চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা; বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ

এদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি স্বাধীনতা প্রিয় জাতি। মুক্ত বিহঙ্গের মত জীবনযাপনে অভ্যস্ত বাঙ্গালী কখনও কারো অধীনে থাকেনি। বাঙ্গালী আর স্বাধীনতা-এ যেন একে ওপরের পরিপূরক। হাজার বছরের বাঙালরি এই স্বপ্ন-পুরান কে স্বার্থক করে করে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।  সঙ্গত কারণে তাই  বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা স্বাধীনতার সঙ্গে তাঁর নামটি শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও একই মতামত পোষণ করেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয় লগ্নেরও বহু আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর একান্ত স্বপ্নের কথা সাহসের সঙ্গে, আস্থার সঙ্গে,  বিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মনীষী ও সাহিত্যিক শ্রী অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ছিল। ছিল হৃদ্যতাও। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। “শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি,  ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ ‘শুনবেন?’ বলে তিনি (বঙ্গবন্ধু) মুচকি হেসে বলেন, সেটা ১৯৪৭ সাল। তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কি না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত।

বলতে বলতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। তারপর বিমর্ষ হয়ে বলেন, ‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাদের প্রস্তাবে। তারা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি যে আর কোনো উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই। কিন্তু আমার সূত্র কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হবার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। লোকগুলি যা কমিউনাল! বাংলাদেশ চাই বললে সন্দেহ করতে। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে।

ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকাদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে পাক-বাংলা। কেউ বলে পূর্ণ বাংলা। আমি বলি, না বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দিই, জয় বাংলা। …আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারে নাই। জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলুম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয়। যা সম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে।”

বাংলাদেশের লাল-সবুজের পাতাকায় চিরভাস্বর হয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু জাতির জনক শেখ মজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আমাদের স্বাক্ষ্য দেয় এই মহামানবের জন্ম না হলে দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি নিশ্চিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে পুরো জাতি যার যার কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্র“র বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে ঘোষণা করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার-জুলুম আরও বাড়িয়ে দিল। দিন দিন এ অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেননি কখনই। বাঙালি অন্তঃপ্রাণ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সবসময়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বললেন, ‘বাঙালিদের ওপর যদি এভাবে শোষণ-নির্যাতন চলতে থাকে তাহলে বাংলার তরুণেরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করলে আমাকে ও আমার দল আওয়ামী লীগকে আপনারা দোষ দিতে পারবেন না।’

ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ছেষট্টির ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের হাত ধীরে স্বাধীনতার যুদ্ধ-সবকিছুর নেপথ্যে বঙ্গবন্ধুর সুনিপুণ দক্ষতা, কৌশলী নেতৃত্ব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। তারা একাত্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বজ্র বাণীতে।  বাংলার মানুষের মধ্যে মুক্তির স্বপ্ন, স্বাধীনতার বীজমন্ত্র প্রোথিত  করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর নখদর্পণে। সত্য, ন্যায় থেকে তাঁকে দমিয়ে রাখা অসম্ভব ব্যাপার ছিল।

ঐতিহাসিকভাবে একথা আজ স্বীকৃত যে ছয় দফাই ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ছয় দফা সম্পর্কে আইয়ুব খান তার ডাইরিতে লিখেছেন, ‘৬ দফা ছিল একটি পিন ছাড়া গ্রেনেড। এটা বিস্ফোরিত হলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। শেখ মুজিব তাই চায়।’ আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়। ফাঁসির দড়িকে ভয় পাননি তিনি। বঙ্গবন্ধু জানতেন ৬ দফার হাত ধরেই মানুষ তাদের স্বাধীনতা পাবে।

৬ দফা পাকিস্তানী শাসকদের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় আসে ৬৯ এর গণ অভ্যুথ্থান। গণঅভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে বীরের বেশে বেরিয়ে এলেন। সে সময় ছাত্র নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ৬ দফার পরে কী? বঙ্গবন্ধু ছাত্র নেতাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন,  ‘৬ দফা না মানলে ১ দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা।’

ছয় দফার গুরুত্ব সম্পর্কে একজন প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উল্লেখ করেছেন। The Six-Point Movement started by Awami League in 1966 though short lived, marked a significant radicali“ation of Bengali politics and played a crucial role in shaping later political movements. The movements were a departure from East Pakistani political movements is both its program and its tacticsP. (Raunaq Jahan, Pakistan , Failure in National Integration, UPL 2nd Edition, 2001, p.167)

ছয় দফা ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের বাঁচার দাবি। এভাবেই তিনি অচিরেই ‘ক্যারিশমেটিক লিডার’ এ পরিণত হন। পরবর্তীতে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয় এদেশের গণমানুষের অভাবনীয় বিজয়সহ প্রত্যেক আন্দোলন-সংগ্রামে জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় রাজনীতির শিক্ষক। দূরদর্শী রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন জাতি হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়তে হবে বাঙালিকে। একইসঙ্গে তিনি জানতেন অধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাই বাঙালির সর্বাগ্রে প্রয়োজন।

স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু আগে থেকে এর প্রেক্ষিত তৈরি হচ্ছিল যার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু সফলভাবে জড়িয়ে ছিলেন। একাত্তরের মার্চের উত্থাল দিনগুলোতে পুরো জাতি তাঁর কথামতো চলেছে। বাঙালি সেদিন উর্দি পরা সামরিক সরকারের কোনো নির্দেশ শোনেনি। শেখ মুজিব ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, বাংলার মানুষ তা মাথা পেতে মেনে নিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীনতা এক অভিন্ন নাম। স্বাধীনতা বাঙালির রক্তঝরা এক ইতিহাস ও বাঙালির স্বাধীনতা ইতিহাসের এক মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের মহানায়কের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস যতদিন থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অম্লান থাকবেন। পৃথিবীর ইতিহাসে, স্বাধীনতার ইতিহাসে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বঙ্গবন্ধু নাম উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধার সঙ্গে। ভালবাসার সঙ্গে। বাঙালি যতদিন বেঁচে থাকবে, বাংলা ভাষা পৃথিবীতে যতদিন উচ্চারিত হবে বঙ্গবন্ধুর নামও ততদিন ধন্য ধন্য বলে ধ্বণিত হবে।

 (এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)