চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বসন্ত উৎসবে ‘জেনে না জেনে’ মেতেছে রাজধানীবাসী

রমনা পার্কে বৃহস্পতিবার মধ্য দুপুরে বর্ণিল সাজে বেশ কয়েকজন গৃহিনী বাচ্চাদের নিয়ে অনেকটা বনভোজনের মতো আয়োজনে মেতে উঠেন। ঘাসের ওপর মাদুর বিছিয়ে নিজেরা যেমন কথার ঝাপি খুলে বসেছেন, তেমনই বাচ্চারাও খেলার বড় জায়গা পেয়ে ফুটবল নিয়ে খেলছে।

প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে ভুল দিনে বসন্ত পালনের কারণ জানতে চাইলে তানজীমা নামের এক গৃহিনী বললেন, ‘আমরা প্ল্যান করেই এসেছি। এখানে আমরা সবাই গৃহিনী। শুক্রবারে পরিবারের অনেক ঝামেলা থাকে। তাই আজই আমরা পহেলা ফাগুন পালন করছি। যদিও জানি পহেলা ফাগুন আগামীকাল। তবে একই দিনে ভালবাসা দিবস ও পহেলা ফাগুন হওয়ায় অনেক যানজট থাকবে। তাই নির্বিঘ্নে ফাগুন কাটাতে এই আয়োজন।’

পুরনো বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বসন্তের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা ফাল্গুন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের পর এক দিন পিছিয়েছে বসন্ত। বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের কাজ করেছে বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ।

তারা জানিয়েছে, সংশোধিত বর্ষপঞ্জিতে বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাস ৩১ দিন, কার্তিক থেকে মাঘ মাস ৩০ দিন এবং ফাল্গুন মাস ২৯ দিন ধরে গণনা করা হবে। তবে গ্রেগরীয় পঞ্জিকার অধিবর্ষে (লিপ ইয়ার) ফাল্গুন মাস ২৯ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিন গণনা করা হবে।

রমনা পার্ক কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে আসা অনেকেই জানেন না আজ বসন্তের প্রথম দিন নয়।

উত্তরার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. সারোয়ার হোসেন তার প্রেয়সীকে নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কথা প্রসঙ্গে বসন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, গত বছরও এই দিনে ফাগুন পালন করেছি, তাই আজ এই দিনে বের হয়েছি। রাস্তায় অনেককেই দেখেছি ফাগুনের পোশাকে।

বসন্ত নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকেই লিখেছেন গান, কবিতা, তবে সত্যি বলতে বসন্ত নিয়ে বর্তমান সময়ে খুব একটা রচিত হয়নি গান-কবিতার পঙ্ক্তিমালা। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত নিয়ে অনেক গান-কবিতা লিখেছেন। তার মায়ার খেলা গীতিনাট্যে….
‘আহা আজি এই বসন্তে,
এতো ফুল ফোঁটে,
এতো বাঁশি বাজে এতো পাখি গায়।’

কবিগুরু ছাড়া যেমন বসন্ত অসম্পূর্ণ, তেমনই প্রেমের কবি নজরুলও বসন্তকে তুলে এনেছেন কবিতা ও গানে। কাজী নজরুল ইসলাম বসন্ত নিয়ে লিখেছেন একটি গানে-
‘বসন্ত আজ আসলো ধরায়,
ফুল ফুটেছে বনে বনে,
শীতের হাওয়া পালিয়ে বেড়ায় ফাল্গুনী মোর মন বনে।’

ভালোবাসা দিবসে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকছে ক্লাসটেস্ট। ধানমন্ডির একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পিনাক চক্রবর্তী জানালেন কাল ভার্সিটিতে পরীক্ষা। তাই আজ পহেলা ফাগুন পালন করতে বন্ধুদের সঙ্গে রমনা পার্কে আসা।

নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থী জাসিয়া তাহসিনা জানালেন, জেনেশুনেই আজ বসন্তের প্রথম দিন না হলেও তিনি পালন করছেন। মূলত বন্ধুরা মিলে বই মেলায় এসেছেন। এরমধ্যে সবাই মিলে রমনা পার্কে ঘুরতে এসেছেন।

