এবারই প্রথম আন্তর্জাতিক বই দিবস মানুষের মনে বেশ জায়গা পেয়েছে। অনেকেই ফেসবুকে তার বইয়ের জগত তুলে ধরেছেন। বইয়ের উপযোগিতা আর বইয়ের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে নানা কথা বলেছেন। বই সংগ্রহসাধ্য, বইপ্রেম, আর পাঠের গভীরতা নিয়েও কথা হচ্ছে। এগুলো নতুন নতুন উদঘাটন। আগে মানুষের এসব নিজস্বতা জানার তেমন সুযোগ ছিল না। সামাজিক মাধ্যম মানুষের মনোযোগাযোগ ও বন্ধনের জায়গাটি বিস্তার ঘটিয়েছে। এই গৃহরুদ্ধ সময়ে মানুষ নতুন করে তার আশ্রয়স্থল হিসেবে বইকে খুঁজে পাচ্ছে।
দিন দশেক আগে আমাদের প্রাণের বইমেলা শেষ হয়েছে। যারা এই প্রতিকুল সময়েও যারা নিয়মিত বইমেলায় গিয়েছেন তারা এখনও মুক্তপ্রাঙ্গনে সুবিশাল বইমেলার রেশ মনে বয়ে বেড়াচ্ছেন। এবার ফাণ্গুন চৈত্র ছুঁয়েছে বইমেলা। করোনার কারণে ফেব্রয়ারির বইমেলা পিছিয়ে দেয়া হয় মার্চে। সবাই ভেবেছিল বইমেলা ধুলোময় হয়ে উঠবে, গরমে নাভিশ্বাস উঠবে মানুষের, কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে মেলার মাঠের সবকিছু। লেখক প্রকাশকদের হয়রানি হতে হবে বিলম্বের বইমেলাকে ঘিরে। কিন্তু এমন ধারণার একটাও ফলেনি। সুন্দরভাবেই পার হয়েছে বইমেলার দিনগুলো। করোনা কঠিন সময়ে কারণে মানুষের তুমুল ভীড় ছিল না। তবে লেখক এসেছেন। পাঠক এসেছেন। মেলা মাঠে যে মিলনমেলা তৈরি হওয়ার কথা ছিল তা হয়েছে। বইমেলা আমাদেরকে যা দিয়ে যায়, তা ঠিকই দিয়ে গেছে। প্রকাশকদের লোকসান হয়েছে, কিন্তু তৃপ্তি এই যে, বই একযোগে পাঠকের সামনে হাজির হতে পেরেছে।
মার্চ মাসে বইমেলা কবুল করার কারণে বাংলা একাডেমিসহ প্রকাশকদের নানা কথা শুনতে হয়েছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগে তাদের এই উদ্যোগকে পাগলামি বলেছেন। কিন্তু তাপরও তারা বইমেলা করেছেন। তৃপ্তির সঙ্গেই বইমেলা সম্পন্ন করেছেন।
এবার করোনার কারণে বইমেলা প্রাঙ্গন ছিল সুপরিসর। মানুষের চলাচলের জন্য বিস্তর জায়গা ছিল। দূরত্ব বজায় রাখার সুযোগ ছিল সবখানে। স্টলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বাঁশের মাচা স্থাপন করা হয়। সেখানে মানুষ আরাম করে বসেছে। বেশ কিছু খাবারের দোকান ছিল মেলার কয়েকটি প্রান্তে। একটি সুপরিসর আধুনিক চায়ের লাউঞ্জ দিয়েছিল ’সিলন’ কোম্পানি। সেটি ছিল মেলার একদিকের শেষপ্রান্তে। সেখানেও ছিল লেখক, পাঠকের বেশ আনাগোনা।
আমার ভালো লেগেছে স্বাধীনতা সরোবরে তরুণীদের পা ডুবিয়ে বসে থাকার বিষয়টি। সারি সারি তরুণী তার নিকটতম বন্ধুটির সঙ্গে বসে এই আনন্দ উপভোগ করেছে। যাদিও স্বাধীনতা সরোবরের পানি খুব বেশি পরিস্কার ছিল বলা যাবে না। কারণ, এখানে তো সেইভাবে ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট’ করা হয় না। কিন্তু বিনোদন ও অবকাশের তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে ছিল মানুষ। বইমেলা তাদের মুক্ত বাতাসে পাখা মেলবার সুযোগ হয়ে এসেছিল। বইমেলা যারা চাননি, তারা বলছিলেন স্কুল কলেজ বন্ধ, এর মাঝে বইমেলার আয়োজন মহা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়, কিন্তু বইমেলার যে শক্তি, তা যাকে টেনে আনার ঠিকই এনেছে। প্রাণ যতটুকু বিকশিত হওয়ার সত্যিই হয়েছে। অবশ্য, বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে, বাইরে থেকে প্রতিবছর কবি লেখক যারা আসেন, তারা আবার আসতে পারেননি। বছরের এই চার্জটুকু গ্রহণ করার সুযোগ তাদের হয়নি।
