দেশে চলছে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি। প্রতিবাদ-সমালোচনা যে একেবারে নেই, তা নয়। কিন্তু তার পরও আছে ভয়। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ‘বিরুদ্ধমত দমন’ ও ‘শক্তিপ্রয়োগের নীতির’ কারণে এই ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই ভয় একপাক্ষিক নয়, যারা ভয় পাচ্ছেন আর যারা ভয় দেখাচ্ছেন, তাদের উভয়ের মধ্যেই রয়েছে একটা সংশয় আর উদ্বেগ। মনে জাগছে নানা দার্শনিক প্রশ্ন—আমাদের বেঁচে থাকা কি কেবলই ভয় আর আশঙ্কার সমষ্টি? আরও ব্যাপকভাবে ভাবলে, সভ্যতা সৃষ্টির মূলে কি ভয়? আর সেই ভয় থেকে আত্মরক্ষার তাগিদেই কি ভয় সৃষ্টি করা হচ্ছে?
হয়তো তাই। মানুষ একসময় ভয় পেতো প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপকে। সেই ভয়ঙ্কর রূপ থেকে বাঁচার তাগিদে আশ্রয় নিয়েছিল গুহায়। মানুষ ভয় পেতো অন্ধকারকে। সেই অন্ধকারের হাত থেকে বাঁচার তাগিদে আবিষ্কার করলো আগুন। মানুষ ভয় পেতো অন্য গোষ্ঠীর মানুষকে। তাই বাঁচার তাগিদে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে শিখলো। মানুষ সব থেকে বেশি ভয় পেতো মৃত্যুকে। মৃত্যু তার কাছে ছিল রহস্যময়। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইতো না, মৃত্যুতেই জীবনের শেষ। তার সব কিছুতেই ভয়। ভূমিকম্পের ভয়, বন্যার ভয়, ঝড়-বৃষ্টির ভয়, অসুখের ভয়, জীবনহানির ভয়। ভয়ের দ্বারাই মানুষ চিরকাল তাড়িত।
আমরা চাই আশ্রয়। আমরা চাই এমন একজনকে, যে আমাদের রক্ষা করবে, যে আমাদের সমস্ত ভয় থেকে মুক্তি দেবে। তাই আমাদের মধ্যে ভয় যেমন আছে, তেমনি ভয়কে অতিক্রম করার চেষ্টাও আছে। আর তা আছে বলেই মানবসভ্যতা আজ এখানে এসে পৌঁছেছে। নইলে আমরা ভীতু হয়ে আদি যুগে পড়ে থাকতাম। আজ যে সারা পৃথিবীজুড়ে এত ঘরবাড়ি, এত রাস্তাঘাট, এত যানবাহন, এত যন্ত্রপাতি, এত অস্ত্রশস্ত্র—এসব কিসের জন্য?
সবই হয়েছে ভয় থেকে বাঁচার তাগিদে। মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষ। মানুষ আজ সব থেকে ভয় পায় মানুষকে। শুনেছি সাপ খুব ভীতু। সাপ ভয় পেয়েই মানুষকে কামড়ায়। আমরা অনেকটা সাপের মতো। অমুক দেশ আমাকে আক্রমণ করতে পারে। অতএব অমুক দেশকে শায়েস্তা করো। কীভাবে করবো? আমাদের গায়ে শক্তি নেই। আমরা দুর্বল। সেই কারণেই তৈরি হলো অস্ত্র। এখন আর আদিযুগের অস্ত্র নেই। ছুরি, তরবারির যুগ পেরিয়ে অ্যাটম বোমার যুগে এসেছি। এখন তৈরি হয়েছে আবার নানা ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র। যা নাকি মুহূর্তের মধ্যে নিঃশব্দে বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। এর উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য একটাই। শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করো। কারণ শত্রুকে নিশ্চিহ্ন না করতে পারলে আমি নির্ভয়ে শান্তিতে থাকতে পারবো না।
উল্লেখ্য, নাইন ইলেভেনে টুইন টাওয়ারে সংঘটিত হামলার ঘটনা আমাদের মধ্যে এক নতুন বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। এই ঘটনা পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের ঘরের চৌকাঠে যে মৃত্যুহানা এসে পৌঁছতে পারে যে কোনও মুহূর্তে, সেই কথাটা প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। মৃত্যু যে এক তুড়িতে জীবনকে হারিয়ে দেয়, সেই চরমতম কথাটা দর্শন বা অধ্যাত্মতত্ত্বে আটকে না রেখে রোজকার ভাত খাওয়া দাঁত মাজার প্রাত্যহিকতায় নিয়ে আসার জন্য। আগেও সন্ত্রাস ছিল, বোমা-বিস্ফোরণের তাণ্ডব দেখা যেত, কিন্তু সংখ্যা বা ব্যাপকতা বা পদ্ধতির নতুনত্বের দিক দিয়ে তাকে অনেকটা পাল্টে দিয়েছে ৯/১১। যে সন্ত্রাস সীমায়িত ছিল বিশিষ্ট কিছু ভূগোলে, দশ বছরে সে ভূগোল তছনছ হয়ে পৃথিবীটা সমান, এক হয়ে গিয়েছে। এ আর এক বিশ্বায়ন। ভয়ের বিশ্বায়ন। সর্বব্যাপী ভয়, সর্বগ্রাসী ভয়।
