গত ১৮ নভেম্বর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সহ অনেকগুলো অ্যাপস বিটিআরসি’র মাধ্যমে বন্ধ রয়েছে। এরপরও ফেসবুক চালানো যাচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। প্রক্সি সার্ভার কিংবা ভিন্ন ভিন্ন ব্রাউজার, এডওন্সের মাধ্যমে। ম্যাসেঞ্জার বন্ধ রয়েছে, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার সহ আরও বেশ কিছু যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের সরকারিভাবে যে কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছিল সেটা ছিলো নিরাপত্তা।
জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার অংশ, কিংবা নিরাপত্তার অংশ হিসেবে সরকার কঠিন হলেও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বাস্তবতাকে বিবেচনা করে সেগুলো নিয়ে হালকা আলোচনা-সমালোচনা হতেও পারে। এটা সহজাত। কারণ ভোক্তা চাইবে সেবা আর সেবাদাতা সেবাদানের সময়ে খেয়াল করবে অপরাপর সুবিধা-অসুবিধাসমূহ। তবে এটা সাময়িক না হলে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, এবং সেই স্বাভাবিক।
প্রাথমিকভাবে ফেসবুক বন্ধ করতে গিয়ে সরকার পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থাই বন্ধ করে দেয়। যখন তারা টের পেলো তার আগে কেটে গেলো সোয়া ঘণ্টা। এই সময়ে সব কিছু যে থমকে গিয়েছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ এ সময়ে আর্থিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ইন্টারনেট সম্পর্কিত।
আজ থেকে বিশ বছর আগের বাংলাদেশ হলে সেটা হয়ত বড় ধরনের কোনো ঘটনা ছিলো না, কিন্তু এখন এই মুহুর্তে ইন্টারনেটবিহীন সময় মানে সূর্যের প্রখরতা তবু অন্ধকার দিন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করতে গিয়ে পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থা অচল করে দেওয়া বলা হচ্ছে ভুলবশত হয়েছে। তবে এটাকে স্রেফ একটা সাধারণ ভুল ভেবে নেওয়ার কারণ নাই। এটাকে যদি সংশ্লিষ্টদের প্রযুক্তিজ্ঞানের একটা স্মারক বলা হয়, তাহলে কি ভুল বলা হবে? আমার ধারণা সে রকমই। কারণ স্রেফ ভুল হলে তা সংশোধনের জন্যে সোয়া ঘন্টা সময় লাগার কথা না।
ইন্টারনেটবিহীন পাঁচ মিনিট যেখানে সবকিছু থমকে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট সেখানে সোয়া ঘন্টা বিশাল এক সময়। এখানে যদি কেউ অজ্ঞতাকে খুব কঠিন সংজ্ঞায়ন হিসেবে চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হোন তাহলে এটা নিশ্চিতভাবেই দায়িত্বের প্রতি অবহেলা, যার মাসুল দিতে হয়েছে সারা দেশকে।
যাই হোক, ইন্টারনেট ব্যবস্থা ফিরলেও ফেরেনি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। কবে সেটা স্বাভাবিক হবে এ নিয়ে সরকারও পরিস্কার করে কিছু বলছে না। তাদের বক্তব্য- পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তবেই খুলবে ফেসবুক। এ পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে সেটাও অনিশ্চিত। সরকার নিজেও হয়ত জানে না সেটা।
সরকারের এমন অবস্থায় এটা প্রমাণ হয় যে তারা নিজেরা স্বীকার করছে দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই, এটা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তারা কোনোভাবেই এটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারছে না। ফলে যেখানে আইনশৃঙ্খলা উন্নতির দিকে তাদের দৃষ্টিপাত করা দরকার ছিলো, এর বাইরে তারা পুরো দেশটাকেই জিম্মি করে রেখেছে।
