ডার্স বা অংশীদারদের বা সাহায্য সংস্থা যারা একই ইস্যুতে কাজ তাদের নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যাতে তথ্য বিভ্রাট এড়ানো যায়। এতে করে আক্রান্ত জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও সমর্থন পাওয়া যায়।
৬. নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা দেখছি সরকারের মন্ত্রীরা সংকট নিয়ে আবেগের ভিত্তিতে জবাব দেন। জনগণ এটাকে সরকারের দুর্বলতা মনে করে। আবেগের বসে মিডিয়া ক্যামেরার সামনে কথা বলা, বার্তা দেয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আবেগের ব্যবহার না করে ডেটা বা তথ্য ব্যবহার করুন।
৭. সরকার যদি সর্বস্তরে একই কথা না বলে থাকে তবে সরকার নিজেকে সমস্যায় ফেলতে যাচ্ছে। তাই একই বার্তা সবজায়গায় প্রচার করতে হবে।
এতো গেলো আপদকালীন পরিস্থিতিতে সরকার কিভাবে জনগণের সাথে একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরী করবেন। কিন্তু সরকার যে বার্তা বা তৈরী করবেন, যে তথ্য দিবেন সেগুলো জনগণের জন্য সহজবোধ্য হতে হবে। সাইন্স কমিউনিকেশন বা যে ধরণের যোগাযোগে বৈজ্ঞানিক তথ্য থাকবে তা সবধরণের জনগণের জন্য সমান উপযোগী নাও হতে পারে। তাই শব্দ ও ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংস্কৃতিক দিকটা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে, এবং প্রান্তিক জনগণের উপযোগী করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সংযুক্ত করা।
যাই হউক, আমরা প্রথমেই ব্যর্থ হয়েছি কোরোনা ভাইরাসকে মানুষের কাছে যথাযথ ভাবে উপস্থাপন করতে। যারা হেলথ কমিউনিকেশন নিয়ে কাজ করেন, তারা সবসময় চেষ্টা করেন কীভাবে রোগের বিষয়বস্তুকে সরলীকরণ করে প্রান্তিক মানুষের বোঝার উপযোগী করা যায়, বাংলাদেশের অনেক স্বাস্থ্য সচতেতনতার ক্যাম্পেইনে এর প্রতিফলণ আছে। যেমন, যক্ষা নিয়ে করা স্বাস্থ্য বিভাগের যোগাযোগগুলোতে বলা হয় ‘যক্ষা একটি ছোঁয়াচে রোগ’ সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে চললে যক্ষা প্রতিরোধ করা যায়’।
করোনার আকস্মিকতায় আমরা সে ধরণের প্রস্তুতি নিতে পারিনাই, এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যতটুকু স্বাস্থ্য সুরক্ষা জ্ঞান আছে তার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারিনাই। যে কারণে আমরা সহজ কথায়- এক বাক্যে বলতে পারিনাই ‘করোনা ভাইরাস একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ, মৃত্যু ঝুঁকি এড়াতে যথাযথ নিয়ম মেনে চলুন’, অথবা এরকম কিছু একটা। বিপরীতে আমরা যেটা করেছি ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দটি সরাসরি মানুষের কাছে নিয়ে গেছি। প্রান্তিক মানুষ দূরের কথা অনেক শিক্ষিত মানুষ ‘কোয়ারেন্টাইন’ কি জিনিস বুঝে উঠতে পারে নাই।
আমি অবাক হয়েছি আমাদের জাতীয় গণমাধ্যমগুলো যারা বাজেটের মতো জটিল বিষয়কে জলের মত সহজ করে উপস্থাপন করে, তারাও ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ বা ‘সেলফ কোয়ারেন্টাইন’ এর মত শব্দ হুবহু আওড়াতে শুরু করেছে। একটু বসে চিন্তা করার সময় আমাদের কারোর হাতে নেই, না সরকারের, না মিডিয়ার ! সবচাইতে বেশী অস্থিরতা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একটু ভেবে দেখুন, একজন প্রান্তিক মানুষ ‘কোয়ারেন্টাইন’ এর অর্থ দূরে থাক, এটি সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারবে না।
অনেকে গুগুল ঘেঁটে কোয়ারেন্টাইন এর অর্থ বের করেছে ‘সঙ্গনিরোধ’, অনেকটা চেয়ারের বাংলা ‘কেদারা’ শব্দের মত। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিলে যায় ‘কোয়ারেন্টাইন’ এর জন্য সমার্থক শব্দ কি ছিল না ? আমরা কি সচরাচর ‘এক ঘরে করে রাখা’ বা ‘ধরাছোঁয়ায় বাহিরে রাখা’, জনবিচ্ছিন্ন থাকা অথবা ‘নিরাপদ বেষ্টনীতে থাকা’ এধরনের শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করি না, তাহলে ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দকে এত বেশি প্রচার করে করে আমাদের কি লাভ হলো ?
এরপর আসেন লক ডাউন বা শাট ডাউন করার মত শব্দের অতি ব্যবহার করা। আমরা কেন আশা করছি মিডল ইস্ট ফেরত একজন শ্রমিক লক ডাউন বা শাটডাউন বুঝবে ? অথচ আমাদের দেশে প্রচলিত জরুরী অবস্থা, চলাচলের উপর নিষেদ্ধাজ্ঞা জারি করা বা বন্ধ করে দেয়ার মত শব্দ দিয়ে একই অর্থ বোঝাতে পারি। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম, সরকার ও সকল পক্ষকে সচেতন হওয়া অত্যন্ত্য জরুরী।
এ কথা আমাদের বুঝতে হবে, ২০০৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত বর্তমান সরকারের পক্ষে কোনো ধরনের বৃহৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করতে হয়নি। সরকার ও প্রশাসন বেশী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলার। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে করোনার মতো সংকট মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়বে। অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলেও সরকারের ও প্রশাসনের সেই যোগ্যতা নিশ্চয়ই আছে, প্রয়োজন সকল পক্ষকে সাথে নিয়ে সংকট মোকাবেলা করা। সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে তার তথ্য আদান প্রদানের কাঠামো ও সঠিক তথ্য সহজ ভাষায় প্রান্তিক জনগণের কাছে পোঁছে দেয়ার দিকে।
আমাদের দুর্বল অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থার বিপরীতে জনগণকে সচেতন করার দিকে জোর দিতে হবে, সঠিক তথ্য দিয়ে, প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে, যাতে করে আমরা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)