এই ভয় তৈরি করে দিয়ে জয়ী হয়েছে সন্ত্রাস। আর আমরা? পরাজিত। যত বার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস/ তত বার হয়েছে অনর্থ পরাজয় রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই সেই পরাজয় রোধ করার কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমরা কিন্তু বুঝেছি, অন্তত এ ক্ষেত্রে পরাজয় রোধ করার চেষ্টা অসম্ভব, তাই তাকে মেনে নেওয়াই ভালো। আমরা মেনে নিয়েছি। ভয় থেকে জন্মায় ক্রোধ। আর ক্রোধ থেকে জন্মায় যুদ্ধের স্পৃহা। অথচ আমরা ভেবে দেখি না, যুদ্ধ আমাদের দুই পক্ষকেই ধ্বংস করে। কারণ যুদ্ধে যে জয়ী হয়, সে যুদ্ধের পরে এমনই বিপর্যস্ত হয় যে, তা এক রকম পরাজয়। এই যে দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধ হলো, তাতে লাভ হলো কার? কে হলো সমৃদ্ধ? কেউ হয়নি। তবে এই যুদ্ধের দৌলতে যানবাহনের উন্নতি হয়েছে, অস্ত্রশস্ত্রের উন্নতি হয়েছে। মানুষ ধ্বংস করার কাজ অনেক সহজ হয়েছে। এখন ঘরে বসেই অন্য দেশের বুকে বোমা ফেলে আসতে পারি। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। এর মূলে কি বিজ্ঞানের উন্নতি? নাকি ভয়? অবশ্যই ভয়। ভয় থেকেই আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে মরতে চাই না। তাই ঘরে বসে আমরা শত্রুদের ধ্বংস করতে চাই। আগে যুদ্ধ ছিল, বীরত্বও ছিল। এখন যুদ্ধ আছে, বীরত্ব নেই।
বর্তমানে আমরা বিজ্ঞানকে ভয় পাই। ভক্তি করি। বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে পারি না। আজ যে আমরা সুখে জীবনযাপন করছি, সে তো বিজ্ঞানের কল্যাণেই। তবে কখন যে বিজ্ঞানের মারমুখী চেহারা দেখবো, তা বলতে পারছি না। বিজ্ঞান ছাড়া আর একটি বস্তুকে আমরা ইদানীং খুব ভয় পাচ্ছি। সে বস্তুটি হলো রাজনীতি। আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষ। সব মানুষই চায় ক্ষমতা। কেন চায় ক্ষমতা? ক্ষমতা চায় সেই ভয় থেকে। কারণ, হাতে ক্ষমতা থাকলে আমার ভয় কমবে। আমার পাশে থাকবে দল, থাকবে প্রশাসন। থাকবে পুলিশ। আমি শান্তিতে বাঁচতে পারবো। কিন্তু শান্তিতে বাঁচা রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে সহজ নয়। কারণ দল ও পক্ষ তো একটি নয়। একাধিক। সব দলই ক্ষমতায় বসতে চায়। ফলে এক দল আর এক দলকে উৎখাত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তার জন্যে মারামারি কাটাকাটি।
সুতরাং, নেতারাও অশান্তিতে ভয়ে ভয়ে দিন কাটান। ক্ষমতায় বসে সবসময় উৎখাতের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। আর আমাদের অবস্থা হয় করুণ। কথায় বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। আমরা হচ্ছি উলুখাগড়া। দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যখন মারামারি হয়, আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি।
কারণ মারামারি তো হাত দিয়ে হয় না, হয় বোমায়, পিস্তলে, অগ্নিসংযোগে। আমরা ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাই। কিন্তু কোথায় পালাবো? কে আমাদের আশ্রয় দেবে? ঈশ্বর? বিজ্ঞান? না, এরা কেউই আশ্রয় দিতে পারবে না। আমাদের আশ্রয় দেবেন নেতারা। মহামানবদের মতো তাদেরও একটাই কথা। তারা বলবেন–তোমরা আমাকে ভজনা করো। যদি নিষ্ঠাভরে ভজনা করো, তাহলে তোমাদের অর্থ হবে, বাড়ি হবে, গাড়ি হবে। আর যদি না করো, তাহলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য। আমরা দুর্বল অসহায় মানুষ। আমরা তাই যুগ যুগ ধরে ভয়ে ভয়ে থাকি। ভয় থেকে আমাদের কি মুক্তি নেই?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)