প্রশাসনের ব্যর্থতার মাসুল দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ইন্টারনেট কি তাহলে মৌলিক অধিকার? অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা- এগুলো যদি হয় মৌলিক অধিকার তবে এ অধিকারগুলো উপভোগ এবং অধিকার আদায়কল্পে অন্য যে সব মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে ক্রমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সে জায়গা করে নিচ্ছে।
এখন ফেসবুক কেবল চ্যাট, হাই-হ্যালো কিংবা সময় কাটানোর একটা মাধ্যমই নয়। শিক্ষা, তথ্য, ব্যবসা সহ সবকিছুতে ফেসবুক জড়িয়ে গেছে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তখন সেখান থেকে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সংস্থান হচ্ছে। শিক্ষা, চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্য, উপাদান সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোরও সম্পর্কিত।
তাহলে মৌলিক অধিকার না হলেও মৌলিক অধিকার ভোগ ও প্রাপ্তির একটা জায়গা হিসেবে ক্রমে উপস্থাপন করছে। আর এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা যা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার বলে স্বীকৃত সেখানেও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে অন্যায় এ বিধিনিষেধ।
ফেসবুক বন্ধের পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এক নিবন্ধে ঘটনার জন্যে দুঃখপ্রকাশ করে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যে নিজেকে গর্বিত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার এ নিবন্ধ আবেগে পরিপূর্ণ এবং বিভিন্নভাবে এ বন্ধের পক্ষে সাফাইকাব্য। তার সে সাফাইকাব্যের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে বিনীতভাবে বলি ফেসবুক বন্ধের যে যুক্তি দেখিয়েছেন সেটা আসলে মেনে নেওয়ার মত না।
গত ২৪ নভেম্বর ফরিদপুর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলোক সেনকে ফরিদপুরে নিজ বাসার সামনে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। রংপুরে ১০টি খ্রিস্টান মিশনারির প্রধানদের হত্যার হুমকি দিয়ে একটি উড়ো চিঠি পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে,বাংলাদেশে যারা খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করছে,তাদের সবাইকে এক এক করে বিদায় করা হবে। এগুলোত সব ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার পরের ঘটনা। কই অপরাধ কি বন্ধ হচ্ছে,অপরাধী কি কেবলই ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে?
ফেসবুক বন্ধের পর সাইবার পেট্টোলিংয়ের মাধ্যমে ২৩টি সংগঠনকে চিহ্নিত করার কথা প্রচার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বগুড়ার শিয়া মসজিদসহ কয়েকটি জায়গার নাশকতার পর অপরাধীরা সংগঠিত হতে পারেনি বলে ধরা পড়েছে। তারা সোশ্যাল সাইটে যে যোগাযোগ আগে করত এখন মোবাইলের মাধ্যমে করার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
তাহলে এখানে প্রশ্ন দাঁড়ায়, যদি তারা ঘটনা ঘটিয়েই ফেলে তার আগেও যোগাযোগ রক্ষা করত, তখন তবে তাদের প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? তাহলে কি ধরে নিতেই হচ্ছে, প্রশাসন অপেক্ষা করছিলো ঘটনা ঘটার এবং এরপর এর সঙ্গে জড়িত যারা তাদেরকে গ্রেফতার করে ফেসবুক সহ সোশ্যাল সাইটগুলো বন্ধের যৌক্তিকতা প্রমাণ করার!