অসাধারণ সব বইয়ের মেলা হলো এবার। মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মধ্যে বইমেলা। এমন উপলক্ষের সঙ্গে বইমেলা আর কখনো মেলানোর সুযোগ হবে না। বাংলাদেশের বয়স যখন এক’শ বছর হবে তখন আজকের পরিণত মানুষগুলো কি আরে থাকবে? মেলায় শত শত বই বেরিয়েছে আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে। বহু বই বেরিয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নানা দিক নিয়ে। এত এত বইয়ের ভেতর কিছু বই অনেক ভারী, কালোত্তীর্ণ আছে। আমাদের মনন ও চেতনার অপরিহার্য শক্তি জাগানিয়া বই আছে। এবার করোনার মতো বিশ্ব-বিপর্যয় বহু লেখকের চিন্তায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়েছে। গোটা পৃথিবীর সবাই একসঙ্গে বিপর্যস্ত হওয়ার মতো এমন সময় তো আর আাসেনি।
মানুষ বইকে ভালোবাসে। বই শুধু পড়তেই ভালোবাসে না, লিখতেও ভালোবাসে। আমি চ্যানেল আই এর ‘বইমেলা সরাসরি’ উপস্থাপনা করার সুবাদে প্রায় প্রতিদিন বইমেলায় গেছি। এবার বইমেলায় সুপরিসর চায়ের লাউঞ্জে আরাম করে বসে গল্পসল্প করা গেছে।
বইমেলার শুরুর দিকের কথা। মোস্তাফিজ নামের এক তরুণ দুটি বই নিয়ে মেলায় এসেছে। বইদুটি টেলিভিশনের সামনে তুলে ধরার তুমুল আগ্রত তার। বললো, বই বিক্রির টাকায় আমি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় সহায়তা করবো। বললাম, এই বই কয় কপি বিক্রি হবে, কতই বা টাকা আসবে, সেই সহায়তা দিয়ে কতজন শিক্ষার্থী উপকৃত হবে? মোস্তাফিজ খুব বেশি কথা বলে না। হাসি হাসি মুখ নিয়ে চেয়ে থাকে। মোস্তাফিজকে ডেকে চায়ের লাউঞ্জে বসলাম। শুনলাম তার জীবনের গল্প। কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এক গ্রামে তার বাড়ি। ঢাকায় এক ব্যতিক্রমী পেশায় তার জীবনযাপন। বাসা ভাড়া নিয়ে মেস তৈরি করে শিক্ষার্থীদের ভাড়া দেয়। তার ভাড়া করা তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যা আসে তা দিয়ে তার পড়াশোনার খরচ চলে। বাড়িতে টাকা পাঠায়। আবার নানারকম জনসেবাও করে। মোস্তাফিজের বাড়ি কুড়িগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। মাসে মাসে টাকা এনে ঢাকায় পড়াশোনা চালাতে হতো। থাকতো একটি মেসে। একদিন এক বাড়িঅলা তাকে বানিজ্যিক ওই ধারণাটি দেয়। মোস্তাফিজ বাড়ি থেকে ধারদেনা করে শেষবারের মতো পঞ্চাশ হাজার টাকা আনে। তারপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাকে।
এই গল্প শোনার পর মোস্তাফিজের প্রতি আমার রীতিমত শ্রদ্ধা জন্মে গেল। গভীরভাবেই বিশ্বাস করলাম, বই বিক্রি করে মোস্তাফিজ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা করবে। এই কাজটি সে বহুদিন ধরেই করে আসছে।
একদিন বইমেলায় এক ফর্সা প্রবীনের সঙ্গে দেখা। তার নাম প্রেম। আব্দুল খালেক প্রেম। সুনামগঞ্জ থেকে এসেছেন। তার সঙ্গে কথা বলে দারুণ মজা পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল বইমেলা ছাড়া এমন সোনার মানুষের খোঁজ পেতাম না। প্রেম তরুণ বয়সে দুটি বই লিখেছিলেন। একটি বই তার এক প্রেমিকা পড়তে নিয়ে এতটাই মুগ্ধ হয় যে, আর ফেরত দেয়নি। প্রেম জীবনে প্রেম করেছেন দেড় শতাধিক। এ নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সেটি আবার আনন্দআলো বইমেলা প্রতিদিন এ ছাপা হয়েছিল।
