বাংলাদেশে একটার পর একটা ভালো সিনেমা হয় না। মাঝে মাঝে কিছু সিনেমার নাম শোনা যায়। দুই একটা সিনেমা নিয়ে হয়ত হৈ চৈ হয়। নিস্তরঙ্গ সিনেমা শিল্পে সেসব সাময়িক কিছু ঘাইয়ের মতো। সরকারিভাবে চলচ্চিত্রকে এ দেশে শিল্প ঘোষণা করা হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। কিন্তু শিল্পের অনেক কিছুই নেই আমাদের। এমনকি সিনেমা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, ক্রিটিকটাও তৈরি হয়নি। সিনেমাকে দেখা ও বুঝানোর যে ভাষা তাও তৈরি হয়নি বলতে গেলে। এদের মাঝে ব্যতিক্রম ফাহমিদুল হক।
ঢাকাকেন্দ্রীক বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে তিনি পরিচিত নাম। সিনেমা নিয়ে তার নিষ্ঠার কথাও সবাই জানেন। হাল আমলের চিন্তা-চর্চায়ও তিনি স্বীয় ভূমিকা টিকিয়ে রেখেছেন। নতুন বই ‘চলচ্চিত্রপাঠ’ ফাহমিদুল হকের আরেকটি স্বকীয়তাকে তুলে ধরছে। তা হলো সহজ ভাষায়, অল্প কথায় বুঝিয়ে বলতে পারা। তত্ত্ব অথবা তথ্যের ভারে তিনি জবরজং করে তোলেননি বাংলাদেশি সিনেমার অবয়বটাকে। আবার তত্ত্ব আর তথ্য রেখেও দেননি। সিনেমার আঙ্গিক, বিষয়বস্তু, তাত্ত্বিক ও দার্শনিকভাবে সিনেমাকে এত অল্পে আর এত সহজে আর কোনো বইয়ে সহসা পাওয়া যাচ্ছে না, এটা হলফ করে বলা যায়।
ফাহমিদুল হকের চলচ্চিত্র পাঠ বইটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য এটি বিদ্যায়তনিক পরিসরে যেমন তেমনি সিনেমার দর্শক, বোদ্ধা, অপরাপর শিল্পমাধ্যমে সংশ্লিষ্টদেরও খোরাক যোগাবে। বইটিতে তার গবেষণা কর্মের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে লেখা সিনেমা আলোচনা, রিভিউকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের আর বিষয়ের লেখা হলেও সামঞ্জস্যটা নষ্ট হয়নি। একটানা পড়ে ফেলা যায়। পড়ার পর মনেও থাকে। অবয়বটা পাওয়া যায় শুরু থেকে এ পর্যন্ত সিনেমার কী হালহকিকত তার।
ফাহমিদুল হক বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে গবেষণার সময়কে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। একেবারে তলার দিকটি ষাট ও সত্তরের দশক। যা আশির দশক বলে তিনি জানাচ্ছেন, দ্বিতীয়টি শূন্য দশক আর তৃতীয় ভাগটি তিনি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরের গবেষণাগ্রন্থকে নিয়ে। তার আলোচনায় তথ্য আকারে বিভিন্ন সময়ে গ্রন্থিত গবেষণার খবর যেমন রয়েছে। তেমনি প্রবণতা, মানসিকতা এবং গভীরতাও অনুমান করা যায়। আর এ কাজে ফাহমিদুল সৎ অর্থাৎ নিজেকে ইগো নিরপেক্ষ রাখেন। ফলে নগদ লাভ হয় পাঠকের। তিনি নিজেও গবেষণা করছেন, বই করছেন কিন্তু ইতিহাসে যার যা অবদান অথবা স্বীকৃতি যতটুকু প্রাপ্য তিনি তা দিচ্ছেন। এই স্বভাব তার বইয়ের গুরুত্বকেই বাড়িয়েছে।
ফাহমিদুলের মতে জাকির হোসেন রাজু বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি সিনেমা তাত্ত্বিক। তার পিএইচডি গবেষণাভিত্তিক বই বাংলাদেশ সিনেমা অ্যান্ড ন্যাশনাল আইডেন্টিটি: ইন সার্চ অফ দ্য মডার্ন প্রকাশিত হয়েছে শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা রাউটলেজ থেকে। পশ্চিমের সিনে-তাত্ত্বিকতায় রাজু পরিচিত ও আলোচিত নাম। ফাহমিদুল নিজেও রাজুর উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন বেশ কয়েকবার। বইটি আমার পড়া না থাকলেও ফাহমিদুলের বরাতে যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে রাজুর কাজটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এটি পাঠে বাংলাদেশের মনন ও বিবর্তনের একটি রূপরেখা পাওয়া যাবে। চলচ্চিত্র পাঠ বইটির গুরুত্ব এখানে যে তা অন্যদের খবর, মেধার পরিমাপ সম্পর্কে ধারণা দেয়। বাংলাদেশে মেধাবী পরিচালকদের যে অভাব রয়েছে তা জানাতেও এ লেখক অকপট।