যে কোনো ঘটনায় যারা আক্রান্ত হয় দিনশেষে তারাই দুখীজন, কারণ তারা কখনই বিচার পায় না, বিচার করা হয় না। সরকার যখন দেখে এর পেছনে কোন জঙ্গি সংগঠন আছে তখন তারাও গুটিয়ে যায়। এটাই ভবিতব্য ভেবে বিচারের বাণীগুলো আরও কোন ঘটনা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। এরপর নতুন ঘটনা আসে, সবাই সে দিকে ব্যস্ত হয়। সরকার, প্রশাসন ওসবকে পুরনো ইস্যু ভেবে ফেলে রাখে।
ফেসবুকসহ সোশ্যাল সাইটগুলো বন্ধের সরকারের এ সিদ্ধান্ত ছিল ১৮ নভেম্বর, যে দিন দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) ও আলী আহসান মুজাহিদের রিভিউ আবেদন খারিজের মাধ্যমে ফাঁসির দণ্ড বহাল থাকে সেদিন। ওইদিন থেকে দণ্ড কার্যকরের দিন পর্যন্ত তা বন্ধ করে রাখা অনুমিতই ছিলো।
কারণ এর আগে আমরা দেখেছি, যুদ্ধাপরাধী সাঈদী কিংবা অপরাপর যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দণ্ড ঘোষণার পর থেকে জামায়াত-শিবিরের দেশব্যাপী নাশকতা। সে সময় প্রশাসন ব্যর্থ ছিল, প্রশাসকেরাও ছিল ব্যর্থ। কারণ সবাই জানত নাশকতা চালাতে পারে, তবু তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে অনেকগুলো প্রাণ ঝরে গিয়েছিলো।
এখানে দোষ কি শুধুই যোগাযোগ ব্যবস্থার? প্রশাসনের কর্মপরিধি ও কাজের ব্যাপ্তি তাহলে কী?
সে দিক বিবেচনায় নিলে বলা যায়, সরকার সে সময়কার নাশকতাকারীদের ধরেনি,শাস্তি দেয়নি তাই তারা সুযোগ পেয়ে বার বার আঘাত হেনেছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে অপরাধীদের পেছনে না ছুটে সাধারণ মানুষদের জিম্মি করার অদ্ভুত সিদ্ধান্ত কেবল হাস্যকরই না, এটা অমানবিকও বটে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেনি,তখন তারা অজুহাত দেখিয়েছিল এতে করে দেশের গোপনীয়তা বিঘ্নিত হবে,দেশের তথ্য বাইরে পাচার হবে। কিছুদিনের মধ্যে প্রমাণ হয়েছিল তারা ছিল ভুল। দেশকে পিছিয়ে দিতে এধরনের সিদ্ধান্ত যথেষ্ট। এখন যখন দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে রাখা হচ্ছে তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা কথাগুলো সেই ৯১ সালের বিএনপির দেওয়া বক্তৃতার মতই মনে হচ্ছে।
ফলে এটা স্রেফ একটা অজুহাত হিসেবেই পরিগণিত হচ্ছে। এখন সরকার বলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উত্তরণ হলেই ফেসবুক খুলে দেওয়া হবে। কবে উন্নতি হবে সেটা সরকার নিজেই জানে না। ফলে দমবন্ধ অবস্থায় থাকা মানুষজন ঠিকই টের পাচ্ছে এটা দীর্ঘমেয়াদি এক ‘সরকারি অবরোধ’ হতে যাচ্ছে। এখন এই মুহূর্তে দেশে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, সরকার সে সবকে সমানে অস্বীকার করেই যাচ্ছে।
সম্প্রতি দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। সামনে নির্বাচন। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বাভাবিকভাবে আরও বেশি কঠিন অবস্থা দিয়েই যাবে। এর পাশাপাশি সারা বছর বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষাত আছেই। যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় সরকারের মন্ত্রীরা ফেসবুককে দায়ি করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের যে কোন গণবিরোধী সিদ্ধান্ত, বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বিরোধিতার সম্মুখিন হয়েছিলো। দেশে কার্যত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি না থাকার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে থাকা সচেতন মানুষজন গঠনমূলক বিরোধী দল হয়ে উঠছিলেন।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে এ জায়গাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে একটা উপলক্ষের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ অন্যান্য ইস্যুতে ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করলে আরও বড় ধরনের সমালোচনার সম্মুখিন হবেন এ বিবেচনায় সে সময়ে ফেসবুক বন্ধ করা হয়নি।