জাসিয়ার বন্ধু মো. আবির জানালেন, ১৩ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি আমাদের মধ্যে গেঁথে গেছে। লিপ ইয়ার জটিলতার কারণে এই বছর পহেলা ফাগুন একদিন পিছিয়ে গেলেও আবার আগামি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারিতে ফাগুন আসবে।

অন্যদিকে বসন্তের প্রথমদিন ও ভালোবাসা দিবস এক দিনে পড়ায় শাহবাগের ফুলের দোকানীদের মধ্যে চওড়া হাসি লক্ষ্য করা যায়। কারণ এ সময় সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয়।

শাহবাগের মুক্তা পুষ্প বিতানের স্বত্তাধিকারী আব্দুস সবুর বলেন, একই দিনে দুটো উৎসব পড়ায় আমরা ফুলের ব্যবসায়ীরা সার্বিকভাবে প্রস্তুত রয়েছি। যেহেতু মূল উৎসব কাল তাই আজ থেকেই শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা ফুলের দোকানে ফুল কিনতে আসছেন।ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক কাল বসন্ত
গাছের পাতা ঝরতে শুরু করেছে আরও কয়েকদিন আগেই। ইট-পাথরের রাজধানীতেও শোনা যাচ্ছিল কোকিলের কুহুতান। আর শীতের খোলস পাল্টে প্রকৃতি তার রূপ বদলাতে শুরু করেছে তারও আগে। কাল বসন্তের প্রথম দিন। অমর একুশে গ্রন্থমেলায়ও এর দোলা লাগবে। মেলায় থাকবে বাসন্তী রঙের উৎসব। তরুণীরা এ রংয়ের পোশাক আর গাঁদা ফুলে নিজেদের সাজিয়ে মেলায় আসবেন। তরুণরা পরবেন বাসন্তী রংয়ের পাঞ্জাবি-ফতুয়া।

বসন্ত মানেই নতুন সাজে প্রকৃতি মুখরিত হওয়ার দিন। ফুল ফোটার পুলকিত সময়। শীতের জরাগ্রস্ততা কাটিয়ে নতুন পাতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠবে রুক্ষ প্রকৃতি। ফাগুনের ঝিরঝিরে বাতাস আর কোকিলের মিষ্টি কলতানে উন্মাতাল হবে প্রকৃতি। ফুলেল বসন্ত যৌবনের উদ্দামতা বয়ে আনে। আনন্দ আর উচ্ছ্বাস মুখরতায় মন-প্রাণ ভরিয়ে তোলে।

বসন্ত মানেই পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। কাল অমর একুশে গ্রন্থমেলার শিশুপ্রহরে গেলেই টের পাবেন উচ্ছ্বস; কচিপাতায় আলোর নাচনের মতোই। শাহবাগ, টিএসসি, রমনা, ধানমণ্ডিলেকের চত্বর এদিন বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পরা নারী ও বিভিন্ন রংয়ের ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে। ফাগুনের প্রথম দিনে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে পথে নামবে তন্বী-তরুণীরা।

মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম এবং উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তাই পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব কেবল উৎসবে মেতে ওঠার সময় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাঙালিসত্তা। সে ঐতিহ্যের ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারলেই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে পারবে বাঙালি চেতনাকে।

বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এ উৎসব আয়োজন করে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বকুলতলায় হবে বসন্ত বন্দনা উৎসব।

এছাড়া উৎসব চলবে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চ ও উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চে। সকালে বসন্ত শোভাযাত্রা বের করা হবে। শুধু ঢাকা নয় দেশজুড়েই ফাল্গুনী হাওয়া মাতাল করে যায় আপমর বাঙালিকে। মুঠোফোন, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলবে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়।

পাতার আড়ালে লুকনো কোকিলের কুহু ডাক ব্যাকুল করবে অনেক বিরহী অন্তর। কবি তাই বলেছেন, ‘সে কি আমায় নেবে চিনে/ এই নব ফাল্গুনের দিনে…’।