এবারই প্রথম বইমেলায় একাকী ঘুরেছি। অন্যান্যবার কোথাও না কোথাও আটকে গিয়ে আড্ডায় মত্ত হয়ে ফিরে আসতাম। এবার তা হয়নি। স্টলে স্টলে গিয়ে নানা বিষয় খোঁজ নিয়েছি। দেখলাম অনেক কিছুরই খোঁজ জানি না। একদিন দেশের বেশ নামকরা তিনটি প্রকাশনীতে জানতে চাইলাম সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে কার বই? তিনটি স্টল থেকেই শীর্ষ যে নামগুলো শুনলাম তার মধ্যে একটি নাম এর আগে শুনিনি। এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে বসে না থেকে সেই লেখকের খোঁজ করলাম। নাম তার অরুণ কুমার বিশ্বাস। ফোন নাম্বার যোগাড় করে ফোনও করলাম। তিনি কাস্টমস বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। ছাত্র্রজীবনে অসামান্য কৃতীত্ব ছিল তার। দেশের বাইরেও উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন। বললেন, ’আমি কষ্ট করে বই লিখি। রাত জেগে বই লিখি। আমার যে বই পাঁচ হাজারের কম চলে, সেই বইকে আমি নিজেই গোনায় ধরি না।’ যে সন্ধ্যায় ফোন করেছিলাম, তখন তিনি জগিং করছিলেন। জগিং এর উপকারিতা নিয়েও কথা বললেন। বললেন, ডাক্তার স্ত্রীর স্বাস্থ্যগত পরামর্শ তিনি মেনে চলার চেষ্টা করেন। বললেন, আপনি আমার বই পড়তে চাইলে পাঠিয়ে দিব। আমি ধন্যবাদ জানালাম।
বই লেখার মধ্যে যে গভীর অভিনিবেশ থাকে, তার সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রচারের উদাসিনতা যোগ হয়ে যায়। আর যারা প্রতিষ্ঠানবিরোধী কিংবা বিবাগি টাইপের লেখক তারা তো বই বের হলে মানুষের হাতে দিতেও লজ্জায় মারা যায়। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একটি বই বেরিয়েছে। স্বভাবলেখক বলে নিজের নামের বদলে একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। বই বেরোনোর পর থেকে তিনি সীমাহীন লজ্জা আর অজানা এক বিড়ম্বনা নিয়ে ছিলেন টানা কয়েকদিন। প্রকাশনীর স্টল থেকে নিজ দায়িত্বে তার বই সংগ্রহ করে পড়েছি। তিনি অনেক ভালো লেখক। কিন্তু কখনো প্রচার চান না।
দুই ধরনের লোকই আছে। প্রচার চাওয়া ও না চাওয়া দুটির মধ্যেই ভালো চিন্তা আছে। অরুণ কুমার বিশ্বাস বই যাতে ব্যাপক বিক্রি হয়, সেই চিন্তা থেকেই লেখেন। এর জন্য তার দেশি বিদেশি বেস্ট সেলার বই অধ্যায়ন, ভেতর বাইরের কারণ অনুসন্ধানসহ নানামুখি তৎপরতা রয়েছে। এবার যেমন বইমেলায় আইমান সাদিক, মানজারিন শহীদের মতো জনপ্রিয় ইউটিউবারের বইও ব্যাপক বিক্রি হয়েছে। ইংরেজি শেখার বই। টোটকা বুদ্ধির বই। সামাজিক যোগাযোগ বিষয়ক নানারকম বই সময়ের প্রবণতা বুঝে এবার বইমেলায় এসেছে। কোনো কোনো প্রকাশক এগুলোকেই বই বাণিজ্যের সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন।
সবরকমই থাকে। ভালোও থাকে মন্দও থাকে। ব্যবসাও থাকে আবার অব্যবসা ও মহৎ সৃষ্টিও থাকে। যার যা ক্ষুধা তা পুরণের ব্যবস্থাও তো বইমেলা। প্রাণের এই বইমেলা ছাড়া তো এমন সব বিষয় ভাবা যায় না। বই নিয়ে বহুমুখি উদযাপনের একটি মাস সত্যিই বাঙালির পৃথক এক মৌসুম। ষড়ঋতু যেভাবে বাঙালির প্রাণ পূর্ণ করে, সপ্তম ঋতু হিসেবে বইমেলা সেই প্রাণে ঢালে রং, তৃষ্ণা ও সৃষ্টির অস্থিরতা। আমাদের বই দিবস তো বইমেলার প্রতিটি দিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)