উপলক্ষ হিসেবে দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি এবং জননিরাপত্তা ইস্যুকে মানুষজন গুরুত্ব দেবে বিবেচনা করে এখানে সরকার একপ্রকার ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল’ করেছে। কারণ এ দেশের অনলাইনে শক্তিশালী মানুষদের অধিকাংশই যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ দণ্ড চায়। মানুষের এ চাওয়ার জায়গাকে অন্যভাবে ব্যবহার করেছে সরকার পুরো সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অবরুদ্ধ করে দিয়ে।
কারণ তারা জানে এখানে যখনই সমস্যায় হাঁসফাঁস করে ওঠবে মানুষ তখনই বলা হবে যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকরের পরবর্তী নাশকতার কথা। ফলে কিছু সংখ্যক মানুষ মেনে নেবে, কিছু সংখ্যক মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে।
দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সাকা-মুজাহিদের দণ্ড কার্যকর হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সরকার ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো খুলে দিচ্ছে না। তারা এখন বলছে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ এর কথা। তখনই তাদের আসল উদ্দেশ্য পরিস্কার হয়ে যায়। দেশের মধ্যে তারা সম্ভাব্য সকল গঠনমূলক বিরোধিতা হলেও সে সব অংশকেই কার্যকর হতে দেবে না- এটাই এখনকার উদ্দেশ্য।
এ অবস্থায়ও আমরা ফেসবুকে ঢুকতে পারছি বিভিন্ন উপায়ে। স্বাভাবিক কাজগুলোই করছি। আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক ভেরিফাইড পেজও ফেসবুকে সক্রিয় রয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাও ফেসবুকে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ ও মন্ত্রিসভার সে সদস্যের সক্রিয়তা কি সরকারি সিদ্ধান্তের অসারতাকে প্রমাণ করে না- প্রশ্ন জাগে।
আমরা ফেসবুক ব্যবহার করছি, তবে অনেকেই পারছেন না। অনেকেই ভাবছেন অনেক বিধিনিষেধের কথা। ফলে সরকারি এ অনলাইন অবরোধের কবলে পড়েছে লাখ লাখ ব্যবহারকারী। অবরোধ বলছি কারণ এ বছরের শুরুর দিকের বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধে দেশের সবকিছু স্বাভাবিক ছিল বলে দৃশ্যমান হচ্ছিল। তবু আমাদের অর্থনীতি পিছিয়েছে।
অর্থনীতির সে ব্যাপারগুলো খালি চোখে দেখা সম্ভব না,কিন্তু যারা এসবের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা টের পেয়েছে। এখন সরকারি এ অনলাইন অবরোধের মধ্যেও অনলাইন চলছে,ফেসবুক চলছে,আমরাও চালাচ্ছি কিন্তু দৃশ্যমান ক্ষতির বাইরে যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটা কেবল ভুক্তভোগিরাই টের পাচ্ছে। এ দলে অনেকেই আছে;আমি আছি, আপনিও!
এ ধারাবর্ণনা যখন আমি দিচ্ছি তখন আমি সরকারি অনলাইন অবরোধের মধ্যে থেকে অবরোধ ভেঙেই দিচ্ছি। এটা আজ প্রমাণিত যে অনলাইনে যত ধরনের বিধিনিষেধ আসুক না কেন এর মুখোমুখি হয়ে প্রতিকার কিংবা ভিন্ন পথ বের করা কারও পক্ষেই অসম্ভব না। এখন এমনই হচ্ছে,ভবিষ্যতেও হবে।
রাষ্ট্রের পক্ষে ইন্টারনেট স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব না। ইন্টারনেট বন্ধ না হলে সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো চালানোর অনেকগুলো পথ খোলা- এটা প্রমাণিত। অনেকেই ব্যবহার করছে সামাজিক সাইটগুলোও। তাহলে এটাকে বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত দীর্ঘায়িত করার কি দরকার,আর এর যৌক্তিকতাই বা কোথায়?