ফাহমিদুল হক সিনেমার আলোচনা বলতে কি বুঝান তা দিয়েই শুরু করেছেন বইটি। তিনি দৃষ্টিভঙ্গিটাকে আগে ঠিকঠাক করে রেখেছেন। যা পাঠকের দৃষ্টিকে নির্দিষ্ট করে দিবে না বরং প্রসারিত করবে। সিনেমাকে ফাহমিদুল সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ বলছেন। যা সর্বকনিষ্ঠ শিল্পমাধ্যম হলেও সর্বব্যাপী। সাম্প্রতিক সময়ের মেহেরজান, মনের মানুষ, মোস্ট ওয়েলকাম নামের তিনিটি সিনেমার দর্শক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছেন সিনেমা সমাজে কতরকমের প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক গুরুত্ব কোনো সিনেমাকে যেমন অনেক উপরে তুলে নিতে পারে, তেমনি বে-খেয়ালে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমাও অনালোচিত থেকে যায়। আবার সমাজে উঁচুনিচু শ্রেণি বৈষম্য, সাংস্কৃতিক উচ্চমন্যতা, বিশুদ্ধ ইংরেজি প্রীতি থেকেও সিনেমার মুক্তি যে নেই তা গ্রন্থিত করেছেন ফাহমিদুল।
তিনি বলছেন চলচ্চিত্রপাঠ মানে সব কিছুকে পাঠ। সব শিল্পমাধ্যমের পাঠ তো বটেই। এমনকী সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসকেও পাঠ। এ ছাড়া চলচ্চিত্রপাঠ অসম্পূর্ণ থাকবে। তিনি নিজেও সেই পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা বলা বাহুল্য। বাংলাদেশে বিবাদমান যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি অবস্থান করছে। তার স্বপক্ষে, বিপক্ষে অথবা তার প্রতি সমালোচনামূলক সিনেমা এবং তার পরিচালকদের বিষয়ে লিখেছেন ফাহমিদুল। যেমন এখানকার সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের যে অবস্থান তা কীভাবে উঠে এসেছে সিনেমায় তার উল্লেখ আছে এই বইয়ে। কোন কোন পরিচালক ইসলামকে বাঙালী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বিরোধাত্মক বলে দেখিয়েছেন তা সিনেমা ধরে ধরে আলোচনা করেছেন তিনি। এর ব্যতিক্রমটাও আছে। দাড়ি, টুপি যে রাজাকারের সমার্থক নয়, তাদের মধ্যেও যে মানবিকতা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ঘটনা আছে তা কিছুটা হলেও উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমায়। তবে এই দ্বন্দ্ব যে বড় এবং এর প্রতিক্রয়া যে ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের সে বিষয়টিও তিনি আড়াল করেননি। একই ধরনের রাজাকার আর মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার কাহিনী কতটা বিরক্তিকর তা ফাহমিদুল ঠিক ভাবে দেখিয়েছেন।
ভারতীয় সিনেমা আমদানির বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। দেখিয়েছেন পাকিস্তান কীভাবে প্রথমে ভারতীয় সিনেমা আমদানির নামে দেশজুড়ে একের পর এক হল নির্মাণ করেছে। পরে তাদের সিনেমাও যখন সেসব হলে মুক্তি পেয়েছে, লাভবান হয়েছে এতে শিল্পও বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশেও এমনটা হওয়া সম্ভব। এখানে ভারতীয় সিনেমার মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। তবে তার আগে নিজেদের আরো পোক্ত করার পরামর্শ তার।
পশ্চিমের বাইরে কীভাবে নির্মিত হতে পারে বাংলাদেশীয় বা পূর্ববঙ্গীয় সিনেমা তার একটি রেসিপিও ফাহমিদুলের আছে। তিনি ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, পশ্চিমা প্রযুক্তির সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় যে আঙ্গিক তার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সম্ভব প্রাচ্যরীতির সিনেমা ভাষ্য তৈরি করা। যা জনপ্রিয়ও হবে। জনপ্রিয় রূপবান, বেদের মেয়ে জোছনা, মণপুরা এবং সাম্প্রতিক আয়নবাজী নিয়েও আলোচনা আছে তার বইয়ে। আমাদের সময়ের আলোচিত সিনেমা এবং তার ধরণ-ধারন ও প্রবণতা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। কেন সাপ বাংলা সিনেমায় এত জনপ্রিয় এবং সাপ নিয়ে কেনইবা এত সিনেমা তৈরি হয়েছে তার ব্যাখ্যাও করেছেন ফাহমিদুল।
এত স্বল্প পরিসরে এত বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা, পরামর্শ যে পাওয়া যাবে তা বইটি পড়তে শুরু না করলে বুঝা যাবে না। বাংলাদেশের সিনেমার হাল অবস্থা জানতেই কেবল নয় বরং কোথায় আমরা যেতে চাই এবং কীভাবে যেতে পারব তার ব্যবস্থাপত্রও দিয়ে রেখেছেন ফাহমিদুল। নিঃসন্দেহে এগুলো মোক্ষম দাওয়াই। এসব দাওয়াই মেনে চলার যোগ্যতা, মেধা আমাদের আছে কিনা তা সময় বলে দেবে। তবে ফাহমিদুল হকের চলচ্চিত্র পাঠ থেকে যাবে দীর্ঘ সময়। যারা সিনেমা চর্চা করতে চান, সিনেমার শিল্পী হতে চান তাদের জন্য প্রয়োজন এই বই। যারা সাম্প্রতিক সিনেমার খোঁজখবর করতে চান তারাও বইটির খোঁজ করুন, উপকার পাবেন।
চলচ্চিত্র পাঠ
ফাহমিদুল হক
প্রকাশক: আদর্শ
মূল্য: ৩০০ টাকা
সৌজন্যে: বইনিউজ