দায়িত্বশীলরা বলছেন, বলবেন- নিরাপত্তার কথা। কিন্তু আপনারা কি নিরাপত্তা দিতে পারছেন? শিয়া মসজিদের ঘটনা সবচাইতে বড় প্রমাণ। বলছেন,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকায় অপরাধীরা ধরা পড়েছে,আরও অনেকেই ধরা পড়েছে। কিন্তু এ ধরনের ধরা-ধরিত সারা বছরই হয়ে থাকে। এ প্রশাসনের দায়িত্বশীলরাই বলেন অমুক এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত,তমুক সেই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এরপর কিছুদিন বাদেই তারা জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়।
তাহলে আপনাদের সে বক্তব্যের যৌক্তিকতা ও সত্যতা থাকল কোথায়? কীভাবে বলব যে সত্য বলছেন? আর কীভাবে এখন বলি সাম্প্রতিক সময়ের আটককৃতদের নিয়ে যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে সেগুলো সর্বাংশে সত্য?
বর্তমান সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার ও ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান এ দেশের তরুণদের আকৃষ্ট করেছিলো। এখনও করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের পরিপন্থি সিদ্ধান্তগুলো সরকারের সে অঙ্গীকারের প্রতি সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে। আমরা স্লো ইন্টারনেট ব্যবহার করি, অব্যবহৃত থেকে যায় ব্যান্ডউইথ- সেদিকে সরকারের লক্ষ্য নেই। সরকার ভারতে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করবে, করুক- কারণ সেখান থেকে অর্থ আসবে। কিন্তু দেশের অব্যবহৃত থেকে যাওয়া ব্যান্ডউইথ কোন কাজে আসছে না, মিলিয়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর বিধিনিষেধের কারণে অব্যবহৃত থাকছে ডাটা, ব্যবহারে ভাটা পড়ছে আন্তর্জাতিকভাবে- এদিকে দৃষ্টিপাত করাও জরুরি। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন।
সেসময়ে দেখেছিলাম তিনি কতখানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমবান্ধব। তার সফরসূচি, কার্যক্রম নিজের টুইটার-ফেসবুকে প্রচার করছিলেন। ফলে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে তিনি নিজেই ছিলেন সবচেয়ে বিশ্বস্ত সোর্স। কিন্তু বাংলাদেশের ডিজিটাল সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কোন ফেসবুক একাউন্ট নেই, পেজ নেই, টুইটার একাউন্ট নেই- অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ সম্পর্কহীন একটা দেশের সরকার প্রধান এটা এই মুহুর্তে কঠিন এক অবাস্তব কল্পনা।
ফলে প্রশ্ন জাগে, ডিজিটাল সরকারের অধিকাংশ দায়িত্বশীলগণ ইন্টারনেট ব্যবহারে কতখানি সক্ষম? দীর্ঘ অনলাইন জীবন পরিভ্রমণ করে জেনেছি কয়েকজন বাদে অধিকাংশেরই কোন আইডি নেই, এক্টিভিটি নেই। এটা জরুরি ছিল, কারণ সেখান থেকে আমরা খুব সহজেই অনেক তথ্য নিতে পারতাম।
একটা দেশের তরুণ সমাজ সে দেশের শক্তি হতে পারে যদি তাদেরকে সব ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়। তরুণদেরকে সে সুযোগ দিন, তারা প্রতিদান দিয়ে যাবে। আগেও দিয়েছে,এখনও দিচ্ছে আর প্রতিদান দেওয়া যাদের সহজাত আচরণ তারা ভবিষ্যতেও দেবে- সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আট বছর আগে আওয়ামী লীগের স্বপ্ন ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ। আট বছর পর যদি সেটা এখনও স্বপ্নই থেকে যায় তাহলে অগ্রগতির জায়গা কোথায়? স্বপ্নকে আর স্বপ্নের মধ্যে না রেখে বাস্তবে নিয়ে আসুন। হাঁটার জায়গা দিন, বাংলাদেশ দৌড়ে এগিয়ে যাবে
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)